পৌষের গন্ধ

রাজ নারায়ণ বিশ্বাস লেন, কলকাতা


অনেকদিন ধরে সরষের তেল মাখলে যে তেলচিটে গন্ধটা ছাড়ে, পঞ্চাননকাকার গা থেকে আসছে সেটা। বাসে আর সরে বসার জায়গা নেই। ক্রিসমাসের ছুটিতে শঙ্করপুর যাচ্ছে সরসিজ। সি সাইড না। আরামবাগ থেকে বাসে ঘন্টাখানেক দূরে সরসিজদের দেশের বাড়ি। খুব ছোটবেলায় কয়েকবার গেছে। কিন্তু বড় হয়ে সেভাবে আর যাওয়া হয়নি। বাবা, জ্যাঠারাই যেতেন। এবার জ্যাঠা জ্যেঠিমা পন্ডিচেরিতে আশ্রমে, বাবা নেই, কাকার আসার ইচ্ছা নেই। তাই পঞ্চানন কাকা কলকাতায় এসেছে ওকে নিতে। সরসিজের ওপর দায়িত্ব এবারের ধান্যলক্ষ্মীর পুজো অ্যাটেন্ড করার। 

সরসিজদের সারা বছরে চারটে লক্ষ্মীপুজো। তিনটে কলকাতার বাড়িতেই হয়। কিন্তু এই পৌষমাসের পুজোটা দেশের বাড়িতেই হয়। নতুন ধান দিয়ে এই পুজোটা হয়। এই নতুন ধান আসে ওদেরই দেবত্র কয়েক বিঘা জমি থেকে। এই জমিটার দেখাশোনার ভার ওদের একসময়কার ভাগচাষী পঞ্চাননকাকার ওপর। পঞ্চাননকাকাকে ওদেরই ভিটেবাড়িটায় সপরিবারে থাকতে দিয়েছিলেন সরসিজের বাবা আর জ্যেঠা। এটা নিয়ে কাকা কাকিমার রাগ আছে। বর্গা হয়ে জমি বেদখল হবার সময়েও এই ভিটে আর মন্দিরের সংলগ্ন জমি এই পঞ্চাননকাকাই আগলে রেখেছিলেন। কিন্তু তাই বলে অব্রাহ্মণ পঞ্চাননকাকাকেই মন্দিরের ও জমি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে ভিটেয় এনে তোলাতেই ওনাদের আপত্তি। সরসিজ ছাড়া বাড়ির আর কেউই তাই আসতে রাজি হল না। পঞ্চাননকাকা নিজেই কলকাতায় এসেছিলেন। পুজোর কিছু কেনাকাটা করারও ছিল। একেবারে সরসিজকে নিয়েই ফিরছেন। 

শঙ্করপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে নামতেই সরসিজ দেখল বাসরাস্তা, মিষ্টি, সিঙাড়া কচুরির দোকান, একটার ওপর আরেকটা টো করে রাখা ধুলোমাখা কটা সাইকেলভ্যান ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই। ক্রিসমাস বা নিউইয়ার কাকে বলে তা এখানকার লোক জানে না। অবশ্য সরসিজ সেসব আশাও করেনি। বাবা মারা যাবার আগে বড় বেশি দেশের বাড়ির কথা বলতেন। কী এমন গুপ্তধনের টান শঙ্করপুরের, সেটাই খুঁজতে এসেছে সে। তাই পঞ্চাননকাকা যখন 'এসো ভাইপো' বলে হাঁটা দিলেন, হাতে ধরা পিঠটুটা পিঠে গলিয়ে সেও লম্বা পায়ে অনুসরণ করল। 

“এই যে সব কলাবাগান দেখছো, এসব তোমাদের ছিল। আর ওই যে আলটা, ওখানে একটা মধুগুলগুলি আমগাছ। আর ওই যে, গর্তমত, ওইটে হল মাঝপুকুর। এখন জল টেনে গেছে। আর এই রাস্তার জমিটাও তোমার ঠাকুরদাদা পঞ্চায়েতকে দান করেছিলেন। বুঝলে...”

