জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি।জমিয়ে শীত পড়েছে। রাতের ডিনার সেরে সকলকে গুড নাইট বলে ব্ল্যাঙ্কেটের ভিতরে ঢুকে সুখ নিদ্রা যাবার জন্য বেডরুমে যেতে গিয়ে দিয়া দেখে হাতছানি দিয়ে ঠাম্মি তাকে ডাকছেন। "শোন রে নাত বউ, কাল সকালে একটু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠিস। অফিসে ছুটি নিস। তোর একটা পরীক্ষা আছে।" "পরীক্ষা! কীসের পরীক্ষা ঠাম্মি?” "তোর শাশুড়ি দেবলার সঙ্গে তোর কম্পিটিশন।" "অ্যাঁ, কম্পিটিশন! কী নিয়ে?" "ওরে তেমন কিছু নয়। পিঠেপুলি বানানো নিয়ে কম্পিটিশন। শোন রে নাতবৌ, তোকে কিন্তু আমার মান রাখতে হবে। আমি বড়ো মুখ করে তোর শাশুড়িকে বলেছি যে তুই এই পরীক্ষা ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করবি!” "এসব কী বলছো ঠাম্মি! আমি তো জানিই না কী করে এসব বানাতে হয়। আমি তো গো হারা হব!" "ওরে ভাবিস না তো। আমি তো তোর সঙ্গে আছি। শোন তবে, বাঙালের মেয়ে, তোর শাশুড়ি বাপের ঘর থেকে ওর মায়ের কাছ থেকে সব শিখে এসেছিল। একে বাঙাল তাতে বরিশাল। ওদের দেশের রকমারি পিঠে, নবান্ন, ইলিশ ভাপা বানিয়ে আমার ছেলেটাকে হাত করে নিল। যাই রান্নাবান্না করে দেখি কর্তামশাই আর আমার ছেলেটা হাত চেটেপুটে খায়। আস্তে আস্তে কখন যে ও মেয়ে আমার রান্নাঘর আর রান্নার সুনামগুলো নিজের করে নিল বুঝতে পারলাম না। সংসারে সকলে দেখি তোর শাশুড়ির নামে এক হাত গড় করে।" "আর তুমি, ঠাম্মা?" "আমি আর করি কী, চুপচাপ রান্নাঘর থেকে সরে দাঁড়ালাম আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকলাম। এখন তোকে পেয়েছি। শোন, তোকে চুপিচুপি আমার সব এস্পেশাল রান্না শিখিয়ে দেব। পারবি তো তোর শাশুড়ি র সঙ্গে টক্কর দিতে? আর আমিও দেখে দেখে শিখে নিয়েছি বাঙালদের পিঠে বানানো। কী রে নাতবৌ, চুপ করে আছিস কেন? কিছু বল।" "না, আমি ভাবছিলাম, শাশুড়ি মায়ের এতদিনের অভ্যেস। আমার তো ভেবেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমি কী করে ওনার সঙ্গে পারব?" "ওরে তোকে পারতে হবে না। তুই শুধু আমার সঙ্গে থাকবি, হাতে হাতে গুছিয়ে দিবি। খুন্তিটা নাড়ব আমিই।" মাস দেড়েক আগে এ বাড়ির একমাত্র ছেলে দীপ্যমানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে দিয়ার। অন্যান্য দিনের থেকে একটু তাড়াতাড়ি উঠে একেবারে স্নান সেরে একটা নতুন কুর্তি পরে বসার ঘরে এসে দেখে শ্বশুর মশাই আর শাশুড়ি মা চা খাচ্ছেন। তাকে দেখেই শাশুড়ি দেবলা জিজ্ঞেস করলেন, "কী ব্যাপার দিয়া? আজ এত সকাল সকাল উঠেছিস? কোথাও যাবি নাকি?" "না, এমনি।" ওনাকে