আমার সোনার বাংলাদেশ

ঢাকুরিয়া, কলকাতা



সত্যি কথা বলতে কী, বাংলাদেশের প্রতি আমার যে খুব একটা টান ছিল তা নয়। বাবার কাছে ওপারের কথা শুনতে শুনতে কেমন একটা আকর্ষণ হতে থাকে দেশটার প্রতি। বাবা ও মার অনুপ্রেরণায় আমি বাংলাদেশ ট্যুরের ছক কষতে থাকি। এই কাজে আমাকে আমার অফিস কলিগ অনির্বাণ খুবই সাহায্য করেছে। অনির্বাণ দিনরাত ঘেঁটে এই প্ল্যানটি করেছিল। শীতকাল হল বাংলাদেশ যাবার জন্য সবথেকে ভাল সময়, কারণ এই সময় আবহাওয়া খুব ভাল থাকে আর ট্যুরিস্ট স্পটগুলো সুন্দর ভাবে সেজে ওঠে।

সেই প্ল্যানমাফিক আমাদের অফিসের সাতজন মিলে যাত্রা শুরু করলাম বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে, মৈত্রী এক্সপ্রেসে। সকাল সাতটা বেজে দশ মিনিটে আমাদের ট্রেন ছিল কলকাতা স্টেশন থেকে। তার আগে সমস্ত ইমিগ্রেশনের নিয়ম শেষ করে আমরা ট্রেনে প্রবেশ করলাম। গেদে স্টেশন পেরিয়ে যেতেই আমরা নো ম্যান্স ল্যান্ডে প্রবেশ করলাম আর দেখলাম 'ওয়েলকাম টু বাংলাদেশ' লেখাটা। মনটা আনন্দে ভরে গেল। দর্শনা এল, বাংলাদেশের প্রথম স্টেশন। ট্রেন দুরন্ত গতিতে ছুটছিল। যমুনা ও  পদ্মা নদী পেরিয়ে গেলাম, এরপর এল ঈশ্বরদি, তারপর বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমরা পৌছোলাম ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। ইমিগ্রেশনের যাবতীয় নিয়ম মিটিয়ে, আমরা বাসে করে সোজা চলে গেলাম আশকানায়। ওখানে আমাদের রাত্রিবাস। জায়গাটি হল এয়ারপোর্টের ঠিক উল্টোদিকে হাজি ক্যাম্প এরিয়ায়। এর মধ্যে আমাদের একজনের পুরো কুড়ি হাজার টাকা পিক পকেট  হল! কী আর করা, সান্ত্বনা দিয়ে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম ও তার পুরো দায়িত্ব আমরা নিলাম। আমাদের আবাসিক হোটেলটি, বিমানবন্দর, রেল স্টেশন ও বাস রুট  সামনেই ছিল। সেদিন খুবই ক্লান্ত ছিলাম, বিছানায় পড়তেই ঘুম এসে গেল। 


পরদিন আমরা চললাম ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিতে। তার আগে জয়ন্তীদিকে নিয়ে তাঁর পিসির বাড়ি গেলাম। শাহিন কলেজের সামনে। সেখান থেকে ফোনের লোকাল সিমকার্ড নিলাম কথা বলার জন্য। বলে রাখি, পরদিন কালীপুজো ছিল, তাই ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ভিড় খুব বেশি ছিল না। আমরা বেশ ভালোভাবেই পুজো দিলাম। সেখান থেকে আমরা গেলাম লালবাগ। অক্ষয়ের দোকানে মাছ-ভাত পেটপুরে খেয়ে আমরা এবার দেখলাম লালবাগ ফোর্ট। সেখান থেকে চলে গেলাম শহীদ স্মৃতি, যেখানে একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরলাম - এক কথায় অনবদ্য। এরপর গেলাম রমনা কালীবাড়ি। মন্দিরে মায়ের মুখ অপরূপ। এখানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাত কোটি টাকা দান করেছেন। সেখান থেকে আমরা হোটেলে চলে এলাম। সেদিন ওখানে আমাদের রাত্রিবাস।
 