সরসিজ শুনছিল কিছু কিছু। ভোররাতে বেরিয়েছিল একটা মোটা জ্যাকেট চড়িয়ে। এখন রোদ চড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে গরম লাগছে। তাই আগে ব্যাগটা একহাতে নিয়ে জ্যাকেটটা খুলতে লাগল। সেই দেখে কাকা দাঁড়িয়ে গেলেন। জ্যাকেটটা খুলে পিঠটুতে ঠুসে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পৌষের রোদ্দুরকে কাঁচকলা দেখিয়ে কলাবাগানের ভিতর দিয়ে বয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়া তার শরীরে হাত বুলিয়ে দিল। শীতের এ হাওয়াকে শহরের ছেলে চেনে না। সরসিজ চোখ বুজে একটা মস্ত করে শ্বাস নিল। 

“মিঠে গন্ধ পাও?”

কাকার প্রশ্নের উত্তরে সে নেতিবাচক ঘাড় নাড়ল। 

“কাল কাকাকে খেজুরের রস খাওয়াতে হবে রে গুড়গুড়ি!”

উত্তরে পঞ্চাননকাকার পিছন থেকে খিলখিলিয়ে হাসি ভেসে এল। তারপরেই সরসিজ দেখল কাকার পিছন থেকে একটি পুঁচকে মেয়ে টুকি দিচ্ছে। চুলে বেড়াবিনুনি। নাক বিঁধিয়েছে সম্প্রতি। একটা ময়লাটে সুতো গিঁঠ মারা নাকের পাটায়। একটা সবুজ ফ্রকের ওপর একটা বড়সড় সোয়েটার পরনে, যেটার তলা থেকে অলরেডি উল খুলতে শুরু করেছে। 

“শম্ভুর মেয়ে গো ভাইপো। ইশকুলে ঘড়ি দেখতে শিখেছে। বাসের টাইমে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। হাতে পায়ে দস্যি।। মা মরা মেয়ে। ওকে বকলে ওর ছোটমা আবার রাগ করে!”

গুড়গুড়ি তখনও সরসিজকে মন দিয়ে দেখছে।বি শেষ করে তার মিরর এফেক্টের সানগ্লাসটির প্রতি তার বিশেষ নজর দেখা যাচ্ছে। ওদিকে আপন মনে বকবক করতে করতে পঞ্চাননকাকা হাঁটা দিয়েছেন। সরসিজও হাঁটা লাগায়। গুড়গুড়ির বোধহয় তাকে দেখা হয়ে গিয়েছিলো। সে হাওয়াই চপ্পল পায়েই প্রায় উড়ে চলে যায় উল্টোদিকে। 

***************

“এইটা কী?”

হতভম্ব সরসিজ একটা পেতলের জগের মত জিনিস নিয়ে একটি বউকে এগিয়ে আসতে দেখে পঞ্চাননকাকাকে জিজ্ঞেস না করে পারে না। জিনিসটার একটা সরু লম্বা গলা। পিচকিরি নাকি! কিন্তু এখন তো দোল না। পরনের হাল্কা আকাশি টিশার্টটি খুব দামি। বউটি তার মুখভঙ্গি দেখে খিলখিল করে হেসে ওঠে। পঞ্চাননকাকা তাকে বকে দেন “তোমার শাশুড়িমা বলেছে বুঝি ভাইপোর পা ধুইয়ে দিতে? এখন এসবের চল নেইরে বাপু। এরম করলে ছেলেটা ভয়ের চোটে আর আসবে না!”

