১ পাহাড়ের শীতটা কোনদিনই সহ্য হয় না রক্তিমার। অথচ বেছে বেছে কালিম্পং শহরেই ব্যাঙ্কের পোস্টিং পেল পূর্বায়ণ। তাও দেখতে দেখতে তিনটে বছর কেটে গেল! এই ডিসেম্বরের শুরুতে একেবারে খতরনাক ঠাণ্ডা পড়েছে! লেপ ছেড়ে বেরোতে প্রবল আলিস্যি রক্তিমার! কিন্তু শঙ্কু, মানে সাঙ্খায়ণের কনভেন্টে এক মিনিট দেরী করার উপায় নেই! ভোর ছটায় অ্যালার্ম দেওয়া। জোরালো আওয়াজে বার তিনেক বাজতেই, অনেক কষ্টে আড়মোড়া ভেঙে লেপটা গা থেকে সরালো রক্তিমা। পাশে কেউ নেই। পূর্বায়ণ যথারীতি সাড়ে পাঁচটায় উঠে নির্ঘাত বেরিয়ে গেছে মর্নিং ওয়াকে! কী করে যে এই ঠাণ্ডায় বেরোয়! রক্তিমাকে বলে, “তুমি কখনো পাহাড়ে আগুন লাগা দেখেছ? এই সময়, ভোরবেলা আকাশ থাকে একেবারে পরিষ্কার! কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার এর চেয়ে ভাল সময় আর নেই। উদয় সূর্য যখন একটু একটু করে ছোঁয় শিখর চূড়াগুলো, তখন সাদা বরফে যেন আগুন লাগে! সে আগুনের লাল আভা যে দেখেনি, তাকে বোঝানো যায় না সে দৃশ্য! তুমি তিন বছরে বোধহয় একবারও দেখনি!” এখন ছেলেকে ডেকে দিয়ে দ্রুত টিফিন বানাতে হবে! পাশের ঘরে ছেলে ঘুমোয়। এই আট বছর বয়সেই খুব স্বাধীনচেতা। মায়ের সঙ্গে শোবে না! ঐ তো লেপের মধ্যে মাথা ঢেকে ঘুমোচ্ছে! ডাকতেও মায়া হয় রক্তিমার। তবু “শঙ্কু” বলে বেশ কয়েকবার হাঁক পেড়ে রান্নাঘরের দিকে দৌড়ল রক্তিমা। স্থানীয় নেপালি মেয়ে মীনা এসে পড়লে আর ওর চিন্তা নেই। ও রেডি করে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে আসবে শঙ্কুকে। একটা ব্যাপারে ইংরেজদের ঋণ স্বীকার করে রক্তিমা! কী অসাধারণ সব বেকারি বানিয়ে গেছে দার্জিলিং, কালিম্পং এই সব পাহাড়ি জায়গায়! “বেকস্মিথের” কেক খুব পছন্দ করে শঙ্কু। কাল এনেছিল পূর্বায়ণ! খানিকটা রয়েছে ফ্রিজে। চটপট কয়েকটা সসেজ ভেজে ফেলল রক্তিমা, তারপর টোস্টারে পাঁউরুটি দিতেই, কলিং বেল বাজল! মীনা এল বোধহয়। শঙ্কুর ঘরে লেপ পড়ে রয়েছে! শঙ্কু গেল কোথায়? নিশ্চিত বাথরুমে ঢুকে বসে আছে! কিছুতেই স্নান করতে চায় না! রাত থেকে গিজার চালিয়ে রেখেছে রক্তিমা! বাথরুমের দরজায় একবার টোকা দিয়ে “জলদি কর” বলে বাইরের দরজার দিকে গেল। দরজাটা খুলতেই হিমেল হাওয়া এসে কাঁপিয়ে তুলল রক্তিমাকে! “শঙ্কুকে তাড়াতাড়ি রেডি কর!” বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল আবার। পাঁউরুটিগুলো না পুড়ে যায়! শঙ্কু ভীষণ খুঁতখুঁতে! একেবারে পারফেক্ট টোস্ট না হলেই ফেরত নিয়ে