বলা যাবে না। ঠাম্মি আগেই বলে রেখেছেন সব ব্যাপার হবে চুপিচুপি। দেবলাকে জব্বর সারপ্রাইজ দিতে হবে। দেবলা জানালেন, “আমি শপিং এ যাচ্ছি। তুই তাহলে আজ বরং বাড়িতেই থাক। কোথাও বেরোস না। আজ পৌষ পার্বণ। বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণের মধ্যে সবচেয়ে মিঠে পার্বণ আজ। জানিস তো শীতকাল মানেই যেমন কমলালেবু, পিকনিক, বেড়াতে যাওয়ার পাশাপাশি বিদেশিদের কেক, ব্রাউনি,পুডিং এর জন্য স্পেশাল, তেমনি আমরা বাঙালিরা সারাবছর শীতকালের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি নলেনগুড়ের পাটালি, গুড়ের পিঠে পায়েসের জন্য। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে তোর প্রথম পৌষ পার্বণ। তোর বাবা, মাকে ফোন করে বিকেলে আসতে বলছি। সবাই মিলে জমিয়ে পিঠে খাব আর আড্ডা দেব। আমি ফিরে এসে পিঠে পায়েস বানাব।" শাশুড়ি দেবলা বেরিয়ে যেতেই দিয়া ঠাম্মি হেমনলিনীর ঘরে এসে ঢোকে। অবাক চোখে দেখে ঠাম্মাও বেশ রেডি হয়ে গেছেন। ওনার ঘরের নিরামিষ গ্যাসে কাজের মেয়েকে দিয়ে নারকেল কুরিয়ে তাতে গুড় মিশিয়ে পুর বানানো চলছে। নতুন চাল আর পাটালি গুড়ের গন্ধে চারপাশটা সুগন্ধে ম ম করছে। ঠাম্মার হাতে হাত লাগিয়ে একে একে অল্প করে গোলাপ পিঠে, পাটিসাপটা, পুলি পিঠে, দুধ পুলি, মুগসামালি, রসবড়া, মালপোয়া সব সুন্দর করে বুঝে বুঝে শিখে নেয় দিয়া। অবাক হয় দেখে যে সত্যি দিয়া নিজেই এগুলো বানাতে শিখে গেছে। সব পিঠেপুলিগুলোকে ভালো করে ঢেকে রেখে এবার সে উঁকি দেয় শাশুড়ি মায়ের হেঁসেলে। আর চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেয়। সন্ধ্যাবেলা লাল, হলুদ মধুবনী কল্কার সুন্দর একটা সিল্ক শাড়ি পরে দিয়া। চোখে কাজলের প্রলেপ, লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁট রাঙিয়ে লম্বা স্ট্রেটনিং করা চুল খুলে দুহাতে বানানো পিঠের ট্রেটা নিয়ে হাসিমুখে বসার ঘরে ঢোকে। দেখে এর মধ্যেই বাবা, মা চলে এসেছে । শ্বশুর,শাশুড়ি সবাই মিলে গল্প করছেন। ঠাম্মিও বসে মিটিমিটি হাসছেন। "এই তো দিয়া এসে পড়েছে। কিন্তু একী, তোর হাতে এসব কী? ওমা, কী সুন্দর গোলাপ পিঠে, গোকুল পিঠে, রসবড়া, মালপোয়া। এসব কখন করলি দিয়া। আমি তো শুধু পাটিসাপটা আর পায়েস করেছি।" "এ সব আমি আর ঠাম্মা ইউটিউব দেখে বানিয়েছি মামনি। খেয়ে দেখো তো তোমার মতো হল কী না।" দেবলা শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন, হেমনলিনী হাসছেন। দেবলা হেরে গেছেন শাশুড়ি মায়ের কাছে। ঘটির মেয়ে দিয়াকে খুব একটা পছন্দ ছিল না দেবলার। বিয়ের