মেয়েটি হাসতে হাসতেই বলে 'আমি কি বলিনি বাবা? মা শুনলে তো। গাড়ু মাজিয়ে জল তুলে রাখিয়েছে। তারপর রান্নাঘরে ঢুকেছে। বারণ করছি, শুনছে না।” তারপর সরসিজের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি ভাই কলতলায় হাত পা ধোবে না বাথরুমে জল তুলে দেব? আগে বরং জামাকাপড় পাল্টে নাও।”

সরসিজ হাঁফ ছেড়ে বলে, “বাঁচালে বউদি। আমি ভাবছি কী না কী!”

বউটির পিছনে গুড়গুড়ি এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল। এইবার সেও উঁকি দিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল। 

********

বাড়িটি একতলা। অনেকগুলি ঘর। দেওয়াল অস্বাভাবিক মোটা। কাকা বললেন মাঝে পুরনো মাটির দেওয়াল রেখেই সিমেন্ট দিয়ে গাঁথিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঘরগুলি গরমকালে ঠান্ডা, শীতকালে গরম। তার জন্য একটি ঘর আলাদা করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পিঠটুটা নামিয়ে সবে সে ভালো করে ঘরটা দেখছে ঘরে ঢুকলেন ঘরোয়া করে চওড়াপাড় তাঁতের শাড়ি পরা এক ফর্সা বেঁটেখাটো মহিলা। উনি সরোজা, পঞ্চাননকাকার স্ত্রী। 

ওনার ছানি অপারেশন হয়েছে। ঘরে আলো বিশেষ নেই, তায় কালো চশমা, উনি সরসিজের মুখে হাত বুলিয়ে চিবুক ছুঁয়ে আদর করে বললেন 'ছোটবেলার ঝগড়া এ্যাদ্দিনে ভুললি বাবা?' সরসিজের নাকে তখন বাটা মশলার হাল্কা গন্ধ। 

***********

শম্ভু প্রায় সরসিজেরই বয়সী। বাজার থেকে সে ফিরল প্রায় বারোটা নাগাদ। সরসিজের মনে আছে ছোটবেলায় শেষবার জ্যেঠার সঙ্গে শঙ্করপুর এসে তারা গেছিল পুকুরে স্নান করতে। তখন বাড়িতে টিউবওয়েলও ছিল না। শম্ভু সাঁতার জানলেও সে জানত না। কিন্তু পাকামি করে শম্ভু তাকে জলে নামিয়েছিল সাঁতার শেখাবে বলে। শেষে দুজনেরই ডোবার জোগাড় হয়। শম্ভুই অবশ্য তাকে টেনে তুলেছিল ডাঙায়। কিন্তু তারপরেই গজকচ্ছপের যুদ্ধ বেধে গেছিল। কে একটা পঞ্চাননকাকা আর জ্যেঠাকে খবর দিতে তাঁরা এসেও শম্ভুকে নির্দম মার মেরেছিলেন। শম্ভু শাসিয়েছিল তাকে দেখে নেবে বলে। বিকেলে খেলার মাঠে তার মাথায় শুঁয়োপোকা ছেড়ে দিয়েছিল। এরপর জ্যেঠা আর কোনোদিন তাকে এখানে আনার সাহস পাননি। 

অবশ্য সরসিজের কী আর সাহস আছে তার খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের ওভাবে শাসন করার? এখনকার সম্পর্ক অনেক ফর্মাল। জ্যেঠতুতো দাদার বউ রুমেলা বউদিকে সে একবার পাঁচ বছরের মেয়েকে ফিসফিস করে বলতে শুনেছিল দাদুরা বা কাকারা একা থাকলে ডাকলে কাছে না যেতে। সেইদিন থেকে সে অতিমাত্রায় গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। 