আসবে। পরিপাটি করে টিফিন গুছিয়ে খাবার টেবিলে রাখল রক্তিমা। শোয়ার ঘরে মোবাইলটা বাজছে! ধরতেই মানসীর গলা, “সক্কালেই তোর কথা মনে পড়ল! ঠিক আছিস তো?” “ঠিক থাকব না কেন? ছেলের টিফিন গোছাচ্ছিলাম!” বলে রক্তিমা। ওপারে বেশ একটু নীরবতা। অধৈর্য হয়ে রক্তিমা বলে, “চুপ করে গেলি কেন? কী বলবি বল!” “ক’দিন কলকাতা ঘুরে যা না! মনটাও ভাল হবে!” “কী যে সকাল থেকে আমাকে নিয়ে পড়লি! তুই কেমন আছিস বল!” “ভাল রে! আমি শীতকালে বিন্দাস থাকি। রজতের ক্লাবগুলোতে প্রচুর ইনভাইট পাই! এই ডিসেম্বরেই যত ক্রিসমাস পার্টিগুলো! আমি তো আজকাল ওয়েস্টার্ন ড্রেসও পরছি এই বুড়ো বয়সে!” উৎসাহ ঝরে পড়ে মানসীর গলায়, “তবে এখন তো কলকাতায় শীত নামমাত্র। এই ডিসেম্বরের কটা দিন! শীত পড়ত আমাদের ছোটবেলায়! তোর মনে আছে সেই স্কুলের দিনগুলো?” “তা আর মনে নেই? খুব মিস করি রে কলকাতা! আচ্ছা, পরে আবার কথা হবে রাত্রে! দেখি ছেলেটা রেডি হল কি না!” ফোন রেখেই খাবার ঘরে এল রক্তিমা! ও মা! কোথায় টিফিন বক্স! কখন বেরিয়ে গেছে মীনা আর শঙ্কু! একবার “বাই” বলেও গেল না! মানসীটাও আর ফোন করার সময় পেল না। ঘড়িতে পৌনে সাতটা বেজে গেছে! পূর্বায়ণ এখনো ফেরেনি। মাঝে মাঝে একেবারে বাজার করে ফেরে নীচ থেকে। এই সময় আপেল, অ্যাপ্রিকট, চেরী খুব সস্তা। সবজিও বাজার আলো করা! তবে পূর্বায়ণের নন-ভেজ ছাড়া চলে না। শীতকালে প্রায়ই বাড়িতে স্টেক সিজলার বানাতে হয় রক্তিমাকে। পূর্বায়ণের খুব প্রিয়! মীনা ফিরে ব্রেকফাস্ট বানাবে, পূর্বায়ণের টিফিন বানাবে। আস্তে আস্তে শোয়ার ঘরের দিকে পা বাড়ায় রক্তিমা! পর্দা সরিয়ে দিতেই প্রায় জানালার বাইরে পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় চোখ আটকে যায় রক্তিমার! আশ্চর্য! এই সময়ে তো সাধারণতঃ সকালের দিকে পরিষ্কার আকাশ থাকে! আজ খুব কুয়াশা! এদিকটা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা চোখে পড়ে। আজ কাছের পাহাড়গুলোও দেখা যাচ্ছে না! গুঁড়ি গুঁড়ি তুষার পড়ছে! এই মরশুমের প্রথম তুষার! প্রথম প্রথম কালিম্পং আসার পর, তুষার দেখলে জানালার পাট খুলে হাত বাড়িয়ে দিত রক্তিমা! ধারণাই ছিল না, খানিকক্ষণ হাত পেতে রাখলে অসাড় হয়ে যায়! এখন আর এ সব তেমন টানে না ওকে। বরং মনটা আরো ভারী হয়ে যায় চারিদিক কুয়াশায় ঢেকে গেলে! আর একবার লেপটা টেনে নেয় রক্তিমা। মীনা, পূর্বায়ণ দুজনের কাছেই চাবি আছে। ঢুকে যেতে পারবে। আর একটু আয়েস করতে ইচ্ছে করছে। শীতকালের মজাই তো এই! ২ ফোনের রিং বাজতেই ধড়মড় করে উঠে বসল রক্তিমা! ইশ! বেলা দশটা বেজে গেছে! এতক্ষণ ঘুমোল! পূর্বায়ণ এসে অফিসে বেরিয়ে গেছে নির্ঘাত! ও ঘুমোচ্ছে দেখে আর ডাকেনি! ও জানে লেপ থেকে টেনে তুললে খুব রাগ হয় রক্তিমার! মীনা নিশ্চই ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিয়েছে! রান্নাঘরের দিকে গেল রক্তিমা। পরিপাটি করে ওর ব্রেকফাস্ট হটপটে রেখে গেছে মীনা। ডিমের পোচ, সসেজ। আপেল কেটে রেখে গেছে। শুধু পাঁউরুটি টোস্টারে দিয়ে দিলেই হবে। ঘরবাড়ি ঝাঁট মোছাও শেষ! উঁহু, পূর্বায়ণ বাজার করেনি আজ! বিশেষ কিছু নেই ফ্রিজে। নিশ্চয়ই মীনা বাজারে গেছে। ওর কাছে কিছু টাকা দিয়ে রাখে রক্তিমা। বাজার থেকে ফেরার সময় শঙ্কুকে স্কুলবাস থেকে নামিয়ে নিয়ে আসবে একদম। ব্রেকফাস্ট করে রান্না বসাল রক্তিমা। ছেলেটা খুব পনির ভালবাসে। পাহাড়ি জায়গায় মহিলারা ঘরে পনির তৈরী করে। তার টেস্ট বেশ অন্যরকম! খানিকটা রয়েছে ফ্রিজে। পনির বাটার মশালা আর ফুলকপির পকোড়া বানাবে ঠিক করল রক্তিমা! এত বেলাতেও কী ঠাণ্ডা! গায়ে মোটা মেরুন কার্ডিগানটা চাপিয়ে নিল। গতবছর বিবাহবার্ষিকীতে দিয়েছিল পূর্বায়ণ। লেখা ছিল – ‘আমার শীতকাতুরে বৌকে’। ভাবতেই হাসি পেল। দূরে গির্জার ঘন্টা বাজছে! রান্না শেষ করে সব হটপটে ঢাকা দিয়ে রেখে দিল রক্তিমা। আর একঘন্টা পরেই শঙ্কু চলে আসবে! শঙ্কুর জন্য একটা উলের কার্ডিগান বুনছে রক্তিমা। কুসুম হলুদ রঙের! নীল দিয়ে ডিজাইন করা! ওর বোনা দেখে পূর্বায়ণ হাসে, বলে “তুমি শুধু শুধু কেন যে আজকের দিনে এত কষ্ট করে বোনো! বাজারে হাজার ব্র্যান্ডের কত রেডিমেড সোয়েটার জ্যাকেট! পাহাড়ি জায়গায় সে সব কত সস্তায় পাওয়া যায়! নানা অ্যাট্রাকটিভ ডিজাইন! বোনা সোয়েটার পরবে শঙ্কু?” রক্তিমার খুব রাগ হয়! ওর ভাল লাগে উলের উষ্ণ স্পর্শ! সোয়েটারের প্রতিটি ভাঁজে যে মায়ের আদর যত্ন লেগে থাকে, তা কি বোঝে না পূর্বায়ণ? আসলে ছোটবেলা থেকেই ও পাহাড়ে বোর্ডিং স্কুলে থেকে মানুষ। শাশুড়ি মারা গেছিলেন ওর যখন মাত্র দশ বছর বয়স! নরম গরম উলের সোয়েটারের ওম গালে লাগায় রক্তিমা! শঙ্কুর ফরসা রঙে খুব মানাবে সোয়েটারটা! পিঠটা বোনা হয়ে গেছে! মেলে ধরে মনে মনে ছেলের সাইজটা কল্পনা করে একবার। নাঃ সুন্দর ফিট করবে। ৩ তখন কলকাতায় ঠাণ্ডা পড়ত বেশ! বরানগরের গঙ্গার ধারের শিরশিরে হাওয়ায় গা যেন শিউরে উঠত! বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত ডিসেম্বরের শুরুতেই। তারপর শীতের ছুটি পড়ে