“রিশু, বাইরে যেতে হলে পুলওভারটা পরিস কিন্তু, নইলে মা দুঃখ পাবে!” “পাগল না মাথাখারাপ! ওই বিশ মন ওজনের পুলওভারটা পরলে আমাকে পোলার বিয়ারের মতো দেখতে লাগবে। তাছাড়া বাইরে এখন মিঠে রোদ। একটা হাল্কা জ্যাকেটই যথেষ্ট!” “মা, কত কষ্ট করে তোর জন্য ওটা বানিয়েছেন। মায়ের ফিলিংটাকে রেসপেক্ট করার জন্য একবার হলেও তোর ওই পুলওভারটা পরা উচিত!” “এতটা কষ্ট করার কি প্রয়োজন ছিল! আজকাল কেউ হাতে বোনা সোয়েটার পরে নাকি? তাছাড়া আমি কি বাচ্চা নাকি যে অত ডার্ক কালারের পুলওভার বানিয়েছেন!” “মা কি আমাকে জিজ্ঞেস করে বানিয়েছেন যে আমি বারণ করব? কলকাতায় তো পরতে বলছি না, ভালোবেসে বানিয়েছেন এখানে অন্তত এক-আধবার পর!” ঋষভ বা রিশু একটু জেদি স্বভাবের মানুষ। অল্প বয়েসে মাকে হারিয়ে একা-একা বড় হয়েছে বলেই হয়তো সে নিজের ব্যাপারে নিজে ডিসিশন নিতে পছন্দ করে। নতুন বউয়ের অনুরোধে মনের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা অসন্তোষ চেপে রেখে শাশুড়ি মায়ের বানানো সোয়েটার পরে নেয় কিন্তু মনের মধ্যে খানিকটা হলেও ক্ষোভ ঘনায়, ' সে কি শ্বশুর বাড়িতে এসেছে নাকি জেলখানায় '। প্রতি পদে-পদে তাকে শাশুড়ি মায়ের নির্দেশ মেনে চলতে হচ্ছে। এসে থেকে দেখছে শাশুড়ি মা সবসময় নিজের স্বামী আর মেয়ের সঙ্গে ডিক্টেটরশিপ চালাচ্ছেন আর ওরা সেটা মেনেও নিচ্ছে, তাই বলে কি তার উপরেও উনি নানারকম নিয়মকানুনের বিধিনিষেধ চাপাতে পারেন! ঋষভ আর তৃণার নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে যদিও বিয়ের আগে ওদের প্রায় দুই বছরের রোমান্স পর্ব চলেছিল। তৃণা বা তিন্নির বাবা হৃষিকেশে একটি বিদেশি ওষুধ কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার। হৃষিকেশ শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে একদম পাহাড়ি জায়গায় কোম্পানির প্রোডাকশন হাউস আর তার সঙ্গে গড়ে ওঠা ছোট টাউনশিপের উনিই হর্তাকর্তা বিধাতা। তিন্নির একদম ছোটবেলাটা এখানেই কেটেছে। তারপর অবশ্য দেরাদুনের কনভেন্ট থেকে স্কুলিং এবং পরে দিল্লি থেকে এম বি বি এস করে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে কলকাতায় এসেছিল। ঋষভ আর তৃণা ক্লাসমেট, প্রায় প্রথম দেখাতেই ওদের প্রেম হয়। দু'বছর প্রেম পর্ব চলার পরে এই বছরের শ্রাবণে দুই পরিবারের সম্মতিতে ওদের দুই হাত এক হয়েছে। পাইকপাড়ায় তৃণাদের পৈতৃক বাড়ি থেকে ওদের বিয়েটা হয়েছিল। সেই সময় বিয়ের হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে তৃণার মা মানে মুকুলিকা দেবীর সঙ্গে ঋষভের তেমন কিছু কথাবার্তা হয়নি। বিয়ের পরপরই নবদম্পতি গ্যাংটকে যায় হানিমুনে আর হানিমুন থেকে ফেরার আগেই তৃণার বাবা-মা হৃষিকেশে