ওম

ইস্ট ব্রানসউইক, নিউ জার্সি


গায়ে চাদরটা ভালো করে জড়ায় সুমিত্রা। নাহ, মনে হচ্ছে মোজাজোড়াটাও পরতে হবে। গা শিরশির ভাবটা যেন যাচ্ছেই না, যেতে চায়ই না আজকাল।

দিনগুলো ছোট হয়েছে, সন্ধে পড়ছে ঝুপ করে। পুজো, তার ঢাক, তার মাইক, তার ভিড়, তার বিসর্জন, তার জলসা - সব নিয়ে শহরটাকে মাতিয়ে রেখেছিল। সেও হয়ে গেল বেশ কিছুদিন। এমনিতেই তার বাড়িটা একটু একটেরে, লোকজনের চলাচল একটু কমই এই দিকটায়  । প্রথম প্রথম সে নালিশও জানাত বারবার, কী এক ভূতের বাড়ী কিনলে, চারদিকে লোকজন নেই। প্রণব হাসত, “কী সুন্দর নিরিবিলি, এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায়...।” সে বলত, “যত্তসব!”

কিন্তু... এত ঠাণ্ডা লাগত না তো তখন! শীত করার যেন সময়ই হত না, ঠাণ্ডা পড়েছে বলে কম্বলের তলায় ঢুকে বসে থাকা - ও বাবা, সে যেন এক বিলাসিতা। প্রণব চাকরি ছেড়ে নিজের ব্যবসা দাঁড় করাতে দিনরাত এক করে খাটত , সাতসকালে কোনরকমে মুখে দুটো গুঁজে বেরোত, ফিরতে ফিরতে সন্ধে পেরিয়ে রাত। শ্বশুরমশাইএর হাঁপানি, শাশুড়িমায়ের বাত, রাজা রিংকুর পড়াশোনা, গানের ক্লাস, কোচিং, দুই ননদের পালা করে বাপের বাড়ী আগমন এবং টানা বসবাস, লোকলৌকিকতা...একা হাতে সামলাতে হত সুমিত্রাকেই।  শাড়ির ওপর গায়ে একটা পাতলা সুতির চাদর, পায়ে চটি - এতেই যথেষ্ট, সে এইভাবেই ছুটে বেড়াত সারা শীতকাল। ব্যস্ততার চাপ নাকি যৌবনের তাপ কে জানে! ঠাণ্ডা তার কাছ ঘেঁষতে পেত না।

আস্তে আস্তে ব্যস্ততা কমে। প্রথমে শ্বশুরমশাই, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শাশুড়িমা চলে যান। ননদদেরও আসা যাওয়া কমে। রাজা রিংকু চায় না মা আর সঙ্গে করে নিয়ে কোথাও যাক। “যথেষ্ট বড় হয়ে গেছি মা, আমি একা যেতে পারব, আর কারো মাকে দেখেছ পিছন পিছন কোচিং ক্লাসে যেতে!” আর তারপর তো তাদের চাকরি, বিয়ে, দূরে থিতু হওয়া, মাঝে মাঝে এসে পড়া, হাসি গল্পে আবার ঘর ভরে ওঠা। ওই কয়েকদিনের হৈ হৈ টুকু বাদে এত বড় বাড়ীতে শুধু প্রণব আর সুমিত্রা। কিন্তু কই, তখনো তো এমন...

যেদিন রাতে প্রণবের বুকে ব্যথা উঠল, ফোন করে ডাক্তার ডাকা, পাড়ার লোক ডাকা, বুকে মালিশ, মুখে জল - সব একাই করল সুমিত্রা। কিন্তু কেউ এসে পৌঁছনোর আগেই সব শেষ। নয়ডাতে রিংকু ফোন ধরে বিশ্বাসই করছে না, বারবার বলছে, “কী বলছ মা! সন্ধেবেলাও তো কথা হল!” হতভম্ব জামাই সিদ্ধার্থও। বেঙ্গালুরুতে রাজা আফসোসে মাথা ঝাঁকায়, চুলের মুঠি খামচে ধরে, “কিচ্ছু করতে পারলাম না... কিচ্ছু না... সময় পেলাম না।”  তাকে সামলাতে নাজেহাল হয়ে যায় বউ মৌসুমী। 
শুধু প্রণবের পুরোনো বন্ধু সমর বলে, “আহা, এমন যাওয়া! আমরা সবাই যেন এমন করে যেতে পারি।”