পরের দিন আমাদের গন্তব্য কিশোরগঞ্জ। এর মধ্যে আকাশের অবস্থা খুব খারাপ হতে শুরু করল। 'সিত্রাং' ঝড়ের প্রভাব এখানে ভালোভাবেই পড়েছে। এরই মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে আমরা সকাল আটটা নাগাদ কিশোরগঞ্জ যাওয়ার ট্রেনে উঠলাম। ভৈরব নদ পেরোবার পর প্রায় বারোটা নাগাদ কিশোরগঞ্জ নামলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। তার ওপর আজ কালীপুজো। আমাদের আজ হাওর মিঠামইন দেখার পরিকল্পনা ছিল কিন্তু গন্তব্য বদল করতে হল বৃষ্টির জন্য। আমরা কিশোরগঞ্জ থেকে সোজা বাসে করে ময়মনসিং রওনা দিলাম। প্রায় বিকেল চারটে নাগাদ আমরা ময়মনসিং নামলাম। কিন্তু এত বৃষ্টি, যে হোটেলেই বসে থাকতে হল। দূর থেকে হোটেলে বসে আমরা কালীপূজার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। সেদিন ম্যাগি খেয়েই থাকতে হল কারণ বাইরে বেরোনোর কোন সুযোগ ছিল না।
 
পরের দিন ছিল ঐতিহাসিক মুহূর্ত। প্রায় পঁচাত্তর বছর পর আমি আর বাবা মিলে খুঁজতে বেরোই বাবার সেই গ্রাম, অর্থাৎ বাবার যেখানে জন্ম হয়েছিল, ময়মনসিংহ জেলার ভেতর ফুলপুর উপজেলার অন্তর্গত রূপসী ঘুমগাঁও গ্রাম। মনে শিহরণ হচ্ছিল। প্রায় ভোর পাঁচটা নাগাদ আমি আর বাবা একটি সিএনজি ঠিক করে বেরিয়ে পড়লাম অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। গুগল ম্যাপ দেখে আমরা আগে থেকেই ল্যান্ডমার্কগুলি ঠিক করে রেখেছিলাম। সেগুলি অনুসরণ করতে করতে যথাক্রমে পাগলা বাবার মসজিদ, শসার বাজার, হিমাদপুর মোটরভাঙ্গ্‌  ও বালিয়াচক হয়ে পৌছালাম ফুলপুর বাজার। সেখান থেকে রূপসি বাজার ক্রস করে ও লোকেদের সাহায্য নিয়ে পৌঁছলাম ঘুমগাঁও চৌরাস্তা। চৌরাস্তার সামনে এসে একজনের পরামর্শে 'মীরবাড়ি'র দিকে গেলাম। 

আমাদের প্রথম খুঁজতে হল কোনু মাস্টারের বাড়ি। দাদু কোনু মাস্টারের কথা বাবাকে শেষ বলে গিয়েছিলেন, কিন্তু সে সব কত বছর আগের কথা! কে বেঁচে আছে, বা কেই বা বলতে পারবে কোনু মাস্টারের খবর? এইসব ভেবে খুব অসহায় লাগছিল। কিন্তু বলে না রাখে হরি মারে কে, এক চায়ের দোকানে একজন বয়স্ক লোক বসেছিলেন। আমাদের দেখে ডাকলেন ও সব কথা শুনলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ তিনি জানেন কোনু মাস্টারের বাড়ি ও আমাদের বাড়ির ঠিকানা। সে কথা শুনে মনে এত আনন্দ হচ্ছিল, তা বোঝাবো কী করে বলতে পারছি না। কোনু মাস্টারের বাড়িটা বেশ বড়, কিন্তু বাড়িটা তালা দেওয়া ছিল। কোনু মাস্টার মারা গেছেন, তাঁর এক ছেলে ডাক্তার, ময়মনসিংহে থাকেন। সেখান থেকে সেই ভদ্রলোকের সহায়তায় আমরা প্রথমে গেলাম যতীন্দ্র চক্রবর্তীর বাড়ি, একমাত্র হিন্দু পরিবার যিনি সেই সেই গ্রামে বাস করেন। তিনি আমাদের জমিটা রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। প্রথমে তিনি আমাদের দেখে একটু ভয় পেয়েছিলেন, ভাবছেন যে আমরা হয়ত সেই জমি ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে ওখানে এসেছি। পরে বাবা আশ্বস্ত করার পর তিনি যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলেন, আস্তে আস্তে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তিনি বলেন যে বাবার দুই কাকা নৃপেন ও নগেন কাকু ছিলেন, যাঁরা অনেকদিন মারা গেছেন। নগেন কাকুর বউ মানে বাবার কাকিমা, এই জমি তাঁর নিজের ভাইকে দিয়ে যান, ভাই এই জমি আবার চক্রবর্তীকে লিখে দেয়। তাই তিনি এই জমি রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। এমন করে কীভাবে জমি লেখা যায় নিজের নামে আমার জানা ছিল না। যাই হোক আমাদের ওটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। 