ফিরে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে স্কাইপে কথাবার্তা হলেওসামনা-সামনি কথাবার্তা হয়নি। ফলে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে নতুন জামাইয়ের তেমন চেনাজানা হয়নি। বিয়ে এবং হনিমুন মিলিয়ে বেশ অনেকটা ছুটি চলে যাওয়ায় ওরা আর এতদিনে হৃষিকেশ যাবার ছুটি পায়নি। শেষে ইয়ার এন্ডিং আর নিউ ইয়ার মিলিয়ে বেশ কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে ওরা হৃষিকেশে এসেছে। হৃষিকেশ এমনিতেই অত্যন্ত সুন্দর জায়গা আর তৃণাদের বাড়িটা শহরের বাইরে হওয়ায় আরও বেশি সুন্দর। আকাশ পরিষ্কার থাকলে বাংলোর বারান্দা থেকে হিমালয়ের শৃঙ্গ দেখা যায়। সকালে কুয়াশা না জমলে নবোদিত সূর্যের আভায় শৃঙ্গগুলো প্রথমে টকটকে লাল, পরে যেন গলানো সোনার রং ধারণ করে। বাতাস কী অসম্ভব টাটকা আর সতেজ সেটা নিজে প্রত্যক্ষ না করলে বোঝানো যায় না! রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, শীত চলছে বলে অধিকাংশ গাছই পাতাহীন কিন্তু রাস্তায় ঝরা পাতার লেশমাত্র চিহ্ন নেই। ছবির মতো সুন্দর ক্যাম্পাসটিকে সবাই মিলে ঝকঝকে পরিষ্কার করে রেখেছে। তৃণাদের বাংলোটা বিশাল বড়। সামনে লনটা মোয়ার দিয়ে ছাঁটা তাতে মরশুমি ফুলের গাছ। পিছনে কিচেন গার্ডেন, গ্যারাজ, সারভেন্ট কোয়ার্টার সব মিলিয়ে বেশ অন্যরকম। পুরনো ব্রিটিশ কোম্পানির আমলের বাংলো, বড় বড় কাঁচের শার্সি । কোম্পানি থেকে ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্য লোক পায় তৃণারা নইলে প্রায় দরজার সমান অতো বড় বড় শার্সিওয়ালা কাঁচের জানলা ঝকঝকে পরিষ্কার রাখা কারুর পক্ষেই সম্ভব হত না। মোম পালিশের মতো লাল মসৃণ মেঝে, কুড়ি বাই আঠারোর বিশাল বিশাল ঘর নিয়ে তৃণাদের বাংলোটা প্রায় ছবির মত সুন্দর। পুরো বাড়িটার কমান্ডিং অফিসার হলেন তৃণার মা। অসম্ভব নিয়মনিষ্ঠ, সারাক্ষণ নিজেও টিপটপ ছিমছাম থাকেন আর বাড়ি ঘর, বাড়ির অন্য সদস্যদেরও সেইরকম থাকতে বাধ্য করেন। ঋষভদের বাড়িটা আবার ঠিক উল্টো। পরিবারের তিন সদস্য মানে সে বাবা আর দাদু তিনজনই নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে অভ্যস্ত। ঋষভদের তিনতলা বাড়িটা ভয়ংকর অগোছালো। তৃণা আসার পরেও অবস্থার বিশেষ বদল হয়নি কারণ তৃণা হাসপাতালের ডিউটির পর হাতে বিশেষ সময় পায় না। তাছাড়া ও একটু আহ্লাদি স্বভাবের, হয়তো অত্যন্ত কর্মপটু মায়ের মেয়ে হবার জন্য খানিকটা অলসও। ঋষভদের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির মধ্যে আর একটা বিশাল ফারাক হল খাদ্যাভ্যাসের। ঋষভদের বাড়ির সমস্ত রান্নায় সবসময়ই আমিষের ছোঁয়া থাকে, সেখানে পুণ্যভূমি হওয়ার জন্য হৃষিকেশে মদ-মাংস কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কখনো