যেত! মানসী প্রায়ই আসত বাড়িতে! মা ওকে ভাত খাইয়ে দিত! শীতকাল মানেই দেদার মটরশুঁটি, ফুলকপি, গাজর, শিম! কী স্বাদ আর সুগন্ধ! নিরামিষ পদ দারুণ রাঁধত মা! তাই দিয়েই একথালা ভাত খেয়ে দুটো বড় বড় সুগন্ধী কমলালেবু নিয়ে ছাদে খোলা চুল এলিয়ে রোদে পিঠ দিয়ে গল্প চলত বিকেল অবধি! উল বুনতে বুনতে পাশের ছাদে ঘুরে বেড়ানো হ্যান্ডসাম ছেলেটা ঘুরত, ফিরত আর আড়চোখে তাকাত! একদিন উড়ে এসেছিল একটা চিঠি! সে কী উত্তেজনা সেই চিঠি পড়ার! বেশ মনে আছে রক্তিমা আর মানসী একই সঙ্গে প্রেমে পড়েছিল ছেলেটার! কিশোরী বয়সে যা হয়! রক্তিমা মায়ের ভয়ে বেশীদূর না এগোলেও, মানসী অনেক দূর এগিয়েছিল! শেষে আবিষ্কার করেছিল ছেলেটার স্টেডি গার্লফ্রেন্ড ছিল আগেই! সে হৃদয়ভঙ্গের কান্নাও শুনেছিল রক্তিমাদের ছাদ! সেবার ডিসেম্বরের শেষে রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল মানসী পাশ করতে পারেনি। ছাদে এসে সে কী কান্না! ছেলেটিকে আর ছাদে দেখা যায়নি তারপর! শীতকাল মানেই মায়ের হাতের পিঠে পুলি খাওয়া আর দেদার ক্রিকেট দেখা! তখন সবে কালার টেলিভিশন এসেছে! সবুজ ইডেনে লাল টুকটুকে বল হাতে কপিলদেবের দৌড় দেখার উত্তেজনা যেন এখনো মনে পড়ে। খেলায় রক্তিমার উৎসাহ দেখে বাবা একবার ইডেনে নিয়ে গেছিলেন! গাভাসকরের অটোগ্রাফ নিয়েছিল! সে খাতা যত্ন করে রেখে দিয়েছে রক্তিমা। পূর্বায়ণকে কতবার যে দেখিয়েছে বিয়ের পর! হঠাত ঘড়ির দিকে চমকে তাকাল রক্তিমা! ও মা ঘড়ির কাঁটায় তিনটে! শঙ্কু ফিরল না তো! মীনারও দেখা নেই! তবে কি কুয়াশার জন্য স্কুলবাস আসেনি ঠিক সময়? এমন তো হয় না! রক্তিমার মনটা অস্থির হয়ে ওঠে! উল কাঁটা গুটিয়ে রাখে! নাঃ আর দেরী করা যায় না। নিজেই শঙ্কুর স্কুলের দিকে যাবে ঠিক করল! মোবাইলে স্কুল গেটে ফোন করল একবার। সিকিউরিটি বলল ঠিক সময়েই ছুটি হয়েছে। বাসও এসেছে! তবে? কোনরকমে একটা জিন্স আর মোটা গলাঢাকা কার্ডিগান পরে বাড়ির চাবি আর খুচরো পয়সা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রক্তিমা। মনটা উথাল পাথাল করছে। ওদের বাড়িটা পাহাড়ের ঢালে। পথ নীচে বাজারের দিকে নেমে গেছে। তারপর আবার উঠে গেছে শঙ্কুদের স্কুলের দিকে। মীনাই বা গেল কোথায়? তবে কি ও শঙ্কুকে নিয়েই বাজারের দিকে গেল? বেশ দ্রুত পায়ে বাজারের দিকে হাঁটছে রক্তিমা! ঘনঘন নিশ্বাস পড়ছে উত্তেজনায়! নীচ থেকে কুয়াশা উঠে আসছে ধোঁয়ার মত! সামনের মানুষ দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ প্রায় কুয়াশা ফুঁড়ে সামনে মীনাকে দেখল রক্তিমা! উঠে আসছে বাজারের দিক থেকে, হাতে থলে! কিন্তু শঙ্কু কোথায়! জোরে জোরে গির্জায় ঘন্টা পড়ছে আবার! বেশ চেঁচিয়েই বলল রক্তিমা, “কোথায় ছিলি? শঙ্কু কই? এখনো বাড়ি ঢুকিসনি কেন?” মীনা মাথা নীচু করে চুপ। সহ্য হচ্ছে না রক্তিমার! ওকে ধরে বেশ ঝাঁকিয়ে দিল, “কী রে বল! বল শিগগির ছেলেটা কোথায়? নইলে মার খাবি এবার!” অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে মীনা বলে, “অত রাগ কোরো না। বাড়ি চল।“ “শঙ্কুকে না নিয়ে কোথাও যাব না! বল, ওকে কোথায় রেখেছিস!” মীনার গালে থাপ্পড় কষিয়ে দেয় রক্তিমা! পূর্বায়ণকে মোবাইলে ফোন করে রক্তিমা। পূর্বায়ণের নম্বর বেজে যাচ্ছে! নিশ্চই কোন মিটিং-এ! একটা আরজেন্ট ভয়েস মেসেজ রেখে শঙ্কুর বাসের কনডাক্টরকে ফোন করে রক্তিমা। ও বাস থেকে নেমেছিল কি না জিজ্ঞাসা করলেই বোঝা যাবে! বেশ কবার ফোন বাজার পর উত্তর এল, “উয়ো তো কঈ দিন সে বাস মে নহি আয়া ম্যাম!” তাহলে কি বাসে ফিরছে না শঙ্কু? কিন্তু রোজ তো মীনা ওকে নিয়ে আসে একই সময়ে! কাল? কাল এনেছিল? তার আগের দিন? মাথাটা কেমন হালকা লাগছে! সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে রক্তিমার। শরীরে এতটুকু জোর নেই! বড় ঘুম পাচ্ছে! ৪ উঃ, কী শীত! ঠকঠক করে কাঁপছে রক্তিমা! পায়ের কাছের লেপটা গায়ে ঢাকা দিয়েই খেয়াল হল সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে! কারা যেন দূরে গান গাইছে! ক্রিসমাস ক্যারল! গির্জায় রিহার্সাল হয় এই সময়! চব্বিশ তারিখ রাত্রে বড় অনুষ্ঠান হয়। কী সুন্দর সাজানো হয় চারিদিক! রক্তিমা বড় ক্রিসমাস ট্রি কিনেছে গতবার শঙ্কুর বায়নায়! আর সান্তা ক্লস! সে আবার গান গায়! কে জানে এবার কী চাইবে শঙ্কু সান্তার কাছে? পূর্বায়ণ যে করে হোক ছেলের শখ মেটায়। দরকার হলে শিলিগুড়ি গিয়েও নিয়ে আসে ওর শখের জিনিস। রক্তিমা ডেকে ওঠে, “শঙ্কু – শঙ্কু!” মীনা উঁকি মারে, “চা আনব ম্যাডাম? চা খেলে, শরীরটা ভাল লাগবে!” মীনাকে দেখেই হঠাত রক্তিমার দুপুরের কথা মনে পড়ে গেল! শঙ্কুর স্কুলবাসের কনডাকটর বলেছিল ও বাসে আসেনি বেশ ক’দিন! উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায় রক্তিমা, “চা খাব আমি? আগে বল শঙ্কু কোথায়! কী করেছিস তুই শঙ্কুকে! দু-দুপুরে কী সব যেন বলছিলি – তারপর –” “আপনার জ্ঞান চলে গিয়েছিল দিদি!” “কী হয়েছে আমার? কী হয়েছে শঙ্কুর! শিগগিরি বল শয়তান! নইলে তোকে বাড়ি থেকে বার করে দেব!” “একটু শান্ত হন দিদি।