যতীন্দ্র চক্রবর্তী বালিয়াচক হাই স্কুলের একজন প্রাক্তন শিক্ষক, তাঁর ছেলেও ডাক্তার, তিনি ময়মনসিংহে থাকেন। তাঁরা আমাদের ভালোভাবেই আপ্যায়ন করেছিলেন। উনিই আমাদের ওই জমিটার কাছে নিয়ে গেলেন যেখানে ছিল বাবার জন্মভিটা। চোখে জল চলে আসছিল বাবার, কারণ ছোটবেলা তাঁর এখানেই কেটেছে। বাবার মনে কী যে হচ্ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। এটাই আমার পরম প্রাপ্তি। চারদিকে ধানজমি ও পুকুর ছিল, যা আমার  প্রপিতামহ কৃষ্ণ আচার্যর নামে বাটা ছিল। তিনি আমার দাদু বসন্ত আচার্যর বাবা। কৃষ্ণ আচার্যর নামে পঞ্চাশ বিঘা জমি ছিল। চক্রবর্তীবাবু জানেন যে আমার দাদু একজন ভালো ফুটবলার ছিলেন। প্রচুর পুরনো কথা আমরা বলছিলাম, যা শুনে উনি চমকে যাচ্ছিলেন। অনেক ছবি তুলেছিলাম গ্রামটার, তার সঙ্গে ভিটেটা নিয়ে বাবার একটা ছবি তুললাম। শুধু ভারত থেকে এসে অখ্যাত বাংলাদেশের এই ছোট্ট গ্রামটাকে খুঁজে পাব তা আশা করিনি। প্রায় ঘন্টাখানেক থেকে সকলকে বিদায় জানিয়ে আমরা ফিরে চললাম ময়মনসিংহ। এখানে এসেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম একদিনের ট্যুরে। একে একে দেখলাম মুক্তাগাছা রাজবাড়ি, পৌরসভা। গোপাল সাহার মন্ড খেয়ে আবার হোটেলে ফিরে এলাম। মুক্তাগাছার মন্ড পৃথিবীবিখ্যাত। ময়মনসিংহ কালীবাড়িতে আমরা পুজো দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে। 

কিশোরগঞ্জে আমাদের দলের কল্যাণের মামারবাড়ি ও আত্মীয়বাড়ি। বাবা, মা ও বাকি তিনজন মানে মোট পাঁচজনকে  বাসে উঠিয়ে দিলাম কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে। আমরা দুজন কিশোরগঞ্জ থেকে পাঁচ কিলোমিটার আগে নেমে গেলাম। যেখানে অনির্বাণের মামা দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের জন্য। তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন, আন্তরিক অ্যাপায়ন করেছিলেন। অনির্বাণ ভিডিও কল করে বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলালো। সবার মন আনন্দে ভরে উঠেছিল, আর এটা সম্ভব হয়েছিল অনির্বাণের জন্য। দুই বাংলা যেন এক হয়ে গিয়েছিল। খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম। আমরা চা, বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম একজন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানে দারুন অভিজ্ঞতা হল। অনির্বাণ বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার নিল। সেখান থেকে আরেক আত্মীয়ের বাড়িতে গেলাম ও সেখানে রাতের খাবার খেয়ে আমরা কিশোরগঞ্জে প্রিন্স হোটেলে ফেরত এলাম।
 