সুমিত্রার ফাঁকা বাড়ী আবার সাময়িক জমজমাট। মেয়ে-জামাই-ছেলে-বৌমা, কাছে দূরের আত্মীয়কুটুম, প্রতিবেশী, কর্মচারী, পুরোনো সহপাঠী। আচার অনুষ্ঠান । নিয়ম পালন এবং নিয়মভঙ্গ। কী করলে কী হত, কার কার চেনা মানুষের এমন হয়েছে এবং তৎক্ষণাৎ কী কী ব্যবস্থা নেওয়াতে সেই মানুষ বেঁচে গেছে এমন আলোচনা চলে, সুমিত্রার দিকে তেরছা চোখে তাকিয়ে। রিংকু বলে, “ওসবে কান দিও না তো মা! ডাক্তারবাবু তো বললেনই কিছু করার ছিল না।” কার ছেলে প্রায় কাঁধে করে মৃতপ্রায় বাবাকে ঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে তার প্রাণ বাঁচিয়েছে - এই আলোচনাও চলে, রাজার দিকে তেরছা চোখে তাকিয়ে। সুমিত্রা তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করে, “তুই পাশে থাকলেও কিছু করতে পারতি না বাবা। মন খারাপ করিস না।” 

ঘর একটু ফাঁকা হলে, বাইরের লোকজন চলে গেলে রাজা রিংকু মৌসুমী সিদ্ধার্থ তাকে জোর করে এনে চেয়ারে বসায়। “ঘরদোর পরে গোছাবে ...আগে একটু শান্ত হয়ে কথা শোনো তো মা!” তাদের দিকে তাকিয়ে বোঝে সুমিত্রা, নিজেদের মধ্যে আগেই কথা হয়ে গেছে। 

“তোমার একা এখানে থাকা চলবে না মা। অনেকদিন ধরেই বলছি, দুজনকেই বলেছি, তোমরা শোনোনি, এখন একা হয়ে গেলে, এখন আর কোনো কথা শুনব না, আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। কমলা মাসীর কাছে চাবি থাকবে, মাঝে মাঝে বাড়ী ঝাড়ামোছা করে দেবে। এখন তুমি কার কাছে আগে যাবে বল। সেই মত টিকিট কাটব।” 

রাজা রিংকু একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে, সিদ্ধার্থ ল্যাপটপ হাতে টিকিট কাটতে তৈরী, মৌসুমী উঠে সুমিত্রার ব্যাগ গোছাতে শুরু করে দেয়। 

সুমিত্রা আস্তে আস্তে বলে, “আমি এখন এখানেই থাকব রে বাবা। মাঝে মাঝে তোদের কাছে যাব নিশ্চয়ই, হয়তো আরো বুড়ো বয়সে পাকাপাকি গিয়েই থাকব, কিন্তু এখনই নয়। এখনো তো সচল আছি, এখনই দরকার নেই রে তোদের বাবার এতো শখের বাড়িটা ফাঁকা করার।”

ওদের শত অনুরোধেও মত পাল্টায় না সুমিত্রার। রিংকু কাঁদো কাঁদো। রাজার মুখ গম্ভীর, চোয়াল শক্ত। প্রচণ্ড অভিমানী ছেলেটা। সেদিকে তাকিয়ে মৌসুমী বলে, “তোমাকে এই অবস্থায় একলা রেখে ফিরে যাব... লোকে কিন্তু আমাকেই দোষ দেবে মা।” 
“না রে মা! আমি তো জানি, তুমি মন থেকে বলছ, তোমরা সবাই মন থেকে বলছ। আমাকে শুধু একটু সময় দাও তোমরা, একটু মনটাকে গুছিয়ে নিই।”
সিদ্ধার্থ রাজার কাঁধে হাত রাখে, “ঠিক কথা রাজাদা, মাকে একটু সময় দিই আমরা।”

দুয়েকদিন আগে পরে ফিরে যায় ওরা সবাই। ওদের মুখগুলো ভার। সুমিত্রার একবার মনে হয়, ভুল করলাম না তো! চলে গেলেই ভাল হত... নাকি!

