কাঞ্চনজঙ্ঘা

খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর


(১)

দিগন্তব্যাপী পাইন গাছের জঙ্গলের আড়ালে অস্ত যাচ্ছে সূর্য, দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফে ঢাকা সোনালি চূড়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের আবহাওয়া গ্রীষ্মকালেও ভারী মনোরম, নরম শালের নম্র শীত চারিপাশে ছড়িয়ে থাকে। ট্যাক্সির জানালা দিয়ে চোখ বাড়িয়ে পাহাড়ের অনাবিল সৌন্দর্য মুগ্ধ চোখে উপভোগ করছে মৈত্রেয়ী। প্রতিদিনের ব্যস্ততা থেকে কিছুদিনের সময় চুরি করে সে এসেছে পাহাড়ে। এটাই তার প্রথম একক ভ্রমণ। আগে যেখানেই যেত মা 
যেতেন সঙ্গে। এবার সে সম্পূর্ণ একা। প্রথমদিকে কিছুটা ভয় ভয় করলেও পাহাড় সুন্দরীকে দেখার পর থেকে একেবারেই ভালো হয়ে গিয়েছে মনটা। এখানকার মানুষগুলো বড্ড বেশি সহমর্মী যে কোনো কথায় একগাল হেসে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। 

নুমবিং লেপচা, তার ট্যাক্সির ড্রাইভার ছেলেটি ভারী চৌখশ ও হাসিখুশি, মৈত্রেয়ী শহর থেকে হোম স্টে বুকিং করে আসেনি বলে তাকে নিজের গ্রামে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে সে। পাহাড়ে এসে পাহাড়ি জনজাতিদের গ্রামে সময় কাটানো...প্রস্তাব আসতেই লুফে নিয়েছে মৈত্রেয়ী। দুজনে চলেছে কালিম্পং থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে পাহাড়ের  কোলে ছোট্ট গ্রাম শিমিকতে। নিজেদের মাতৃভাষা রংরিং এ গান ধরেছে নুমবিং, গানের ভাষা তেমন না বুঝলেও তার সুর যেন ধাক্কা দিচ্ছে বুকে, জাগিয়ে তুলছে পুরাতন কতো স্মৃতি। একদলা ব্যথা যেন ছড়িয়ে রয়েছে গানের সুরে, আকাশ বাতাসও যেন তা অনুভব করতে পারছে স্পষ্টভাবে।  

"গতরাতে বৃষ্টি হয়েছিল পাহাড়ে, মেঘের দল কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিল লেপচাদের গ্রাম। যখন আকাশ কাঁদে, এই গানটা গাই আমরা। কেমন লাগছে ম্যাডাম?"  

একগাল হেসে প্রশ্ন করে নুমবিং। 

"বড্ড মনকেমন করা সুর। এটি দুঃখের গান, তাই না?"

কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে মৈত্রেয়ী। 

"এটি আমাদের উপকথা ম্যাডাম। অনেক আগে যখন দেবী ইতিমবু ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করছিলেন তখন কাঞ্চনজঙ্ঘার একমুঠো বরফ দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন প্রথম পুরুষ ফুডংথিংকে, তাঁর মজ্জা দিয়ে পরে সৃষ্টি করা হয় প্রথম নারী নাজং নিউকে। তাঁদের দুইজনকেই অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেন দেবী, কিন্তু সেইসঙ্গে দান করেন দীর্ঘ বিরহ। ফুডংথিংকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাহাড়ের সুউচ্চ চূড়ায় আর নাজং নিউকে থাকতে দেওয়া হয় সেই পাহাড়ের পাদদেশের এক হ্রদে। দুজনের মধ্যের এই দীর্ঘ বিরহ নিয়েই রচনা করা হয়েছে এই গান, যা আমাদের পূর্বপুরুষদের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। আমাদের গ্রামে বলা হয়, স্বয়ং নাজং নিউ এর লেখা এই গান। যে রাতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামত, হ্রদের ধারের কুটিরে বসে এই গান গাইতেন তিনি।" 