পরদিন আমাদের গন্তব্য হাওর মিঠামইন ও নিকলী। অটো চেপে আমরা রাস্তাটা পুরো ঘুরলাম, মিঠামইন এক কথায় অপরূপ। সেখান থেকে আমরা গেলাম অষ্টগ্রাম। স্পিডবোটে করে হাওর রিসর্টে নামলাম। সেখানে বাংলাদেশ প্রেসিডেন্টএর বাড়ি ঘুরে এলাম। জায়গাটা এত রোমান্টিক ছিল যে আমি আর অনির্বাণ সুন্দর গান গাইছিলাম। এসব দেখে ফিরে এলাম কিশোরগঞ্জ, তখন ঘড়িতে দুপুর তিনটে। জয় কালী রেস্টুরেন্ট থেকে পেট পুরে মাছভাত খেয়ে আমরা চললাম ঢাকার বাসে ওঠার জন্য। প্রায় নটা নাগাদ আমরা ঢাকা বিমানবন্দরের স্টেশনে নামলাম। রাত এগারোটায় আমরা তূর্ণা এক্সপ্রেসে যাত্রা শুরু করলাম চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। নন এসি, ফার্স্ট ক্লাস কেবিনগুলি দারুন ছিল। ভোর সাতটা নাগাদ আমরা চট্টগ্রামে পৌঁছোলাম। এখানে কিছুক্ষণ থেকে ফেরার টিকিট একেবারে কেটে নিলাম। এরপর সেখান থেকে অটো করে নতুন বাজার ও সেখান থেকে পূর্বাণী বাসে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দিলাম। প্রায় ১৪৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সাড়ে তিন ঘন্টার মধ্যে আমরা কক্সবাজার পৌছে গেলাম। দুপুর দুটো বেজে গেছে, ডলফিন মোড়ে নেমে আমরা অটো করে সুগন্ধা ও কলাতলী বিচের সামনে একটা হোটেলে উঠলাম। এরপর একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা কক্সবাজার বিচে গেলাম। সেখান থেকে সোজা গোবিন্দা'স ইসকনের রাতের খাবার খেতে গেলাম। সম্পূর্ণ নিরামিষ, উত্তম খাবার। খাওয়া দাওয়া তাড়াতাড়ি সেরে হোটেলে ফিরে এলাম, কারণ পরের দিন আমাদের গন্তব্য সেন্ট মার্টিন, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। একে বাংলাদেশের আন্দামান বলে। আপনাদের বলা হয়নি, কক্সবাজার হল বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত।

পরের দিন সকাল সকাল স্নান সেরে পৌঁছলাম জাহাজঘাটে। কর্ণফুলি  শিপ প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ ছেড়ে যায় কিন্তু কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য সকাল ন'টা নাগাদ ছাড়ল। প্রায় ছ'ঘন্টা লাগল সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পৌছোতে। জাহাজে দারুন উপভোগ করেছিলাম, এত লং জার্নি আমি কখনো আগে করিনি। প্রায় তিনটে নাগাদ আমরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নামলাম। 
সেখানে কাস্টম চেক করে আমরা নির্দিষ্ট রিসর্টে উঠলাম। বিচের ধারে রিসর্টটি খুব সুন্দর। আমরা রিসর্টে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে সমুদ্রে নেমে পড়লাম। সমুদ্র থেকে বিকালের সূর্যাস্ত দারুণ লাগছিল। সেন্ট মার্টিনে খাওয়ার একটু সমস্যা ছিল। ম্যাগি ও ছাতু খেয়ে মোটামুটি দিনটা কাটিয়ে দিলাম। পরের দিন আমরা চললাম ছেঁড়া দ্বীপ, গলাচিপা ও সীমান্ত দেখতে। সিটাং ঝড়ে যে জাহাজটি সেই দ্বীপে আটকে ছিল, সেই জাহাজটি দেখলাম। সকাল আটটার মধ্যে ছেঁড়া দ্বীপ দেখে ফিরে আসতে হবে, কারণ এর পরে দ্বীপটি জোয়ারের জলে ভরে গিয়ে তিনটি আলাদা দ্বীপ হয়ে যায়। অসামান্য অভিজ্ঞতা। ছেঁড়া দ্বীপ দেখে যখন ফিরলাম তখন প্রায় একটা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে আমরা  জাহাজঘাটে চলে এলাম। প্রায় বিকেল চারটে নাগাদ আমাদের জাহাজ ছাড়ল। প্রায় রাত দশটা নাগাদ কক্সবাজার পৌছোলাম। ওখানে গোপীনাথ হোটেলে ডিনার সারলাম। খুবই ক্লান্ত লাগছিল, তাড়াতাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
 
