ওম

চেন্নাই, তামিলনাড়ু


উঠে বসার চেষ্টা করে। পারে না। মাথা অসম্ভব ভারী। অসহ্য ব্যথা। উঠতে পারে না। চারিদিকে অন্ধকার। 
একটা ছোট্ট কাঠের ঘর। বুঝতে পারে না এখানে তাকে কে নিয়ে এসেছে? মনে আছে, সকালবেলা আর মাত্র ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ওরা পৌঁছে যাবে ওদের লক্ষ্যে। আবহাওয়া বেশ ভালো। লক্ষ্য জয়ের পক্ষে আর কোনোই বাধা নেই। ঠিক সে সময়, হঠাৎ পায়ের নিচটা দুলতে শুরু করল, মনে হল কী একটা যেন সরে গেল পায়ের নিচ থেকে। তারপর বরফের চাঙড়ের সঙ্গে গড়িয়ে চলেছে তো চলেইছে।  
সে কি তাহলে মারা গেছে? এভালাঞ্চের কবলে পড়লে প্রায় কেউই বাঁচে না। কিন্তু বাকিরা কোথায়? ওর আরো দুই সঙ্গী, সেই মালবাহক ছেলেটা? তাহলে তারা কি বেঁচে গেল? যাক্‌। কেউ তো বেঁচে ফিরেছে। 
এই ট্রেকে আসবার আগে মা অনেকবার মানা করেছিল। বলেছিল, “আমি ঘরপোড়া গরু প্রকাশ। আমার বড় ভয় লাগে!” মা কে কি কেউ খবর দিয়েছে যে, সে নেই? নিজের মৃত্যুশোকে দুই চোখ থেকে গড়িয়ে নামে, গরম গরম ফোঁটা। 
মুখ দিয়ে একটা গোঙানির আওয়াজ বের হয় সম্ভবত, ঘরের দরজাটা ফাঁক হয়ে যায়। কেউ একজন আসে। ঝুঁকে ওকে দেখে। বাইরে গিয়ে আবার কাউকে ডেকে আনে। বাটি করে কিছু একটা মুখে ঢেলে দেয়। কিছু বলে, যার কিছুই ও বুঝতে পারে না। 

সারা বাড়ি গমগম করে উঠেছে উলু আর শাঁখের আওয়াজে। 
বাড়ির সামনে নতুন মাটির ঘটে ডাব। কলাগাছ। সিঁদুরের ফোঁটা। বাড়ি নয়, গোটা পাড়াটাই কেঁপে কেঁপে উঠছে চ্যাটার্জি বাড়ির উলুধ্বনি আর তার সঙ্গে মিশ্রিত সবার হা হা হা হাসির লহরিতে।
“এত আওয়াজ কীসের? প্রকাশ এল বুঝি? কোথায় চলে গেছিল? এখনই ওকে আমার কাছে আসতে বল মায়া!”
মায়া বুঝে উঠতে পারে না কী বলবে। প্রকাশ দিদি পাহাড়ে গিয়েছিল সেই ক-ত দি-ন আগে। ফেরেনি। ওখানেই নাকি বরফে পা পিছলে…।
খবরটা বাড়িতে এসেছিল, ওদের ক্লাবের থেকে। কাকিমাও জেনেছিল। প্রথম কদিন পাথরের মত হয়ে থাকল, পরে বলল আমি বিশ্বাস করি না প্রকাশ নেই। ও ফিরবেই। ও আমাকে কথা দিয়ে গেছে ও ফিরবেই।  
গরমে গেছিল। গরম পেরিয়ে শীতও চলে গেল। আবার গরম আসছে। প্রকাশ দিদি ফিরে এল না।  
“কী রে মায়া শুনতে পাস না? বলছি যে প্রকাশকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দে।”
“কাকিমা এত চিৎকার কোরো না। তুমি শান্ত হয়ে বসো।” 
“আমি শান্ত হয়ে বসব? এতদিন পর প্রকাশ ফিরে এসেছে আর আমি চিৎকার করব না?”