সেই দিন সন্ধে থেকেই বোধহয় তার ঠাণ্ডা লাগাটা শুরু হয়। অন্ধকার হতে না হতেই গায়ে সোয়েটার ওঠে, ঘরের  জানলাদরজাগুলো বন্ধ হয়, ধপাস করে টিভির সামনে বসে পড়ে সুমিত্রা। বসে পড়ে, বসেই থাকে। কত বিয়ে ভাঙতে ভাঙতে জুড়ে যায়, কত শাশুড়ি অভুক্ত বউয়ের খাবার নর্দমায় ফেলে দেয়, কত শহরের ছেলে গ্রামে গিয়েই প্রেমে পড়ে যায়, কত হারানো ছেলে গোঁফ দাড়ি চশমা লাগিয়ে ফিরে আসে, নিজের মা তাকে চিনতে পারে না... সুমিত্রা বসেই থাকে... বসেই থাকে। রোজ সন্ধ্যায়। প্রণবকে ঠিক সময়ে খেতে দেওয়ার, ওষুধ দেওয়ার একটা ব্যাপার ছিল আগে, সে সবও ঘুচেছে, সুমিত্রার নিজেরও উঠে খেতে যেতে ইচ্ছা করে না আর। আবার ওঠো, খাবার গরম কর... থালা বাসন নামাও... ও হবে এখন। আর, ওঠা মানেই তো আবার কাঁপুনি দেওয়া! ওরে বাবা!

রাজা রিংকুতে কথা হয়। ফোন করে তারা সব সময়েই টিভির সামনে বসা মাকে পায়। ভিডিও কলে দেখে, মাথায় স্কার্ফ জড়ানো কেমন যেন এক জবুথবু মা। রিংকু বলে, “কত কী চাপিয়েছ! ওখানে এখন কত টেম্পারেচার মা?”  সুমিত্রা বলে , “বড়ো শীত পড়েছে রে এবার!”  
রাজা বলে, “গাড়ি ঠিক করে দিচ্ছি, বড় মাসীর বাড়ী, মামার বাড়ী একদিন ঘুরে এস মা।” “না রে বাবা ...আমার এখন নড়তে ইচ্ছা করছে না!”  
এই  অলস, হাত পা ছেড়ে দেওয়া মাকে তারা চেনে না। দুশ্চিন্তা হয়, কিন্তু এখুনি আরেকবার তাদের আসা ঠিক সম্ভব হয়ে ওঠে  না। অস্বস্তি লেগেই থাকে।

সেদিনও একইভাবে টিভির সামনে বসে আছে সুমিত্রা, সেখানে একটি অনাথ কচি শিশু কেঁদেই যাচ্ছে কেঁদেই যাচ্ছে... সুমিত্রার মাথার মধ্যে শিশুর কান্নাটা গিয়ে কেমন যেন আঘাত করতে থাকে, কেমন যেন অসহ্য লাগে তার। হঠাৎ মনে হয়, ঠিক ঘরের বাইরে থেকে যেন আসছে শব্দটা। সে ভাবে, একা ঘরে পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছি নাকি! টিভিতে কেউ একজন বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়। কিন্তু কই, ঘরের বাইরের ওই আওয়াজ তো থামল না! শিশুর কান্না ঠিক নয়, তবু কেমন একটা করুণ সুর যেন বাইরে ডাকতে থাকে তাকে।
আস্তে আস্তে সোফা থেকে নেমে গায়ে মাথায় ভালো করে চাদরটা জড়িয়ে বারান্দার দরজাটা খুলতেই... ও মা, তুই কোথা থেকে এলি রে! ইস, আহা রে, এই শীতের রাতে! কে ছেড়ে দিয়ে গেল এমন করে? ছি ছি ছি!