“ রক্তিমার মাথায় যত্নে হাত বুলিয়ে এলোমেলো চুলগুলি সরিয়ে দেয় মীনা “ওষুধ কটা খেয়ে নিন তো! নইলে ডাক্তারবাবু বকবে!” “ওষুধ খাব কেন?” “দুর্বল হয়ে পড়ছেন তো তাই।“ “কিচ্ছু হয়নি আমার! সকাল থেকে রান্নাবান্না সব করলাম! শঙ্কুর জন্য পনির করলাম! ছেলেটা খুব ভালবাসে। কোন বন্ধুর বাড়ি গেছে? জন্মদিন বুঝি কারো? কই, বলেনি তো আমাকে! আমি পূর্বায়ণকে ফোন করে দেখছি! এতক্ষণে নিশ্চই মিটিং শেষ হয়েছে!” পাশের ঘরে পূর্বায়ণের ফোনটা বাজতে থাকে! ছুটে যায় রক্তিমা, “এ কী! ফোন ফেলে গেছে পূর্বায়ণ! সেই জন্যই ফোন ধরেনি! আ-আ-আমি পূর্বায়ণের অফিসে যাই! তোকে একফোঁটা বিশ্বাস করি না আর! শঙ্কুকে কী করেছিস তুই!” পাগলের মত বাইরের দিকে ছুটে যায় রক্তিমা! পিছনে ছোটে মীনা, “দিদি! যাবেন না!” কোন কথা কানে যায় না রক্তিমার। ঢালু রাস্তায় দৌড়ে যায় পাগলের মত! টাল সামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ে রাস্তার বাঁকে! কপালে চোট লেগে রক্ত বেরিয়ে আসে! হঠাৎ কে যেন ওর হাত ধরে তোলে! ফাদার ড্যানিয়েল! সাদা জোব্বা গায়ে! মুখে উদ্বেগ! বলেন, “কী হয়েছে মিসেস দত্ত? এভাবে ছুটছেন কেন!” “ফাদার! আমার ছেলে শঙ্কু স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেনি এখনো! মীনা কিচ্ছু বলতে পারছে না! পূর্বায়ণ ফোন ফেলে গেছে! আমাকে ওর অফিসে যেতেই হবে ফাদার! শঙ্কুকে ও নিয়ে আসবে!” “শঙ্কু আর কোনদিনই আসবে না মিসেস দত্ত! পূর্বায়ণও নয়!” “না! কী বলছেন ফাদার!” ফাদার রক্তিমাকে ধরে নিয়ে আসছেন দেখে নিশ্চিন্ত হয় মীনা! রক্তিমার দায়িত্ব নেওয়ার মত কেউ না এলে, এভাবে আর কাজ করা যাচ্ছে না। ফাদারকে বলতেই হবে রক্তিমার বাড়িতে চিঠি লিখতে। ফাদার বলেন, “রক্তিমা! টুডে ইজ এইটিন্থ ডিসেম্বর! ডু ইউ হ্যাভ এনি মেমরি অফ সেভেন্টিন্থ লাস্ট মান্থ? ইট ওয়াজ এ সানডে!” কেমন শূন্য চোখে ঘাড় নাড়ে রক্তিমা, “সেদিন তো শঙ্কু আর পূর্বায়ণ দুজনেরই ছুটি থাকে! পূর্বায়ণ শঙ্কুকে টেনিস শিখতে নিয়ে যায়, ওদের ক্লাবে! অনেক সকালে উঠে বেরোয় দুজন!” “ইট ওয়াজ ভেরি ফগি লাইক টুডে! পূর্বায়ণ টুক শঙ্কু ইন হিজ কার অ্যান্ড –” “অনেক বেলা হলেও ওরা ফেরেনি! আমি দুপুরের খাবার নিয়ে বসেছিলাম আজকের মতই! তারপর – আর মনে পড়ছে না ফাদার! ও-ওরা কখন ফিরেছিল, মনে পড়ছে না!” “দে নেভার রিটার্নড!” মীনা বলে, “দিদি কোনদিন বিশ্বাসই করেনি ওরা আর নেই!” “হোয়াই! হোয়াই ফাদার!” কান্নায় ভেঙে পড়ে রক্তিমা!