“শুনছো? শুনছো তুমি? ওরা কী বলছে?”
যাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলা, ভ্রূক্ষেপহীন সেই লোকটা হাসতেই থাকে টেবিলের ওপর ফটো ফ্রেম থেকে। 
“কাকিমা এভাবে চিৎকার কোরো না!”
মায়াকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যায় সুমনা।
“ প্রকাশ এসেছে? প্রকাশ? তোরা উলু দে। আরো জোরে শাঁখ বাজা। আমি জানতাম ও ফিরে আসবেই!”
“সুমনা ঘরে চল। প্রকাশ আসেনি। সে কি আর আসবে?”
“আসেনি? তাহলে এত আওয়াজ কেন? এত হৈ হৈ কেন?”
“আজ যে ঋকের ছেলের মুখেভাত!”
“মুখেভাত! ও!” 
“ঋক, তোমাদের কিন্তু এনাকে ঘরে বন্ধ করে রাখা উচিত!”
অহনার মায়ের কথাতে সায় দেন অহনার বাবাও। 
 “বন্ধ করো আওয়াজ।!”কানে দু হাত চাপা দিয়ে আবার চিৎকার করে সুমনা।  
মায়াকে বলে, “রোদ্দুর উঠেছে রোদ্দুর?” 
“হ্যাঁ। বাইরে খুব রোদ্দুর উঠেছে গো কাকিমা। তুমি বসবে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে? জানলাটা খুলে দিই?”
“সব বরফ গলে যাবে রোদ্দুরে!”
“কাকিমা কী সব বলছ?” মায়া ঝাঁকায় সুমনাকে।
“রোদ্দুর চাই রোদ্দুর। সব বরফ গলিয়ে দিতে হবে। অনেক রোদ্দুর চাই!”
“এত চিৎকার চেঁচামেচি কিসের?” ছুটে আসে ঋক। পিছনেই তার বৌ অহনা।  
“শঙ্খ আর উলু শুনলেই কীরকম যেন করছে ছোট কাকি!” ঋককে বলে মায়া।  
“তোরা সামলাতে পারিস না তো তোদের রেখে লাভ কী?” 
মায়া চুপ করে থাকে।
“আর এখন কিরকম করে কী হবে! যখন মানা করেছিলাম শুনেছিল কেউ আমার কথা? মেয়ে পর্বতারোহী হবে। কত বার মানা করেছি। তখন এসব ভাবনা কোথায় ছিল?”
“সে তো কাকিমা মানাই করতো গো। মেয়ে কী শুনল বলো?”
“শোনাতে জানতে হয়। এখন দেখ গিয়ে সে কোথায় বরফে জমে শক্ত হয়ে আছে!”
“কী বললি? প্রকাশ জমে বরফ হয়ে গেছে?” ঘর থেকে বেরিয়ে ঠাস ঠাস করে ঋকের দুই গালে থাপ্পড় মারতে থাকে সুমনা।  
অতর্কিত আক্রমণে হতভম্ব হয়ে যায় ঋক। তার পিছনে অহনা। এতদিনের মধ্যে সুমনাকে এরকম আক্রমণ করতে কেউ দেখেনি। আর আজ বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে, মুখ লাল হয়ে যায় তার। দু হাতে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা দেয় সে সুমনাকে। 
“ঋক!” চিৎকার করে ওঠেন ঋকের মা।
মায়া ধরে ফেলে সুমনাকে।
সুমনা একেবারে শান্ত মেয়ের মত মায়ার কোলের মধ্যে ঢুকে পড়েন।   
“তোমার কাকাও শুনলাম ট্রেকিংয়ে গিয়ে আর ফেরেননি?”
“হুম!”
“সে সময়ও লোকে ট্রেকিং করত এটাই আমি জানতাম না। তা তোমার কাকি আজ হঠাৎ এরকম ভায়োলেন্ট হয়ে গেলেন কেন?”