আমরা পরের দিন অটো করে পাটোয়াটেক, এনানি বিচ, হিমছড়ি ঝর্না পাহাড় দেখতে গেলাম। টেকনাফ রোডটা সুন্দর লাগছিল। একদিকে পাহাড় ও  অন্যদিকে সমুদ্র, টেকনাফ এক কথায় অসাধারণ ছিল। সেখান থেকে গেলাম রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ড। তারপর সেখান থেকে বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেলে লাঞ্চ সেরে, সোজা বেরিয়ে গেলাম মহেশখালী। আদিনাথ মন্দির দেখতে। ওখান থেকে ফিরে এসেই কক্সবাজারের বিচে চলে এলাম। প্রায় দু'ঘন্টা চুটিয়ে স্নান করলাম। মনপ্রাণ সতেজ হয়ে গেল। সন্ধের দিকে এরপর আমরা চললাম বার্মিজ মার্কেট। সেখানে শাল ও চকলেট কেনা হল। আমরা জাহাজ থেকেই দেখেছিলাম মায়ানমার সীমান্ত, এপারে বাংলাদেশ ওপারে মায়ানমার। মার্কেটিং করে সোজা ডিনার করে হোটেলে ঢুকে পড়লাম। বলা হয়নি, এর মাঝে আমরা পরের দিন বান্দরবান যাওয়ার টিকিট কেটে নিয়েছিলাম। পরের দিন মোটামুটি  সকাল আটটা নাগাদ রওনা দিলাম কক্সবাজার থেকে বান্দরবানের উদ্দেশ্য। আড়াই ঘন্টা পর আমরা বান্দরবান পৌছালাম। সেখানে কাস্টম চেক করে আমরা একে একে দেখে নিলাম মেখলা  পর্যটন, নীলাচল, নীলগিরি। আমাদের হাতে বেশি সময় ছিল না তাই বান্দরবান থেকে তাড়াতাড়ি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেখান থেকে রাতের ট্রেন ধরে ঢাকা যাব। বান্দরবান থেকে তিন ঘন্টায় আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছে গেলাম। কেরানি মোড় হল একটি তিন রাস্তার মোড়, যার একদিকে কক্সবাজার, আর এক দিকে বান্দরবান ও অন্য  দিকে চট্টগ্রাম চলে গেছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ভ্রমণার্থীদের যাওয়া নিয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে। আবার টেকনাফ-মায়ানমার বর্ডারে রোহিঙ্গা সমস্যা আছে, তাই ভালো করে খবর নিয়ে তবেই যাওয়া উচিত।
 
চট্টগ্রামে পৌঁছে আমরা রাধিকাতে লাঞ্চ সেরে চট্টেশ্বরী মন্দিরে পুজো  দিতে গেলাম।
একে একে দেখলাম পতাকা বিচ, চন্দ্রনাথ হিল ও মন্দির, সীতা কুণ্ডু ইত্যাদি। ঘুরতে ঘুরতে প্রায় রাত ন'টা বেজে গেল। সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের ট্রেন, যা পরদিন ভোর ছটায় ঢাকা স্টেশনে নামিয়ে দেবে।
 