গড়গড় করে বলে যায় নুমবিং, নিজেদের ইতিহাস পর্যটকদের শোনাতে বড্ড ভালোবাসে সে। লেপচা পাহাড়ের বহু প্রাচীন জনজাতি। অন্যতম উন্নতও বটে। তাদের ভাষা রংরিংকে উন্নততম ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বহু আগে এই ভাষার বিস্তার তাদের ভেতরে, বড়ো সমৃদ্ধ তাদের ইতিহাস। তাই গর্ববোধ হওয়া স্বাভাবিক। 

"ঠিক যেন বাইবেলের আদম আর ইভের গল্প। এখানেও কি শেষমেশ দেবীকে লুকিয়ে মিলিত হয়ে নিজেদের শক্তি খুইয়ে সাধারণ মানুষে পরিণত হয়েছিলেন ফুডংথিং ও নাজং নিউ?" 

উৎসাহিত হয়ে প্রশ্ন করে মৈত্রেয়ী। ইতিহাস ও পুরাণকথায় বরাবরের আগ্রহ তার। 

"ঠিক ধরেছেন ম্যাডাম। সোনার সিঁড়ি নির্মাণ করে রোজ রাতে পাহাড়চূড়ায় প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন নাজং নিউ। এভাবেই পরপর সাতটি সন্তান জন্মায় তাদের। কিন্তু দেবীর ভয়ে তাদের পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পরিত্যাগ করেন তাঁরা। পরে দেবী যখন সব সত্য জানতে পারেন তখন তাঁদের সাধারণ মানুষ হিসাবে পাহাড়ে বাস করার নির্দেশ দেন তিনি। এভাবেই আমাদের বিস্তার হয়। পরে দেবীর আশীর্বাদে আমরা স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করি।" 

গাড়ি চালাতে চালাতে বলে নুমবিং। পাহাড়ের খাঁজে তৈরি বাড়িগুলোতে ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে আলো। কুয়াশার চাদর ঢেকে দিচ্ছে চারপাশ। গ্রামের একেবারে কাছাকাছি এসে গিয়েছে তারা। এরপরে পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে কিছুটা নেমে ঢুকতে হবে গ্রামে। গাড়ি আর যাবে না। 

ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে নামে মৈত্রেয়ী। শীত এবার কামড় বসাচ্ছে হাড়ে। পাতলা পুলওভারে কাটে না পাহাড়ের শীত, কাঞ্চনজঙ্ঘা কখন মুখ লুকিয়েছে কুয়াশার আড়ালে। ধীরেসুস্থে গাড়ি বন্ধ করে পলিথিনের পাতলা কভার দিয়ে ভালো করে ঢেকেঢুকে দেয় নুমবিং। তারপরে পাঁচশেলের টর্চ জ্বেলে হাত বাড়ায় মৈত্রেয়ীর দিকে, "আসুন ম্যাডাম!" 

বিনা বাক্যব্যয়ে তার হাত ধরে সে।  পাহাড়ে খাঁজ কেটে তৈরি করা সিঁড়ি বেয়ে অতি সাবধানে নামে দুজনে। দূর থেকে ঝরনার জলের পতনের শব্দ পাওয়া যায়। আকাশে তারাদল আজ অনুপস্থিত। চারিদিকে নিকষ অন্ধকার। দূরের পাইন বনের দিকে তাকালে কেমন যেন গা ছমছম করে৷ ভৌতিক গল্প লেখার আদর্শ পরিবেশ। 

"কী ভাবছেন ম্যাডাম? অসুবিধে হচ্ছে কি?" 

মৈত্রেয়ীর হাত ধরে নামতে নামতে প্রশ্ন করে নুমবিং।

"না, আমি ভাবছি নাজং নিউ এর পরিত্যক্ত সন্তানদের কী হল শেষমেশ?" 