পুরো নিরামিষ খাবার খায়নি বলে এখানে আসার আগে ঋষভের মনের মধ্যে একটু ভয় ভয় ছিল কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে এসে বুঝতে পেরেছ বাঙালিদের নিরামিষ রান্নাকে কেন লোকে এত তারিফ করে থাকে! শাশুড়ি মায়ের অনেক কিছুই ঋষভের পছন্দ হয় না কিন্তু মনে মনে স্বীকার করে নেয় যে রান্নার ব্যাপারটাকে উনি প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। শীতে সব্জিও ওঠে প্রচুর আর সেইসব সবজি রাতের শিশির মেখে হয়ে ওঠে আরও তাজা, আরও সুস্বাদু। আসার পর থেকে যা যা সুখাদ্য উনি খাওয়াচ্ছেন তাতে ঋষভ বুঝতে পারছে কলকাতায় ফিরেই ওর সমস্ত জামা-কাপড়কে অল্টার করাতে হবে। আস্তে আস্তে এই সুন্দর ছিমছাম ছোট শৈল শহরটির প্রেমে পড়ে যাচ্ছে ঋষভ। হিমালয়ে কয়েকবার বেড়াতে এলেও এইরকম জায়গায় বাড়ির সমস্ত আরাম পেয়ে থাকার অভিজ্ঞতা আগে কখনো ঋষভের হয়নি। এখানে ভোর হয় অনেক দেরিতে, বেলা ন'টা পর্যন্ত চারপাশ কুয়াশায় ঢাকা থাকে। কুয়াশা কাটার পরে মিঠে রোদে লনে পাতা চেয়ারে বসে তৃণাদের গাড়োয়ালি কাজের মাসির হাতে বানানো ঘন দুধ দেওয়া কড়া চা খেতে খেতে অলস ভাবে মেঘে ঢাকা শৃঙ্গের দিকে তাকিয়ে থাকে। দুই একটা পাহাড়ি পাখির ডাক বাগানের ঝোপঝাড়ের আড়ালে থেকে ভেসে আসে। এখানে আবার সন্ধ্যাও নামে তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যাবেলা বন্ধ শার্সির কাঁচ দিয়ে দেখা যায় দূরে ছোট ছোট টিলার উপরে গ্রামে আলো জ্বলে উঠেছে। দূর থেকে মনে হয় পাহাড়ের গায়ে যেন কেউ আলোর মালা পরিয়ে দিয়েছে। কুয়াশা জানলার শার্সির গায়ে জমে গিয়ে জল গড়ায়। রাতে মোটা মোটা শিশিরবিন্দু জলের ফোঁটা হয়ে ছাদের উপর টুপটাপ আওয়াজ করে ঝরে পড়ে। সন্ধ্যাবেলায় ড্রয়িং রুমের ফায়ার প্লেসে কাঠ জ্বলে। সব মিলিয়ে ঋষভের প্রাত্যহিক জীবনের থেকে এতটাই আলাদা যে কেমন একটা ঘোর লাগে। জায়গাটা যতই ভালো লাগুক না কেন এখানে এসেই বউয়ের সঙ্গে প্রথম কথা বন্ধ হওয়ার মতো খারাপ অভিজ্ঞতাটাও ঋষভের হয়ে গেছে। দোষের মধ্যে ও বলেছিল, “তোর মা উনবিংশ শতাব্দীতেই থাকতে পছন্দ করেন নইলে ঘরে হিটার থাকতেও উনি কাঠ জ্বালান কেন?” তৃণা রাগে মুখ লাল করে উত্তর দিয়েছিল, “এখানে এসে থেকে দেখছি তুই 'তোর মা , তোর মা ' করে কথা বলছিস! আমিও যদি' তোর বাবা ' তোর দাদু ' এইভাবে কথা বলি তাহলে তোর কেমন লাগবে?” আমতা-আমতা করে ঋষভ কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে কিন্তু তৃণার রাগ কমাতে পারেনি। সে ঋষভের সঙ্গে কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। এর উপর আবার শ্বশুরমশাইকে দেখে কেমন একটু উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে। এমনিতে