শম্ভু এসেই নিচ থেকে 'এই সরষে, কই গেলি?' বলে হাঁক পাড়তেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। শম্ভু তাকে “কীরে সরষে, আরেকবার সাঁতার শিখবি নাকি?” বলেই বুকে জড়িয়ে ধরল। এর আধঘন্টা পরেই সরসিজ পঞ্চাননকাকার সব কথা একান দিয়ে ঢুকিয়ে, ওকান দিয়ে বার করে একটা বারমুডা সম্বল হয়ে চলল পুকুরে। সঙ্গে শম্ভু, হাতে ছোট একটা মাছ ধরার জাল। ওদের পাশে ছোট্ট ছাগলছানার মত তিড়িংবিড়িং করে চলেছে গুড়গুড়ি, হাতে প্লাস্টিকের বোতলে সরষের তেল। 

***************** 

জলে নামার আগে তেল মাখতে মাখতে শম্ভু সরসিজকে বলল তার প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর কথা। শম্ভুর প্রথম বিয়েতে বাড়ির বড়রা আসলেও সরসিজ ছিল রাজ্যের বাইরে। খুড়তুতো জ্যেঠতুতো ভাইবোনরা কেউ আসেনি। ছবি দেখেছিল, নামেও প্রতিমা, দেখতেও তাই ছিল সেই বউদি। একবার কাকা ছেলেবউ নিয়ে তাদের বাড়ি ঘুরিয়ে এনেছিলেন। তখন সরসিজ দেখেছিল তাকে। মিষ্টি স্বভাবের গ্রাম্য গৃহবধূ। গুড়গুড়ির মুখে তার মুখের সেই আদল কিছুটা হলেও যেন ধরা আছে। প্রসবে জটিলতা ছিল। গুড়গুড়ির জন্ম দিতে গিয়েই সে পৃথিবীর মায়া কাটায়। তারপর এই দ্বিতীয় বিবাহ। চুপচাপ, কম আয়োজনে সারা। কল্যাণী, তার দ্বিতীয়া স্ত্রী, গুড়গুড়িকে মায়ের মতোই ভালোবাসে। শম্ভু সেদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত। কিন্তু সরসিজের বিয়ে নিয়ে তার খুব চিন্তা। সরসিজ যখন তাকে বলল 'আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে ভাববো',শম্ভু অবাক হয়ে জিগেস করেছিল, “গোছাবিটা কী? বুড়ো হতে চললি। সংসারই তো নেই। ছেলেপুলে হবে কবে? মানুষ করবি কবে রে সরষে?”

সরসিজ আর তাকে বোঝানোর চেষ্টা না করে মাছ ধরতে বেশি উৎসাহিত করতে লাগল।  

জালে কয়েকটা চুনোচানা মাছ উঠল। ওরাও স্নান সেরে বাড়ির পথে ফিরছে, সরসিজ টের পেল ভিজে গা মুছে গামছা জড়িয়ে বাড়ি ফেরার আইডিয়াটা মোটেও ভালো ছিল না। চড়চড়ে রোদেও পৌষের শীত কামড় মারতে ছাড়ছে না। গুড়গুড়ির অবশ্য হেলদোল নেই। সে খালের জলে স্নান করেনি। শম্ভু জিগেস করাতে নাকের সুতোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছে, “ভিজে গেলে গ্যাঁজ হয়ে যাবে, মা বলেচে!”

****************

দুপুরে মাটিতে আসন পেতে বসে সরসিজ খেল শুক্তো, কলমি শাক, মুগডাল, আলুপেঁয়াজ ভাজা, মাছের কালিয়া ধরনের একটা ঝোল , চুনোমাছের টক আর নাড়ু। আলুপেঁয়াজ ভাজা যে তার প্রিয় সে কথা কাকিমা আজও মনে রেখেছে। স্বল্প আয়োজনেই পেট প্রায় ফাটো ফাটো অবস্থায় খেয়ে তার বউদির পরিবেশন বন্ধ করতে হাতে পায়ে ধরতে বাকি ছিল। তার অবস্থা দেখে সব হেসে কুটিকুটি। 