"তারা হয়ে উঠল অপশক্তির প্রতীক৷ দুঃখ, কষ্ট, ভয়, হতাশা ইত্যাদি। নিজেদের জীবনের অপ্রাপ্তিগুলো পুষিয়ে দিতে চাইল মানুষের ওপরে অত্যাচার করে। তাদের অন্ধকারের দেবতা বলা হয় একত্রে।" 

একটি ছোট্ট একতলা কটেজের দিকে এগোতে এগোতে বলে নুমবিং। পেছনে মৈত্রেয়ী ব্যাগ হাতে হেঁটে চলে। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি বাড়িটায় লোহার কোনো উপকরণ ব্যবহার করা হয়নি৷ লেপচাদের লোহার পেরেকও পছন্দ নয় একেবারেই, কাঠের পেরেক ব্যবহার করে তারা৷ অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব জনজাতি। 

কাঠের বাড়িটির বারান্দায় ছোট্ট ছোট্ট মাটির টবে ফুটে রয়েছে রঙবেরঙের অর্কিড। অপরূপ তার শোভা৷ নুমবিং এর মা কুয়াং সৌম্যাকান্তি মহিলা, দরজা খুলে স্বাগত জানান তাকে৷ বাড়িতে মা - ছেলে ছাড়া কেউ থাকে না। বাবা মারা গিয়েছেন আগেই। তারা চাষবাসও করে থাকে পাহাড়ের ঢালে। মূলত এলাচ ও স্যান্ডারিন চাষ করে তারা। পাহাড়ি মানুষ মাত্রেই পরিশ্রমী, অলসতাকে পাহাড় প্রশ্রয় দেয় না।

"অনেকটা দূর থেকে এসেছেন আপনি ম্যাডাম। আজ খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিন৷ কাল আপনাকে আমাদের মিউজিয়াম দেখাতে নিয়ে যাব।" 

মৈত্রেয়ীর থাকার জন্য একটি ছোট্ট ঘর খুলে দিয়ে বলে নুমবিং। ঘরে প্রবেশ করে মুগ্ধ হয়ে যায় মৈত্রেয়ী। কংক্রিট শহরের বাসিন্দাদের কাঠের বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা নেই। একটা বিছানা, একটি চৌকি আর একটা কাঠের চেয়ার ছাড়া ঘরে আসবাবের বাহুল্য নেই। নুমবিং এর কথায়, আজকাল অনেক পর্যটক থাকতে আসেন তাদের গ্রামে, আসল পাহাড়ি জীবন উপভোগ করাই তাঁদের উদ্দেশ্য। এজন্য নিজেদের বাড়িতেই হোম স্টে খুলে ফেলেছে তারা। বিছানার মাথার কাছে যে সুবিশাল জানালাটি রয়েছে, ভাগ্য ভালো থাকলে ভোরে কাঞ্চনজঙ্ঘার নরম হাসি দেখা যায়। স্বপ্নরাজ্যের অধিশ্বরীর মাথার মুকুটের মতো বরফ জড়িয়ে গর্বিত ভঙ্গীতে হাসে সে। দূরের পাইন বন তখন হয়ে ওঠে তার অলংকার। 

মা ছেলের সঙ্গে গল্প করতে করতে রাত হয়ে গেলো অনেকটাই। এঁরা কথা বলতে বড্ড ভালোবাসেন। নিজের জীবন, ইতিহাস নিয়ে গল্পের মতো করে বলে যান সবকিছু। শুনে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। পাহাড়ি মুরগির স্বাদ সমতলের ব্রয়লারের থেকে অনেকটাই আলাদা, সেইসঙ্গে নুমবিং এর মায়ের হাতের অপূর্ব রান্না, সব মিলিয়ে বড়ো মনোরম কেটে যায় সময়। খেতে বসে বারবার আড়চোখে মৈত্রেয়ীর দিকে তাকাচ্ছে নুমবিং, তার ছোট্ট দুই চোখে খেলা করছে আশ্চর্য মায়া। মৈত্রেয়ী ডুবছে, নিজের অজান্তেই।  