ঢাকা স্টেশন পৌঁছে দেখি সোনালীদির আত্মীয় আমাদের রিসিভ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।
একপ্রকার জোর করে তিনি আমাদের তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। গুলশান এরিয়ায় আফতাবনগরে তাঁর ফ্ল্যাটটি ছিল খুব সুন্দর। সেখানে স্নান সেরে ও টিফিন খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ঢাকাই জামদানি শাড়ি কেনার জন্য। বেইলি মার্কেটের রূপের হাট দোকান থেকে চারটি শাড়ি কিনে পদ্মার ইলিশ মাছ খেয়েছিলাম সেই আত্মীয়র বাড়িতে। ইলিশ ভেজেও নিয়ে গিয়েছিলাম ভারতে আনার জন্য। লাঞ্চ করে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম করে আমরা চললাম হাতি লেক দেখতে। লঞ্চ করে প্রথমে রামপুরা, তারপর গুলসানে নামলাম। বাংলাদেশের সম্মানীয় লোকেরা এই গুলসানে থাকেন। এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
 
ঘুরতে ঘুরতে প্রায় আটটা বেজে গেছিল। একটু কফি খেয়ে রিকশা করে নিলাম। ওখানে বসুন্ধরা মার্কেটে আমার কলিগের জন্য একটি গেঞ্জি কিনলাম। হাতে বেশি সময় ছিল না তাই  তাড়াতাড়ি লাগেজ নিয়ে আমরা ছুটলাম ঢাকা কমলাপুর বাসস্ট্যান্ডে। শ্যামলী যাত্রী পরিবহনের বাসে রাত ন'টা পয়ঁত্রিশ  মিনিটে আমাদের রিপোর্টিং টাইম ছিল। এখানে বলে রাখা উচিত ঢাকার রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম, তাই হাতে সময় নিয়ে বেরোনো উচিত। কমলাপুর স্টেশনে এসে দেখি ওখানে অবরোধ চলছে। বাস ছাড়বে আরামবাগ থেকে। শ্যামলী  যাত্রী পরিবহনের বাস। কোনরকমে ঝুঁকি নিয়ে এক  দৌড়ে আরামবাগে পৌঁছে বাসে উঠে পড়লাম। বাস ছাড়ল সামান্য দেরি করে, রাত সাড়ে দশটায়। পদ্মা সেতু দিয়ে বাস চলল দুরন্ত গতিতে। রাত আড়াইটা নাগাদ বাস থামল বাংলাদেশের ফরিদপুরে, সেখান থেকে ভোর চারটা নাগাদ পেট্রাপোল বেনাপোল বর্ডারে। সেখানে ভোর সাড়ে ছটা নাগাদ কাস্টম চেক হয়ে যখন বাসে গিয়ে উঠলাম তখন দেখি সকাল আটটা বেজে গেছে। ওখান থেকে সোজা বাস চলল কলকাতার উদ্দেশ্যে। মাঝে একবার দত্তপুকুরে বাস থামল লাঞ্চ করার জন্য। সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমরা কলকাতার কেষ্টপুর নেমে পড়লাম। ভারতীয় মুদ্রায় এক এক জনের প্রায় পনেরো হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে বারো দিনের ভ্রমণে।

এই বাংলাদেশ ভ্রমণ মা-বাবার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। পঁচাত্তর বছর পর নিজের ভিটেবাড়ির সংস্পর্শে আসা অবশ্যই এক অভিনব অভিজ্ঞতা। আর সেন্ট মার্টিন আমার কাছে ছিল এক স্বপ্নের দ্বীপ যা দেখার বহুদিনের সাধ ছিল। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা মনে পড়ে:
                                                                                      আমরা যেন বাংলাদেশের চোখের দুটি তারা। 
                                                                                                  মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে 
                                                                                                        থাকুক গে পাহারা। 
                                                                                                             দুয়োরে খিল। 
                                                                                               টান দিয়ে তাই খুলে দিলাম জানলা। 
                                                                                                        ওপারে যে বাংলাদেশ 
                                                                                                         এপারেও সেই বাংলা।

বৈশাখী ২০২৪