টমেটো রঙের পুলোভার

মুকুন্দপুর, কলকাতা ৯৯


অঘ্রানের মাঝামাঝি। ঘন হয়ে আসছে শীতের ছায়া, রোদ্দুরের রঙ একফালি ফুটির মত। আবাসনের শ্যামকাঞ্চন গাছগুলো ফুলে ভরে উঠেছে, ছোট্ট ছোট্ট পাখির দল নাচানাচি করে চলেছে এ ডালে,ও ডালে। রাস্তার সবজি ভ্যানে এখন রঙিন জলসা, মুলো, গাজর, ফুলকপি - তিনতলার বারান্দা থেকে দেখতে পান সুমিতা। প্রতিদিন সকালে ওয়াকারটা নিয়ে এসে এখানে বসেই তাঁর ঘন্টাকয়েক কেটে যায়। সামনের ছোট টেবিলে মালতী গুছিয়ে রেখে গেছে রোজকার কাগজ, বইপত্র। গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে আলোয়ান। শীত এলেই একটা জিনিসের জন্য আজও আঙুল নিশপিশ করে সুমিতার - উল আর কাঁটা।

প্রতিবছর দীপাবলি থেকেই বোনা শুরু করে দিতেন নানা রকমের সোয়েটার। মার্কেটে দারুণ সব ডিজাইনার সোয়েটার থাকলে কী হবে, শুভেন্দু আর লাডলার প্রতিবছর তাঁর হাতে বোনা সোয়েটারই চাই। সেই শুভেন্দু - তাঁর স্বামী, মাত্র চল্লিশের কোঠায় তাঁদের দুজনকে ছেড়ে কী দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত চলে গেলেন! শিশু লাডলাকে নিয়ে কেমন করে যে আবার উঠে দাঁড়ালেন, সে তিনিই  জানেন। লাডলা অবশ্য লাখো মেঁ এক - পড়াশোনা, খেলাধুলোয় চৌখস একেবারে। নেশা বলতে শুধু পাহাড়। মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের সদস্য হিসেবে প্রতিবছর একবার অন্তত সে যাবেই, - দুর্গম থেকে দুর্গমতর শীর্ষে। টমেটো রঙের দারুণ পুলোভারটা বুনে রেখেছেন ওর জন্য, যত্ন করে রেখে দিয়েছেন ওরই আলমারির মধ্যে ,- কী নরম আর নিখুঁত! বারবার হাত বোলাতে নিজেরই ভাল লাগে সুমিতার।

পিক্ পিক্ পিক্ পিক্ - কলিং বেলের পাখির ডাকটা বেজে উঠল- একবার, দুবার। হোম ডেলিভারির ছেলেটি নিশ্চয়। কী যে নির্মল হাসিতে ভরা মুখখানি ওর! ওয়াকার নিয়ে দরজা খুলতে এগিয়ে যান সুমিতা। হাত বাড়িয়ে টিফিন ক্যারিয়ারটি নেওয়ার মুহূর্তে পা ফসকে যায়, টলে পড়ে যাবার আগেই দুটো সবল হাত ধরে ফেলে তাঁকে, “আম্মি!”

আম্মি!! চমকে তাকান সুমিতা! সেও তো ডাকত এই নামে, আম্মি, মাম্মি, সুম্মি ... আরও কত কী!  
তাঁকে ঠিকঠাক দাঁড় করিয়ে সে বলল, “আপনার ব্যথা লাগে নি তো ম্যাম্?” 
ওর বাঁদিকের কপাল ঘেঁষে একটা কাটা দাগ, কই,আগে নজরে পড়েনি তো! একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সুমিতা - আজ এক বছর হতে চলল, অন্নপূর্ণা এক্সপিডিশন থেকে ফেরেনি সে, শেষ খবর অনুযায়ী কোনও গভীর গিরিখাতের কোলে হয়ত ....শুধু সুমিতার অপেক্ষারা ঠায় জেগে রয়ে গেছে টমেটো রঙের পুলোভারে।

“ম্যাম্!”
সম্বিত ফিরে পান সুমিতা, “ম্যাম্ নয়,আম্মি বলো। এমন ঠান্ডায় গরম জামা পরনি কেন শুনি? আচ্ছা, একটু দাঁড়াও, আমি আসছি!”
ওয়াকার নিয়ে ধীরে ধীরে লাডলার শোবার ঘরের আলমারির দিকে এগিয়ে যান সুমিতা। 

6 Responses

  1. রত্না says:

    খুব সুন্দর হয়েছে। আশা করি আরো পাবো ছোটো গল্পঃ

  2. Debdas Banerjee says:

    অপূর্ব, মন ছুঁয়ে গেল এমন মর্মস্পর্শী লেখায়।

  3. Sutapa says:

    বড়ো ভালো, বুকের মোচড় টা ব্যথা দিচ্ছে

  4. Buddhadev Chatterjee says:

    Outstanding.

  5. শম্পা শুচিস্মিতা says:

    অপূর্ব!

  6. Ratna Chattopadhyay says:

    কী যে সুন্দর লেখা … শেষের দিকে লেখা গুলো সব কমন ঝাপসা হয়ে গেল

বৈশাখী ২০২৪