সমতলে এখন শারোদৎসবে মেতে উঠেছে মানুষ। দামি মণ্ডপসজ্জা, আলো আর ঢাকের শব্দে মুখরিত হয়ে রয়েছে পরিবেশ। ফুটপাত ধরে হাঁটছে কাতারে কাতারে মানুষ। দেবীদর্শনে বেরিয়েছে তারা। পাহাড় শান্ত, ঠিক মহামায়ার আঁচলের মতো। বাহুল্যহীন, অপার নৈঃশব্দের ঠিকানা। এখানে প্রকৃতি কথা বলে। তার গল্প হাঁ করে শুনতে হয়। প্রকৃতির রাজত্বে আড়ম্বর নেই, নম্রতাজড়ানো নির্লিপ্তি আছে। 

কিন্তু মৈত্রেয়ীর খটকা লাগছে অন্য জায়গায়। দূরে অন্ধকার পাইন বনের দিকে তাকিয়ে মাঝেমাঝেই আনমনা হয়ে পড়ছে সে। চোখের সামনে ফুটে উঠছে এক ঝাপসা অদ্ভুত দৃশ্য। এক কিশোর ও এক কিশোরী পাইনবনে লুকোচুরি খেলছে। তাদের হাসির শব্দে মুখরিত হয়ে আছে চারপাশ। ঘন কুয়াশা এসে মাঝেমধ্যেই ঢেকে দিচ্ছে তাদের। কিশোরীকে দেখতে না পেয়ে কিশোরের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরের ডাক ভেসে আসছে, " মিনু... তুই কোথায়!" 

কেউ অজানা ভাষায় করুণ সুরে গান গাইছে। আজ গাড়িতে আসার সময়ে যে ভাষায় গান শুনেছিল মৈত্রেয়ী। কিশোরটির গানের করুণ সুর দমচাপা কান্নার মতো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাহাড়ে। হৃদয়ের প্রতিটি অলিন্দ নিলয়ে আঘাত হানছে সেটি। অব্যক্ত কান্না মৈত্রেয়ীর কণ্ঠরোধ করে ফেলছে। বিধ্বস্ত সে উঠে বসছে বিছানায়। দূর থেকে রাতপাখির কর্কশ গলায় ডাক ভেসে আসছে। পাইন বনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে অদ্ভুত বিষণ্ণ পাহাড়ি হাওয়া। এক হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া মানুষের স্মৃতি বহন করছে সে।  

(২) 

প্রাচীন ওক গাছের বন দিয়ে ঘেরা তিস্তানদীর তীরে দুই যমজ পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত শহর কালিম্পং। প্রকৃতি সুন্দরী তাঁর আশীর্বাদ ঢেলে দিয়েছেন এর ওপরে, সৌন্দর্যের কোনো খামতি নেই তার। একসময় ভারত ও তিব্বতের মধ্যে বাণিজ্য চলত এই শহরের মাধ্যমে। তিব্বত বর্তমানে চীন অধিকার করে নেওয়ায় সেই সুযোগ আর নেই। তবে একটা বৌদ্ধিক ভাবগম্ভীর পরিমণ্ডল আজও ঘিরে রয়েছে শহরটিকে। অজস্র দুর্লভ অর্কিডের সম্ভার পর্যটকদের মনে শিহরণ জাগাতে বাধ্য। এর প্রাকৃতিক, ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। 

কালিম্পং এর অজস্র দর্শনীয় স্থানগুলির একটি হলো লেপচা মিউজিয়াম। আজ সকালে মৈত্রেয়ীকে এখানে নিয়ে এসেছে নুমবিং। ভোরবেলায় গ্রামে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শনের স্মৃতি বহুদিন ভুলবে না মৈত্রেয়ী। ঈষৎ কমলা বর্ণের সূর্যালোক পাহাড়ের চূড়ায় যেন গলিত সোনা ঢেলে দিয়েছিল। প্রজাদের দিকে তাকিয়ে নিজের দুর্লভ হাসি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন পাহাড় সম্রাজ্ঞী। তবে তা কিছুক্ষণ মাত্র। কুয়াশার আস্তরণ আবার ঢেকে ফেলেছিল তাঁকে। যেন কোনো লাজুক কিশোরী মুখ লুকিয়েছিল মায়ের আঁচলে। 

