নীল খামে শীতের গান

সল্টলেক সিটি, কলকাতা

শীতের সকাল। বারান্দায় মিঠে রোদের আমেজ। আজ একবার পুরোনো সিন্দুকটা খুলে দেখবেন সুধাময়ী। প্রত্যেক বছর শীতে এই পুরোনো গরম জামাকাপড়গুলো রোদে দেন। শুধু তো সেগুলি একেকটা সুতি পশমের জড় বস্তু নয় তাঁর কাছে, একেকটি মুহূর্ত - একেকটি স্মৃতি। 
ইজিচেয়ারে পিঠ এলিয়ে বসেছেন, হাতে উঠে আসছে কম্বলের ওম, ছেঁড়া কলারের সোয়েটার, পেঁজা তুলোর কুঁচি, নরম নরম ন্যাতানো কাঁথা।
নানা রঙের ফোঁড় তুলে তৈরি করেছিলেন বড় মেয়ের ছেলের জন্য দুখানি বাহারি কাঁথা। খুব প্রশংসা পেয়েছিলেন সুধাময়ী, পাড়া পড়শিরা সবাই সুধার হাতের সেলাইয়ের সুখ্যাতি করতেন।
শুধু কি গরম পোশাকের স্মৃতিটুকু ভাসছে সুধাময়ীর মনের আকাশে?
না, শীতের ঠান্ডা সরপড়া রোদে ভেসে আসছে নতুন গুড়ের গন্ধ ভরা পাটিসাপটা, পায়েস, রসবড়া, চিতই পিঠের আস্বাদ, কখনো পোড়া পিঠের তিক্ত কষায় স্বাদ।
ঘি ঘি রঙের উপরে একটু কালো বর্ডার দেওয়া হাতকাটা সোয়েটারটা সেবারের শীতে বুনেছিলেন তিনি, বড় ঠান্ডার ধাত ছিল যে ছেলেপুলের বাবার। এই মাফলারটা গায়ে চড়িয়েই হরিসভায় গান ধরতেন স্বামী।
রোজকার উনুনের ধারে একা একা তপ্ত ভাজা হতে হতে উত্তপ্ত হয়ে উঠত বিরহিনী সুধার ফর্সা গাল, ঘেমে একসা হতেন তিনি। 

খোলা সিন্দুকটি যেন ম্যাজিক বক্স - হাতের মুঠোয় উঠে এসেছে সেই নীল খামের চিঠি।
ছুঁলেই আজো ছ্যাঁকা লাগে।
বই এনে দিতেন অতীন ঠাকুরপো, স্বামীর দেশের সম্পর্কে তুতো ভাই। একেবারে গোগ্রাসে গিলতেন সুধা। আড়ালে আবডালে দুএক কথা কানে আসেনি যে তা নয়, তবে নিকষিত হেমের মতোই ছিল বৌদি দেবরের মিষ্টি সম্পর্ক।
তাই খোলা হাওয়ার মাঝেই দিন কাটতো সুধার।

শুধু একদিন - একদিন ছাদের উপর আচমকা কী যে হল! সেদিনটা যেন বড্ড বেশি বেশি শীত পড়েছিল। জামাকাপড়ের বোঝা নিয়ে সন্ধ্যা প্রদীপ দেওয়ার জন্য নেমে আসছিলেন সুধা।
অতীন এসে দাঁড়িয়েছিলেন ছাদের আলসেতে,  দুজনের চোখ যেন হঠাৎ মিলেছিল এক নিবিড় নদীর তীরে - জলের খোঁজে, জমাট ঠান্ডার আঁধারে আলোর ফুলকি ছড়িয়ে। 
এক ছুটে নিচতলায় পালিয়ে এসে সশব্দে বন্ধ করে দিয়েছিলেন সুধা সমস্ত খোলা জানলা। 
নীল খামের চিঠিটা এসেছিল তার কয়েক মাস পরে - চুপচাপ সেই চিঠি পড়া - তারপর বন্ধ সিন্দুকের মধ্যে ঠাঁই নিল সেটা। সুভদ্র বিনয়ে সামান্য কিছু শব্দ ছিল তাতে - মধুরতার ছোঁয়া মাখানো।

থাকুক সেই চিঠি আজও বন্ধ ঘরের ছোট্ট নিরিবিলিতে, সুধাময়ীর মনের আকাশে এক টুকরো নীল দিগন্ত হয়ে। 
সুধাময়ী এবার শীতের রোদ খাওয়াবেন পুরোনো জামাকাপড়গুলোকে।

বেলা যে পড়ে এল!

বৈশাখী ২০২৪