মা সবার জন্য জামাকাপড় পাঠিয়েছিলেন। সেটা সরসিজের পিঠটুতে ঢোকেনি। ওতে ক্যামেরা আছে। অগত্যা কাকার ঢাউস ব্যাগেই রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে বার করে সবার হাতে হাতে দিল। সব থেকে বেশি খুশি গুড়গুড়ি। যদিও তার ফ্রকটা তার শরীরের থেকে প্রায় দু সাইজ বড়। 

তাদের পুজো সকালে হয়। আজ থেকে কিছু গোছগাছ করে না রাখলে কাল সারা মুশকিল। ভারী কাজও আছে। শম্ভুকে বাড়িতে থাকতে হবে। তাই খাওয়া দাওয়া সেরে শম্ভুর সঙ্গে একটু গ্রামে ঘুরে ছবি তোলার ইচ্ছেটা সে ত্যাগ করবে ভাবছে, শম্ভু তাকে বলল গুড়গুড়িকে নিয়ে একটু ঘুরে আসতে। সরসিজ জানে তা না করলে সে রাতে আর এক গ্লাস জলও খেতে পারবে না। 

***************

“এই দেখো কাকু, এটা বাড়ির ক্ষেত।”বাড়ির পিছনে লাগোয়া একটুকরো জমি দেখিয়ে বললো গুড়গুড়ি। 

“বাড়ির ক্ষেত মানে?” সরসিজ একটু অবাক। 

“মানে এতে যে সবজি হয় তাতে বাবা প্যাকেটের সার দেয় না। খালি গোবর আর খোল দেয়। এটা আমাদের বাড়ির জন্য। বড় জমিতে সাদা থলির সার, পিচকিরি সার, সঅঅঅব দেয়। ওইখানকার সবজিগুলো সব বড় বড় আর সুন্দর। এখানে বড্ড পোকা, জানো। পোকাওয়ালা জিনিস খাওয়া ভালো? তুমিই বলো। আমার বাবাটা না, একদম বোকা। কিচ্ছু জানে না।!”

“তোর নাম গুড়গুড়ি না হয়ে পাকুবুড়ি হওয়া উচিত ছিল।!” বলে হো হো করে হেসে ওঠে সরসিজ। 

“বাঁশবাগান দেখবে কাকু?” গুড়গুড়ি পরবর্তী গন্তব্য ঠিক করে ফেলেছে। আরও বলে ,“সন্ধ্যায় ওখানে গেলে ভূতে ধরবে। গেলে এখুনি চলোওওও”বলে সরসিজের হাত ধরে ঝুলে পড়ল...

********************

দোষটা দুজনেরই। সরসিজ ছবি তুলতে আর গুড়গুড়ি ভূতের রাজার খোঁজ করতে করতে দেরি হয়ে গেল। ওরা যখন বেরিয়ে আসছে বাঁশবাগান থেকে তখন সন্ধ্যার উত্তুরে হাওয়ায় বাঁশবাগানে নানারকম অপার্থিব শব্দ। গুড়গুড়ির সব সাহস উধাও। খামচি মেরে ধরে আছে সরসিজের হাত। 

বাড়ি ফিরেই দুজনে একচোট বকা খেল। পঞ্চাননকাকা আর কাকিমা অস্থির হয়েছিলেন। ওরা বাঁশবাগানে গেছে এ খবর পেয়ে ইস্তক নাকি দুজনকে ঝাড়ানোর জন্য শুকনোলঙ্কা আর সরষে পুঁটুলি করিয়ে রেখেছেন কাকিমা। কল্যাণী সেইটা এনে ওদের দুজনের সারা শরীর ঘিরে বেশ কয়েকবার ঘুরিয়ে উঠোনের কোনে পাটকাঠির আগুন করে পোড়াল। এই পদ্ধতিটা ছোটবেলায় ঠাকুমাকেও করতে দেখেছে। কুসংস্কার হলেও সরসিজের মনে নস্টালজিয়ার ছোঁয়া।