এখন ঠান্ডা তেমন নেই পরিবেশে। মেঘ রোদ্দুরের চিরাচরিত খেলা চলছে আকাশে। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কী যেন লক্ষ করছে মৈত্রেয়ী। নুমবিং অনুভব করতে পারছে তার অন্যমনস্কতা। 

"পদ্মশ্রী সোনম লেপচা তৈরি করেছেন এই মিউজিয়াম বাইরের মানুষদের কাছে আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য। একজন বিশিষ্ট সঙ্গীত ও নৃত্যশিল্পী ছিলেন তিনি। বর্তমানে এই মিউজিয়াম তাঁরই দায়িত্বে আছে।" 

সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে মন্তব্য করে নুমবিং। তার ইশারায় ঘাড় ঘুরিয়ে নবতিপর বৃদ্ধকে দেখে চমকে ওঠে মৈত্রেয়ী। এখনো তিনি বেশ পরিপাটি ও শক্তপোক্ত। এতখানি বয়সেও সকলের সামনে নিজেদের শিল্প সংস্কৃতিকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পরিশ্রম করে চলেছেন মানুষটি। তিনি নিজেই চলমান ইতিহাস৷  

"এখানে প্রধান দর্শনীয় বস্তু কী? মানে এই মিউজিয়ামের প্রধান আকর্ষণ... " বোঝাবার চেষ্টা করে মৈত্রেয়ী। নুমবিং স্মিত হাসে। 

"প্রধান দর্শনীয় মূল্যবান বস্তুটিকে একটু আগেই দেখে আসলেন আপনি৷ তাঁর মুখে ইতিহাসের গল্প শোনা অনেক বড়ো অভিজ্ঞতা। এছাড়াও আমাদের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথি, হাতের কাজ, বাজনা সবই পেয়ে যাবেন এখানে। আপনাদের শহর থেকে অনেকেই গবেষণার জন্য এখানে আসে।" 

মৈত্রেয়ীকে মিউজিয়াম ঘুরে দেখাতে দেখাতে চোস্ত হিন্দীতে বলে নুমবিং। বাংলা বুঝলেও ঠিকঠাক বলতে পারে না সে। 

মিউজিয়াম দেখা শেষ করে দুজনে নদীর ধারে পাশাপাশি হাঁটে। পাথরে বিছানো পথ দুইপাশে রেখে মাঝে উচ্ছ্বল তরুণীর মতো বয়ে চলেছে তিস্তা। তার গাঢ় নীল জলে ছায়া পড়েছে পাহাড়ের। ডোলো এবং দুরপিন দারা, দুই যমজ পাহাড়, কিন্তু দুজনের চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন সবুজের পোশাক পরতে পছন্দ করে, অন্যজন ধূসর কুয়াশার। 