শ্বশুরমশাই ধারে ভারে দুদিকেই যথেষ্ট বেশি ক্ষমতাশালী। ওনাদের কাছে ট্রেকিং একটা শব্দ। খবরের কাগজে মাঝে মাঝে আসে।
“ঋক ভুলে যাস না কাকির শরীর খুব খারাপ। কাকা আগে, এবার মেয়েটা। সবই তো জানিস বাবা!” মায়ের কথা শুনে ঋকের মনে পড়ে যায় ভাত মেখে কাকের ডিম বকের ডিম করে ওকে আর প্রকাশকে এক থালা থেকে কাকিমার খাইয়ে দিত! 
“ঋক তোমার কাকিমার চেঁচামেচি থামল?” শ্বশুরমশাইয়ের সুরে সুর মেলাতে হাজির হয়ে গেছেন শাশুড়ি মা আর অহনা। 
“দাঁড়াও মা দাঁড়াও। দেখ, ও আর আজকে থামবে না। পুরো দিনটা নষ্ট করে উনি থামবেন। মহিলাকে দেখছি তো অনেকদিন হল। আর তোমাকে বলছি ঋক, উনি কিন্তু দিনে দিনে ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছেন। কিছু একটা করো!”
অহনার মা বাবা জানেন তাঁদের মেয়ে খুব ভালো করে জানে, ঠিক জায়গায় আঘাত করে কাজ কিভাবে হাসিল করতে হয় দরকার হলে দগদগে ঘা জিইয়ে রেখে হলেও। সেটা তাকে কারুর শিখিয়ে দিতে হয় না। রূপখানাও নেহাৎ ফেলে দেবার মত নয় তাঁদের মেয়ের। তাঁদের ফার্মের অজস্র ট্রেনির মধ্যে থেকে ঋককে বেছে বঁড়শিতে গাঁথার পুরো কৃতিত্বটাই মেয়ের। 
পায়ের ওপর পা তুলে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসেন মিঃ মুখার্জি। অহনার বাবা। মৃদু হেসে পাশে গিয়ে বসেন মিসেস মুখার্জিও।   
কাকা ট্রেকিংয়ে গিয়ে হারিয়ে গেল, তাই মেয়েটাকে কেউ কিছুই বলে না বাড়িতে। মেয়েও যা খুশি করে বেড়াচ্ছে। কেউ কিছু বললেই শোনে না। এই চলে গেল বস্তির বাচ্চাদের পড়াতে। তাদের বাড়িতে জায়গা নেই তো নিয়ে চলে এল ঘরে। কোথায় কাকে কাকে গিয়ে রাত বেরাতে ওষুধ বিলিয়ে আসছে। হঠাৎ হঠাৎ তাকে পাহাড় ডাকছে। কোনটাই স্বাভাবিক নয়। 
স্বভাবে একেবারেই কাকার মতন হয়েছে মেয়েটা। কিন্তু ছেলেদের যা মানায় মেয়েদের কি সেটা মানায়!
অহনা আবার পাশে এসে বসে। বলে, “আজ যা হোল এরপর তুমি আর দয়া করে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে বসো না যেন। কিছু একটা ব্যবস্থা নাও। শান্তভাবে ভেবে সিদ্ধান্ত নিলে, সেটা কাজে দেবে। নাহলে কোনদিন হয়ত আমাদের বাবুকেই উনি...!”