ওঁকে ঋষভের খুব হাসিখুশি ভালো মানুষ বলে মনে হয় তাই নিজেই জিজ্ঞেস করেছিল। তৃণার বাবার কথায় জানা গেল ওঁর কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিস্টার উইলিয়াম স্মিথ যিনি দিল্লিতে কোম্পানির রিজিওনাল অফিসের হেড তিনি এখানে আসছেন নিউ ইয়ার ইভে উপস্থিত থেকে কর্মচারীদের উৎসাহিত করতে। “ভালোই তো বাপি। উনি আসলে তোমার কী সমস্যা?” তৃণা বলে উঠল। “না, মানে উনি বলেছেন যে উনি সবাইকে পার্সোনালি নিউ ইয়ারে উইশ করবেন মানে থার্টি ফার্স্ট নাইটে রাত বারোটার সময়!” “তাতে অসুবিধার কী আছে?” ঋষভ সামান্য অবাক গলায় প্রশ্ন করলো। -“আসলে আমাদের ছোট ইউনিটে গ্রুপ এ আর গ্রুপ বি কর্মচারীরাই রিক্রিয়েশন ক্লাবে আসতে পারে। এইরকম কর্মচারী এখানে জনা ত্রিশেকই আছেন। সবাই ফ্যামিলি নিয়েই আসেন। রাত বারোটা পর্যন্ত তাঁদের কীভাবে আটকে রাখব?” “আপনারা এমনিতে প্রতি বছর কিভাবে সেলিব্রেট করেন?” “দেরাদুন থেকে একটা মিউজিক্যাল ব্যান্ড আসে। খানিকটা গান টান হয়। তারপর সবাই খেয়ে দেয়ে ন'টার মধ্যে বাড়ি ফিরে যায়।” “ওই ব্যান্ড সবসময়ই বস্তাপচা, মান্ধাতার আমলের গান গায়। এত শীতের মধ্যে ক্লাবের খোলা লনে বসে কে ওই গান শুনবে?” তৃণা হাসতে হাসতে বলে ওঠে। “বললাম তো আমাদের ফান্ডে টাকা তেমন নেই। দিল্লি হলে রাতভর ড্রিংক পার্টি চলে কিন্তু হৃষিকেশে তো সেটা সম্ভব নয়। তাই তো ভাবছি কিভাবে সাহেবকে এনগেজড রাখব!” “বাইরের থেকে কাউকে আনতে না পারলে নিজেদেরই পারফর্ম করতে হয়। দর্শকদের ইনক্লুড করলে তাঁরা মজা পাবেন আর থেকেও যাবেন।” “সেটা কীভাবে সম্ভব? অন্তাক্ষরী?” “না, না, সাহেব হিন্দি বুঝলেও গানের সঙ্গে রিলেট করতে পারবেন বলে মনে হয় না। আমরা অন্য কিছু করার চেষ্টা করব।” “তাহলে তোমরা দুজনে মিলে সব ঠিক করে ফেলো!” যদিও ওঁর মুখ দেখে মনে হল না যে উনি একটুও আশ্বস্ত হয়েছেন! একত্রিশে ডিসেম্বর ক্লাবের লনকে ভালো করে ঘেরা হয়েছে, উপর থেকে যাতে শিশির না পড়ে তাই উপরে শামিয়ানাও রয়েছে। বিশাল বড় বড় ভ্যাটে কয়লার আগুন জ্বালিয়ে জায়গাটা গরম করার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু সন্ধ্যা হলেই পাহাড় থেকে যে কনকনে উত্তুরে হাওয়াটা বয় তাকে কয়লা জ্বালিয়ে কতটা আটকানো যাবে তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ। ঋষভরা মোটামুটিভাবে ঠিক করেছে দেরাদুনের ব্যান্ডের অনুষ্ঠান শেষ হলে ওরা বড় করে দুই টিকিটের হাউসি খেলবে, তারপর কমবয়সীদের জন্য একটা কুইজ শো আর এমপ্লয়িদের জন্য লাকি কাপল গেম। মাঝখানে খাওয়াদাওয়ার বিরতি। হরিদ্বার থেকে নামকরা হালুইকর আনা হবে থার্টি ফার্স্ট গালা নাইটের জন্য। ঋষভ একটা প্রোজেক্টর আর গুটিয়ে রাখা সাদা স্ক্রিন জোগাড় করেছে