বড় পাথরের চাঁইয়ের ওপরে বসে নদীর দিকে চেয়ে আছে মৈত্রেয়ী, মনটা বড্ড উদাস হয়ে যাচ্ছে তার। কী যেন ছিল, কী যেন বর্তমানে নেই, ভেবে অস্থির হচ্ছে সে। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একঝাঁক পাহাড়ি সবুজ টিয়া। নদীর ওপার থেকে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে এক কিশোর, দুইহাতে এক ধবল খরগোশ ধরা তার। ধীরে ধীরে পেছনে পাইন বনের দিকে সরে যাচ্ছে সে। মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশায়। মৈত্রেয়ীর অজস্র প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার সস্তা পোশাকের আস্তিনে। 
"দাঁড়াও! যেও না! কথা আছে, দাঁড়াও!" 
তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে মৈত্রেয়ী। পাথর ডিঙিয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে চায়। তার হাত চেপে ধরে পথ আটকায় নুমবিং। চাপাস্বরে বলে, "ম্যাডাম, কী করছেন! নদীর স্রোতের টান সম্পর্কে জানা আছে আপনার? ডুবে যাবেন এখনই!" 
"নুমবিং... ওই ছেলেটা... চলে যাচ্ছে... ওকে আটকাও...!” কোনোক্রমে বলার চেষ্টা করে মৈত্রেয়ী। 
"কেউ নেই ওখানে। কুয়াশা আর জঙ্গল ছাড়া। আবহাওয়া খারাপ হচ্ছে, বৃষ্টি নামবে বোধহয়। চলুন এখান থেকে। আর বসা ঠিক নয়।" 
মৈত্রেয়ীকে একপ্রকার টানতে টানতে প্রধান সড়কে উঠে গাড়ির দিকে এগোয় নুমবিং। মৈত্রেয়ী বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে পেছনের পাইন বনের দিকে, যার সামনে একটু আগেই দাঁড়িয়ে ছিল কিশোরটি। এখন কেউ নেই ওখানে। 

(৩)

" ববা আবার বদলি হয়ে যাচ্ছেন। আমাদের আর দেখা হবে না হয়তো!" মুখ ব্যাজার করে নদীর দিকে তাকিয়ে বলে কিশোরী। 
"কিন্তু... তুই যে কথা দিয়েছিলি তুই আর কোথাও যাবি না! তুই ছাড়া আর কোনো বন্ধু নেই আমার! কী করব আমি!" 
কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে লেপচা কিশোর৷ তার ঝলমলে মুখে গাঢ় মেঘ ভিড় জমায়। 
"আমার কিচ্ছু করার নেই রে! বাবার কথার ওপরে কিছু বলতে পারব না আমি। মায়ের সঙ্গে গতরাতেও ঝগড়া হয়েছে তাঁর। শহরে গিয়ে হয়তো আলাদা হয়ে যাবেন তাঁরা৷ আমি কার কাছে থাকব কে জানে!"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে কিশোরী। তাকে জড়িয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে ফোঁপায় কিশোর। ধীরগলায় বলে, "যাস না! তোকে আমার খরগোশটা দিয়ে দেব! " 

কিশোরী কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়ে। সন্ধ্যা নেমে আসে তিস্তানদীর আঙিনায়। আকাশে একরাশ তারা জেগে ওঠে। পাথরে মাথা রেখে দুই বন্ধু অবাক বিস্ময়ে তারাদের ভরা সংসার দেখে। কোথায় গেলে কাউকে হারাতে হয় না! 

দিন কয়েক পরে পাহাড়কে শেষবারের মতো বিদায় জানিয়ে ট্যাক্সিতে ওঠে কিশোরী। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে ভোরের কুয়াশা ভেদ করে। পথের দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কিশোর। তার কোলের খরগোশটা পাতা চিবোয়। কী ঘটতে চলেছে বুঝতে পারে না সে। 

পাহাড়ে আবহাওয়া বড্ড খারাপ আজ। কুয়াশার চাদর যেন পুরু হয়ে নেমে এসেছে জমিনে। একটু দূরের পথ কিচ্ছু দেখা যায় না। ট্যাক্সির ড্রাইভারও বোধহয় দেখতে পারেননি। তাই হঠাৎ বীভৎস শব্দে আশেপাশের পাখিরা ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। অসাবধানতায় পাহাড়ের পাথরের গায়ে ধাক্কা লাগিয়েছে গাড়ি। তুবড়ে গিয়েছে বনেট। ড্রাইভার ও কিশোরীর বাবা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন, স্পন্দনহীন। কিশোরী ও তার মায়ের আর্তনাদে ভারী হয়ে গিয়েছে পাহাড়ের বাতাস৷ টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। পাহাড় কাঁদছে তাদের ব্যথার সঙ্গী হয়ে। 