“না!” চিৎকার করে ওঠে ঋক।
“উত্তেজিত হয়ে কোনো লাভ নেই। উনি প্রকৃতিস্থ নন। বাস্তবটা ভাবো।” অহনা জানে আঘাতটা সঠিক জায়গায় লেগেছে।
অহনার হিসহিসে কথাগুলো, ঋকের আবেগের বাষ্পকে শান্ত করে দেয়। মনে পড়ে যায় নিজের অবস্থান। হাতটা অজান্তেই চলে যায় গালের থাপ্পড়ের জায়গায়। সেখানে এখনও লাল দাগ আর জ্বালা। 
এবার কিছু একটা সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হবে। ভুল সিদ্ধান্ত আর ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট দুটোকেই মনে মনে ঘেন্না করে ঋক। না করলে ওপরে ওঠা যায় না।
সাতাশ বছরেই সিএ, কস্ট, এল, এল,বি। নামি কর্পোরেটের মোটা মাইনের ল কনসালটেন্ট ঋক চ্যাটার্জি। মুখার্জি এন্ড মুখার্জি অডিটার’স এর মিঃ দেব মুখার্জির মেয়েকে বিয়ে। জীবনটা তার ছকে বাঁধা। তারই ছেলের অন্নপ্রাশনের দিনে কিনা কাকি...!   
না। সকলের সামনে তার গালে থাপ্পড় মারাটাকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। মাকে বলতেই হবে এটা। এভাবে চলে না। 
মনে মনে এগুলোই ভাবতে ভাবতে চারিদিকের কাজকর্ম দেখতে থাকে ঋক। 
এখন যে পাহাড়ে গিয়ে এভালাঞ্চে পড়লি...মরলি...। এখন তোর মায়ের এই পাগলামো সামলাবে কে? আমি কেন? আমার কী দায় পড়েছে?
পাহাড়ি এই গ্রামের ভাষা ও বুঝতে পারে না। কিন্তু ওদের যত্ন আর চিকিৎসায় ধীরে খুব ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে সে। আজকাল মাঝে মধ্যে বাইরে এসে বসে। একটু আধটু হাঁটতেও পারে। এরা ওকে বাঁচিয়েছিল। বডি ল্যাঙ্গোয়েজে যেটুকু বোঝাতে পারে। কিন্তু এখান থেকে বাইরের পৃথিবীতে যাবার রাস্তার সন্ধান কী করে করবে সেটা প্রকাশ বুঝতে পারে না। কেমন আছে বাড়িতে সবাই! মা জেঠি দাদা বৌদি কে জানে? আরেকটা ছোট্ট মানুষ এত দিনে এসে গেছে নিশ্চয়। সে কিছুতেই বুঝতে পারে না ঠিক কতদিন হয়েছে সে এখানে আছে। বাড়িতে মায়ের কী অবস্থা তাও বুঝতে পারে না। বরফ পড়ছে। বৃদ্ধা তাকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে আসেন। একটা পাথরের বড় পাত্রে কাঠের আগুন জ্বলে সারারাত।  
পাঁচ বছর পর অহনা আর ঋকের প্রথম সন্তান এসেছে। অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে তাই কোনো কার্পন্য করেনি ঋক। ক্যাটারিংয়ের দায়িত্ব দিয়েছে বিজলি গ্রিল কে। বাড়ির সামনেই গোলপার্কের মুখের সোমনাথ হলে অন্নপ্রাশন। থিম ঠিক করে হল সাজিয়ে দিয়েছে ওর চেনা ইভেন্ট ম্যানেজার।
অজস্র বড় ক্লায়েন্ট আসবেন আজকের সন্ধ্যায়। ঋক পার্টিতে যায়। ছোটখাটো পার্টি দেয় ও; কিন্তু স্পেশাল অকেশনে ডাকবার কোনো সুযোগ পাচ্ছিল না এতদিন। ক্লায়েন্টরা অনেকেই হয়ত আজ বাড়িতেও আসতে চাইবেন। 
আজকেই কাকিমার হঠাৎ ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠাটা, কিছুতেই মেলাতে পারে না সে। তাহলে সত্যিই কাকিমা বুঝেশুনেই ওদের আনন্দগুলো পন্ড করতে চায়। নিজের মেয়ের হারিয়ে যাওয়াটাকে এভাবেই জিইয়ে রাখতে চায়।
অহনার যে কথাগুলো কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না ও কোনোদিন, আজকের ঘটনার পর সবকিছু কিরকম বলে দিচ্ছে অহনাই ঠিক। 
“কী হল কিছু ভাবলে?”