কুইজ শো কন্ডাক্ট করার জন্য। কিছু ক্লিপিংস, কিছু মিউজিকের অডিও রেখেছে প্রশ্নোত্তরের জন্য। এইসব করতে গিয়ে বেশ পরিশ্রম হয়েছে ঋষভের কিন্তু একটা ভালো দিকও আছে, প্রোগ্রামের সম্বন্ধে কাজ করতে গিয়ে তৃণার সঙ্গে তার আবার ভাবও হয়ে গিয়েছে। থার্টি ফার্স্ট নাইটের জন্য ঋষভ তৈরি হচ্ছিল। একটা নতুন জ্যাকেট পরেছিল পার্টির জন্য কিন্তু মুকুলিকা দেবী এসে বললেন, “এটা কী পরেছ? অফিসিয়াল পার্টিতে এখানে স্যুট পরাই নিয়ম। বলে একটা থ্রি পিস স্যুট হাতে ধরিয়ে দিলেন। “বাপির স্যুট আমাকে ফিট করবে না!” “সেটা কি আর আমি জানি না! এটা তোমার জন্য বানিয়েছি।” “কিন্তু আমার মাপ কিভাবে পেলেন?” “বিয়ের সময় তোমার স্যুট যে দোকান থেকে বানিয়েছিলাম তিন্নিকে দিয়ে সেই দোকান থেকে মাপ আনিয়ে নিয়েছি। তারপর দিল্লির দোকান থেকে অর্ডার দিয়ে বানিয়েছি।” “আমার বয়সীরা আজকাল আর কেউ থ্রি পিস স্যুট পরে না।” প্রচণ্ড রাগ চেপে শান্ত গলায় ঋষভ বলে। ততোধিক শান্ত, গম্ভীর গলায় উত্তর এল, “এটা তোমার ফ্রেন্ড সার্কেলের নিউ ইয়ার ইভ পার্টি নয়, তোমাদের বাপির অফিসিয়াল পার্টি যাতে মিস্টার স্মিথ আসছেন।” মনের রাগ মনের মধ্যে চেপে থ্রি পিস স্যুটই পরে নেয় ঋষভ। আবারও তৃণার উপরে রাগ হয়, ও প্রথম থেকেই সব জানত কিন্তু কিছু বলেনি। সেই রাগই আবার গলে জল হয়ে যায় পার্টি সেলিব্রেশন নিয়ে ওখানকার লোকেদের উত্তেজনা দেখে। আগে কখনো এইরকম কিছু হয়নি বলে সবার মধ্যে, বিশেষ করে কমবয়সীদের উত্তেজনা প্রায় তুঙ্গে। কয়লা জ্বালিয়ে কনকনে ঠান্ডা উত্তুরে হাওয়াকে কিছুমাত্র কম করা যায়নি কিন্তু মানুষের উত্তেজনা ঠান্ডা হাওয়াকে পরাস্ত করে দিয়েছে। শ্বশুরমশাই মিস্টার স্মিথের সঙ্গে ঋষভের আলাপ করিয়ে দিলেন। মিউজিক ব্যান্ডের গানবাজনা তেমন জমল না কিন্তু কুইজ শো অদ্ভুতভাবে হিট হয়ে গেল। মিস্টার স্মিথ প্রস্তাব দিলেন তিনি চিফ গেস্টের চেয়ারে বসে না থেকে পার্টিসিপ্যান্টদেরকে হিন্টস দেবেন। সেইরকম কিছু কিছু দিলেনও, প্রতিযোগীদের উত্তেজনা তাঁকেও ছুঁয়ে গেল। একটা প্রশ্ন ছিল চায়নাম্যান বল কাকে বলে। কেউ না পারায় তিনি অ্যাকশনটা দেখিয়ে দিলেন। কুইজ শো শেষ হবার পরে মিস্টার স্মিথ বললেন, ঃখুব ভালো লাগছে, বহুদিন এইরকম এনজয় করিনি!” দুই রাউন্ড হাউসির পরে লাকি কাপল ড্র শুরু হল। কাগজে লেখা একই প্রশ্ন উল্টোদিকে মুখ করে থাকা দম্পতিদের লিখতে হবে। দেখা গেল এই খেলায় মহিলারা তাদের স্বামীদের থেকে অনেক ব্যাপারেই বেশি খবরাখবর রাখেন। যে দম্পতির দুজনের উত্তর এক হবে তারা জিতবেন। এই খেলা কন্ডাক্ট করার ভার তৃণা নিয়েছিল। তৃণার বাবা যে চিটটা তুলেছিলেন তাতে প্রশ্ন ছিল, মেয়ের জামাই হিসেবে তুমি কোন প্রফেশনালকে প্রেফার করবে? তৃণার