(৪)

ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে মৈত্রেয়ী। মাথাখানা এখনো ঝিমঝিম করছে তার। সেই ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্টের পরে স্মৃতির একটা পাতা যেন তার ডাইরি থেকে ছিঁড়ে নিয়েছে কেউ। বাবা চলে যাওয়ার পরে মা আর পাহাড়ে ফেরেননি। চলে গিয়েছিলেন কলকাতায় মামাবাড়িতে। সেখানেই মানুষ মৈত্রেয়ী। অন্যান্য শিশুদের মতোই মামাদের আদরে বেড়ে উঠলেও কোথাও যেন ফাঁক থেকে গিয়েছে। কিছু একটা ছিল, এখন আর নেই, এই বোধটাই তার অন্তর থেকে সরাতে পারেনি কেউই। শহরে অনেক বন্ধু হয়েছে তার, কিন্তু তারা কেউই তেমন কাছের হয়নি। কাকে যেন বরাবর খুঁজে বেড়িয়েছে সে। চাকরি পাওয়ার পরে ঘুরে বেড়িয়েছে পাহাড়ে পাহাড়ে, কিন্তু সন্ধান পায়নি। এখানে এর আগে কখনো আসা হয়নি তার। মা বারণ করেছিলেন। গেল বছর তিনিও চলে গেলেন। আরও একা হয়ে পড়ল মৈত্রেয়ী। এবার পুজোর ছুটি পেতেই তাই চলে এল এখানে, নিজের হৃদয়ের শূন্যতার সন্ধান করার জন্য। 
রাত্রি এখন একটা পাঁচ। এত রাতেও কেউ একজন জেগে আছে। করুণ সুরে রংরিং ভাষায় গাইছে বিরহের গান। যে গানটি গাড়িতে নুমবিং এর গলায় শুনেছিল মৈত্রেয়ী। দেবীর তাড়নায় প্রেমিকের থেকে আলাদা হয়ে জ্যোৎস্নারাতে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে যে গানটি গাইতেন ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম মানবী, নাজং নিউ। সেই একই দুঃখ, একই যন্ত্রণা মিশে আছে এই গানে। এত রাতে কে গান গায়! 
ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয় মৈত্রেয়ী। দূরে অন্ধকারে মোড়া পাইন বনের দিকে তাকিয়ে গান গাইছে নুমবিং। অন্ধকারে যেন বড্ড অন্যরকম মনে হচ্ছে তাকে। কোনোকিছুর খেয়াল নেই তার, সমাজের ঘেরাটোপ নেই, শুধু সে আর তার আজন্ম তিস্তানদীর মতো প্রবাহিত বিরহ আছে। 

"ফিরে আসতে এত দেরি করলি কেন মিনু! তুই না কথা দিয়েছিলি ফিরে আসবি আমার কাছে! আবার একসঙ্গে পাহাড় দেখব আমরা! আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন বুনব। এতদিন পরে যখন এলি আর চিনতেও পারলি না আমায়! কই আমার তো ভুল হয়নি তোকে চিনতে! তোর গালের জড়ুলটা দেখে অজস্র ভিড়ের মাঝেও তোকে চিনে নেওয়া যায়। জানিস তুই!"  

একদলা অভিমান ঝরে পড়ে নুমবিং এর গলায়। মৈত্রেয়ী উত্তর দিতে পারে না। ধীরে ধীরে তার পাশে এসে বসে। দুই চোখ বেয়ে জল গড়ায় তার। পাহাড়ি বাতাস দুজনের মুখ স্পর্শ করে প্রবাহিত হয়। ধীরে ধীরে তার কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয় নুমবিং। দুজনে একসঙ্গে তাকিয়ে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে। অন্ধকার আকাশে ঝলমল করে সপ্তর্ষিমণ্ডল।। 

বৈশাখী ২০২৪