“এত তাড়াতাড়ি?”
“তাড়াতাড়ি! তাহলে একটা সর্বনাশ না হলে তুমি কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না তাই তো?”
“অহনা!”
“থামো। চোখ রাঙিয়ো না। সবাই সব দেখতে পাচ্ছে। আমাকে উনি কোনোদিনই সহ্য করতে পারেন না সেটা আমি আগেই লক্ষ করেছি। এখন আমার ছেলে। আমি কালকেই মা বাবার কাছে চলে যাব। তুমি থাকো তোমার আদর্শ নিয়ে!”
ঋক বলতে পারে না, ‘এত নিষ্ঠুর হোয়ো না অহনা। প্রকাশকে আর আমাকে কোনোদিনই কাকিমা আলাদা চোখে দেখেনি। প্রকাশের জন্য যাই আসুক জোড়া একখানা আমার জন্যও আসত। সেই মেয়েটা কাকিমার একমাত্র সন্তান, পাহাড়ে গিয়ে হারিয়ে গেল ওর বাবার মতন!’ বরঞ্চ ঋকের মনে হয় অহনাই ঠিক। একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। নাহলে একটা ক্ষতি করে ফেলবেই কাকিমা। তাই তার আগেই, ঋক ফোন করে ওর বন্ধু ডঃ গৌতম সিকদারকে। গড়িয়াতে ওনার হোমে কাকিমাকে শিফট করবার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলে। অহনাকে সুসংবাদ দেয়। 
“খরচ তুমি দেবে কেন? তোমার কাকিমার পেনশনটা তো পড়েই থাকে। ওটা কবে কাজে আসবে?”
“সুমনা কিছু খেয়েছে মায়া?”
“না গো কাকিমা। ছোট কাকি খাচ্ছেই না কিছু!” 
“কিছু খাইয়ে দে, কাল থেকে বাড়ি ভর্তি লোকজন দেখে বেচারি ভয় পেয়ে গেছে। নাহলে ও তো কোনোদিন এত চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে না!”
“ঠিক আছে আবার চেষ্টা করে দেখি।” মায়া খাবার আনতে যায়। তিনি নিজে ছোট জায়ের পাশে গিয়ে বসেন।
“মা!”
“আয় ঋক। দেখ কাকি আজ কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। কাল তোকে মেরে ও খুব কেঁদেছে জানিস!”
“তোমাকে একটা জরুরি কথা জানাতেই এলাম মা। কাকিকে গৌতমের মানসিক হোমে পাঠাবার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি আমি। আজ বিকেলেই ওরা এসে নিয়ে যাবে!”
“মানসিক হোম! আজ বিকেলেই! কি বলছিস তুই...!”
“কেন কাল কী হয়েছে তুমি দেখোনি? এর বেশি কিছু হলে তখন ভাবব বলছো?”
অপ্রয়োজনীয় একটা কথাও না বাড়িয়ে ঋক আর তার পিছন পিছন অহনা চলে যায় ওদের ঘরের দিকে। আয়ার কোলে বাচ্চাটা হঠাৎ তারস্বরে কেঁদে ওঠে।
ঋকের মায়ের মনে হয় বাইরের ঠান্ডা কি হঠাৎ খুব বেড়ে গেছে! হাড়েও কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে যেন। কলকাতায় আগেও এত ঠান্ডা পড়ত কি?   
সুমনা বলে ওঠে, “শীত! খুব শীত। প্রকাশ আর ঋককে গরম জামা পরিয়ে দে!” 
মায়া গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। জ্বর তো নেই। এত শীত বলছে কেন কাকিমা?