“হ্যাঁ... কে... মৌসুমী... হ্যাঁ... কেমন আছ তোমরা... হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ঠিক আছি... এই রে... এই এই... আবার ঘরের মেঝের ওপর... বার বার বারণ করলাম... ও মৌ, আমি একটু পরে কল করছি, কেমন? ইস, দেখ তো...”

" রিংকু... হ্যাঁ, ঠিক আছি, তোর পরীক্ষার খাতা দেখা  শেষ হল? যাক, এবার একটু দম নিতে পারবি... ইস, দেখ দেখ, ছিঁড়ে ফেলল সব, কোনো কান্ডজ্ঞান নেই... না না... তুই না... তুই কেন পরীক্ষার খাতা ছিঁড়বি.... তা বলিনি... কী কান্ড... আমি এখন রাখি...”

“রাজা, তোর দশটা মিসড কল দেখলাম... সরি রে বাবা, ফোনটা আসলে খুঁজে পাচ্ছিলাম না, শেষে রান্নাঘরে সিলিন্ডারের পিছনে... না না, আমি ভুলো হয়ে যাচ্ছি না, ফোনটা আসলে... ওই দেখো, এইবার আমার চটি... গেল... এবার সারা বাড়ি চটি খুঁজে বেড়াই... আমি রাখি রে বাবা... চটিটা যে কোথায় আবার...”

বেঙ্গালুরুতে নয়ডাতে ফোন অতি সচল হয়ে ওঠে। মায়ের কি মানসিক কোনো রকম...!  এবারে একটা কনফারেন্স কল হোক, এই ঠিক হয়। 

চারবার বেজে বেজে কেটে যাওয়ার পর ওরা যখন পাশের বাড়ীতে ফোন করতে যাচ্ছে প্রায়, সিদ্ধার্থ আরেকবার চেষ্টা করে। এবার ফোন ধরে সুমিত্রা। 
“ওহ, সিদ্ধার্থ... হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা... ধরতে পারিনি ফোনটা আগে... খাটের তলায় ঢুকেছিলাম তো... আজকাল হাঁটুতে কোমরে লাগে... কেমন আছ...”

“খাটের তলায়! কেন!  কী করতে! কোনো মানে হয়! আজ দেখলাম ওখানে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। তোমার চাদর টাদর কোথায়... ওই একটা ব্লাউজ সোয়েটারে... ওতে কি আর হয়... কী করছ বল তো তুমি মা! " 

রিংকুর ঝড়ের গতিতে করা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই  একটা কালো কুচকুচে মুখ পুঁতির মত দুটো চোখ ঝোলা দুটো কান নিয়ে তার ছোট্টো জিভ বার করে সুমিত্রার ফোনের স্ক্রিনটা চেটে দেয়। 

“এই এই... দেখো দেখি... শিখিয়ে শিখিয়ে আর পারি না, ছাড় ছাড় আমার ফোন ছাড়... না না রিংকু... কোথায় দেখলি এখানে অত ঠান্ডা... টিভিতে? কী জানি... আমি আর টিভি চালাই না তেমন... এই যে... দেখ দেখ... রাজা দেখ... রিংকু দেখ...”

দেখে ওরা। মায়ের ঝকঝকে মুখ, চকচকে চোখ, ঝিকমিক হাসি। এক হাতে ফোন, আরেক হাতে ছানাটাকে জড়িয়ে ধরা। ছানাবাবু এবার জিভ বার করে মায়ের গালটা চেটে দেন। 

“কী যে তোদের বার বার আবহাওয়ার খবর দেখার বাতিক!  ঠাণ্ডা নেই তো তেমন আর! কোথায় শীত!”

বৈশাখী ২০২৪