বাবা ডাক্তার লিখলেও তৃণার মা লিখলেন, “মে বি অ্যান অ্যাস্ট্রোনট!” সবাই খুব হাসলেও ঋষভের বুকের মধ্যেটা অপমানে জ্বলছিল। ঋষভের দাদু আর বাবা পারিবারিক হার্ডওয়্যারের ব্যবসায় যুক্ত। অর্থের দিক থেকে অনেক বেশি ধনী হলেও তাদের স্ট্যাটাস কম। হয়তো সেই কারণেই মুকুলিকা দেবীর তাকে পছন্দ হয়নি। সেদিন রাতে শুয়ে ঋষভের ঘুম আসছিল না। হঠাৎ বিড়ালের গলার কান্নার মতো আওয়াজ শুনে দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখে মুকুলিকা দেবীর আদরের বিড়াল বাচ্চা পুচু পিছনের বাগানে একটা আমগাছের মগডালে চড়েছে কিন্তু সরু ডাল খুব দুলছে বলে ভয়ের চোটে নামতে পারছে না। ভয় পেয়ে ম্যাঁও ম্যাঁও করছে আর শাশুড়ি মা রাত পোশাকের উপর শাল জড়িয়ে নিচ থেকে পুচুকে নেমে আসার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। ঋষভকে দেখে কাঁদোকাঁদো মুখে বললেন, “দেখো না পুচুটা ভয় পেয়ে নামতে পারছে না। অতো উঁচু থেকে পড়ে গেলে কি আর বাঁচবে?” “ও নিজে থেকে পারবে না। ওকে ওখান থেকে নামিয়ে আনতে হবে,” বলে তড়তড় করে গাছে উঠে যায় ঋষভ। মুকুলিকা দেবী ভয় পেয়ে চেঁচামেচি শুরু করেন। চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে বাবা মেয়েও উঠে আসে এবং তারাও মুকুলিকা দেবীর সঙ্গে গলা মেলায়। ততক্ষণে ঋষভ প্রায় মগডালের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে কিন্তু তারপরই অসুবিধা শুরু হয়। গাছের এরপরের অংশটা অনেক সরু আর কমজোর। পুচু যেখানে আছে সেখানে ঋষভের হাত পৌঁছোচ্ছে না। তাছাড়া ঋষভকে পুচু তেমন চেনে না বলে আরও উপরে ওঠার চেষ্টা করেছে। ততক্ষণে বাড়ির তিন সদস্য ছাড়া কাজের লোকেদেরও ঘুম ভেঙে গেছে। ঋষভ সবাইকে হই হট্টগোল করতে মানা করে খুব আস্তে আস্তে পুচুকে ডাকছিল। অনেকক্ষণ পরে পুচুর বিশ্বাস জন্মায় যে গাছে থাকা মানুষটা তার ক্ষতি করবে না। তখন সে আস্তে-ধীরে নামতে থাকে কিন্তু নামতে গিয়ে থাবা ফস্কায় আর ঋষভ অদ্ভুত কায়দায় শেষ মুহূর্তে ওকে ধরে ফেলে। পুচুকে নিয়ে নামতে অসুবিধা হচ্ছে বলে নিজের জামার মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়। নিচে নামার পর দেখা গেল পুচু ভয় পেয়ে ঋষভের বুকে এতো জোরে নখ বসিয়েছে যে সেখান থেকে রক্ত পড়ছে। সেদিন বাবা-মেয়েকে স্তম্ভিত করে দিয়ে স্পিরিট দিয়ে ঋষভের বুকের ক্ষত মুছতে মুছতে মুকুলিকা দেবী তাঁর স্বামীকে বলেন, “কখনো ভাবিনি আমাদের তিন্নির পছন্দ এত ভালো হতে পারে! একটা অবোলা জীবের জন্য যার বুকের মধ্যে এতটা মায়া সে নিজের কাছের লোকেদের জন্য সবকিছু করতে পারে। আমি তুমি চেষ্টা করলেও রিশুর চেয়ে ভালো ছেলে তিন্নির জন্য যোগাড় করতে পারতাম না!”
2 Responses
মন ছুঁয়ে গেলো।
খুব সুন্দর গল্প