চোখটা কেন যেন জ্বালা করে আসে মায়ার।
প্রকাশের যখন ছ বছর, সেই তখন প্রকাশকে দেখে রাখতে ঢুকেছিল। মা অফিস গেলে বাচ্চাটার দেখ ভালের দায়িত্ব ওর হাতেই ছিল। ঋককেও খাইয়ে দিত সে। দুজন একসঙ্গে বেড়ে উঠল কিন্তু মনের দিক থেকে দুপ্রান্তে যেন। ঋক দাদা শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত চিরকাল আর প্রকাশ দিদি কারুর কষ্ট দেখতে পারে না। ভগবান এমন মানুষকেই কেন নিয়ে নেয়!
“বরফ পড়ছে। বরফ। ওর ঠান্ডা লাগবে!” কুঁকড়ে পাশ ফিরে শোয় সুমনা।
মায়া খাবার আনতে গিয়ে শুনতে পায় দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ঋক দাদার বৌকে তার মা শেখাচ্ছে, “শোন তোর শাশুড়িকে বলে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে হলেও এক বেলা পাগলিকে চুপ করাতে বল। ওবেলাই তো শুনলাম পাগলিকে নিয়ে যাবে!”
কোলের কাছে টেনে বাচ্চা মেয়ের মত খাইয়ে দেয় মায়া মানুষটাকে। ভাতের সঙ্গে মেখে একটা ঘুমের ওষুধও দেয় খাইয়ে। ঘুমোক একটা বেলা। 
অনেকটা রাস্তা হেঁটে। বাকি পথ মিলিটারি ট্রাকে এসে ওকে ট্রেনে বসিয়ে দেয় ওই মানুষগুলো। বুড়ির ছেলে এসেছে, সঙ্গে বুড়িও। ট্রেনে বসিয়ে মুখে মাথায় হাত বুলায় বুড়ি। একটা কৌটো বের করে দেয় কোঁচড় থেকে। আরেকটা কোঁচড় থেকে দোমড়ানো মোচড়ানো কয়েকটা টাকা। নিজের উলের স্কার্ফটা খুলে প্রকাশের মাথায় জড়িয়ে কী কী  সব বলে যায় কুঁচকানো মুখে। জড়িয়ে ধরে বুড়িকে প্রকাশ।
প্রকাশ ভাবে, শহরে এমন হলে কী  করতো সে? খুব জোর হাসপাতালে ভর্তি করে কর্তব্য সারতো। ভাবত বাকিটা পুলিশের কাজ। হাসপাতালের দায়িত্ব।
বুক ভর্তি রোদ্দুর দিয়ে পাহাড়ি মুখিয়া ওর যত্ন করে, সুস্থ করে ওকে ফিরিয়ে দিয়ে গেল ওর নিজের জায়গায়। পাখির ছানার মত বুকের ওম দিয়ে সে রক্ষা করলো প্রকাশকে।
চারিদিকে বরফ জমা ওই গ্রামের রাস্তা হাজারো বাঁকের মধ্যে দিয়ে আসতে আসতে প্রকাশ হারিয়ে ফেলেছে ওই গ্রামের রাস্তা। আর কোনোদিনও ফিরে আসা হবে না সে জানে। পাহাড়ের দেবতারা এভাবেই পাহাড়ে লুকিয়ে থাকুক। লুকিয়ে থাক সভ্য দুনিয়ার বিষাক্ত হাওয়ার থেকে! অত উঁচুতে বোধহয় শহুরে বিষ পৌঁছায় না ভাগ্যিস।
হয়তো ওর মতো আরো কোনো প্রকাশের দরকারে ওরা ঠিক এগিয়ে আসবে আবার। 
জেনারেলের ডাব্বায় কুঁকড়ে বসে, জল ভর্তি চোখে দেখে পাহাড়িরা মিলিয়ে যাচ্ছে ট্রেনের পাশ থেকে। ট্রেনের স্পিড বাড়ছে। সে চলেছে নিজের শহরের দিকে। বাতাসে ডানা দোলাচ্ছে চেরি ফুল। সে ফিরছে ঠিক যেদিকে ফিরতে চেয়েছিল সে।

বৈশাখী ২০২৪