পর এদেশীয়'র বাড়িতে এসে ধীরে ধীরে বাঙালের মেয়ে দেবলা নিজের ছাঁচে সংসারটাকে বেঁধে ফেলেছেন। শাশুড়ি মাও আপত্তি করেননি। বাঙাল আর এদেশীয়দের সব আচার, নিয়মের সঙ্গে সহাবস্থানে নিজের মতো সংসার গড়ে নিয়েছিলেন দেবলা। তাঁর হাতে সব দায়িত্ব দিয়ে ভালোটুকু ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিলেন হেমনলিনী দেবী। আবার সেই ধারাকে মেনে মানিয়ে নিতে দেবলার একটু আপত্তি ছিল। হেমনলিনী দেবীই বলেছিলেন, “চিন্তা করিস না দেবলা। মেয়েরা যতোই আধুনিক পোশাক পরুক, চাকরি করুক,স্বাবলম্বী হোক। আসলে মেয়েরা একটু চেষ্টা করলে সবকিছুই সম্ভব। আমার উপর ভরসা রাখ,জোর করিস না। আমি শিখিয়ে, বুঝিয়ে দেব।" জোড়া চ্যালেঞ্জ জিতেছেন হেমনলিনী দেবী। নাতবৌকে জিতিয়ে সংসারে তার গুরুত্ব আর অবস্হান চিনিয়ে দিয়ে ভরসা জুগিয়েছেন, দিয়া পারে। দিয়ারাও পারে। দিয়ার বাবা,মাও ভীষণ অবাক হয়ে গেছেন। তাদের মেয়ের এই সাংসারিক রূপ দেখে, তার হাতের পিঠেপুলি খেয়ে চোখ জুড়ে আনন্দাশ্রু। "আমি একটু আসছি" বলে দেবলা উঠে যান। একটু পরেই দুটো প্যাকেট হাতে নিয়ে ফিরে আসেন। "এই নিন মা আপনার পুরস্কার। দেখুন বাঙালের মেয়ের রুচি পছন্দ হলো কিনা।" জড়িয়ে ধরেন হেমনলিনী তার বৌমা দেবলাকে ।"তোমার পছন্দে আমার সবসময়ই আস্থা আছে বৌমা!” প্যাকেট খুলে দেখেন ছানার জল রঙের জমিতে নেভি ব্লু আর সবুজ রঙের সুতোর কাজ করা সিল্ক শাড়ি। খুব খুশি হয়েছেন হেমনলিনী। "এবার আমার দোসরের শাড়িটা দেখাও।" ভীষণ চমকে গেছে দিয়া। ততক্ষণে শাশুড়ি মামনি দিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন রানী, হলুদের মিশেলে স্ক্রিপ্ট প্রিন্টের গিচা তসর।" এই নে তোর প্রথম পৌষ পার্বণে নিজে হাতে পিঠে বানানোর উপহার!” "এবার বুঝেছি। এসব তোমার আর ঠাম্মার মিলিজুলি গট আপ কেস ছিল, তাই না? আমি কিন্তু খুব আনন্দ পেয়েছি আজ। বুঝতে পেরেছি আমাদের বাঙালিদের সংস্কৃতি,আচারগুলো আমাদেরই বংশানুক্রমিক ভাবে ধরে রাখতে হবে। না হলে সব হারিয়ে যাবে। আমি গর্ব করে বলি আমি বাঙালি। তবে ঘটি আর বাঙালের কোনো কম্পিটিশনে নেই। তোমাদের দুজনের আশীর্বাদী হাতদুটো আমার মাথার উপর রেখো। দেখো, আমি সব শিখে নেব।" "আর কথা নয় দিয়া। আমার বানানো পায়েস খেয়ে বল কেমন হয়েছে।" সমবেত মিষ্টি মুখের উল্লাসে হেমনলিনী, দেবলা, দিয়ার মধুর হাসিতে, কলরবে পৌষ পার্বণের মিষ্টতা দ্বিগুণ হয়ে যায়। দরজার বাইরে তখন হাড় কাঁপানো হিমশীতল হাওয়া বইছে, আর ঘরের ভিতর তখন সম্পর্কের উষ্ণতায় আপনজনদের মিঠে সখ্যতায় ভরে উঠেছে পার্বণের সার্থকতা।