ঠান্ডা বাড়ছিল। গরমজামা গলিয়ে বাইরে আসতেই মৌরির একটা পরিচিত গন্ধ পেল। সরুচাকলি হচ্ছে। নিজের ঘ্রাণশক্তিতে লজ্জাই পেল সরসিজ। কাকিমা মনে রেখেছে এটাও। তাদের কলকাতার বাড়ির ননস্টিক ফ্রাইং প্যানে এক দুবার এ জিনিস মা করেছে। কিন্তু সেই স্বাদ হয়নি। সে গুটিগুটি পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। 

গুড়গুড়ির সামনে সরুচাকলির থালা, আর তার পাশে গুড়ের বাটিটা নানা স্টাইলে রেখে ওর ছবি তোলা দেখে শম্ভু আর কল্যাণী হেসে বাঁচেনা। গুড়গুড়ি কিন্তু ছবি তোলা নিয়ে খুব খুশি। শেষে কাকার এক ধমকে দুজনে খেতে বসল। গুড়গুড়ি ফিসফিস করে তাকে বলল, “কাল ভোরে একটা মজা হবে গো!”

পেট আর মন দুইই ভরে ছিল। রাতে আর কিছু খাবে না বলে দিল সরসিজ। বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। মা জানতে চাইছিলেন ওর কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, কাল পুজো শেষ হবার পরেই ও রওনা দেবে কিনা... এইসব...ঘুমে জড়িয়ে আসা চোখে কী যে উত্তর দিল কে জানে। 

******

খুটখুট শব্দে জম্পেশ ঘুমটা ভেঙে গেল সরসিজের। জানলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দেখলোবাইরে অন্ধকার। বাড়িতে হলে ও কিছুতেই বালাপোষ থেকে বেরত না। কিন্তু এখানে ব্যপার আলাদা। দেখতেই হয়, কোনো বিপদ আপদ হল কিনা...ডাকাত পড়েনি তো? 

“কাকুগোওওও,” ফিসফিসিয়ে গুড়গুড়ির গলা। 

‘কী সর্বনাশ!’ ভাবে সরসিজ। 

তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজা খোলে। পাল্লা খানিক ফাঁক হতেই টুক করে ঘরে গলে আসে গুড়গুড়ি। হাতে একটা প্লাস্টিকের বোতল। 
“এই নাও। খেজুরের রস!”

“তোর মা বাবা জানে?”

“মা ঘুমোচ্ছে। বাবা বাইরের দরজা বন্ধ করে আসছে।”

বলতে বলতে ঘরে ঢোকে শম্ভু, “খেয়ে নে। তোর জন্য পাড়লাম!”

“অ্যাঁ? এই অন্ধকারে গাছ বেয়েছিস রসের জন্য? তুই কি পাগল?”

“আরে শহরে পাবি এ জিনিস?” বলে নিঃশব্দে হাসে শম্ভু। তারপর মুখে আঙুল রেখে বলে, “কিন্তু কল্যাণী যেন টের না পায়। তাহলে আমাদের বাপ-বেটির কপালে দুঃখ আছে!”

সরসিজ বোতল থেকে অমৃত গলায় ঢালতেই বাপ বেটির উৎসুক চোখ খুশিতে ঝিলমিল করে ওঠে। 

******************** 

শাঁখ বাজানোর শব্দে ঘুম ভাঙলোসরসিজের। বুঝল লক্ষ্মীর আসন পাতা হল। ও আড়মোড়া ভেঙে মনে করার চেষ্টা করলো ভোররাতে যেটা দেখেছে সেটা স্বপ্ন কিনা। কিন্তু মাথার পাশে টুলে এখনও খালি বোতলটা রাখা। সেটা টুক করে খাটের নিচে চালান করে দিয়ে জ্যাকেটটা গায়ে গলিয়ে চপ্পলজোড়া খুঁজতে লাগল। ওর নাকে ভেসে আসছে হাল্কা আতপ চালের গন্ধ। খুব সম্ভবত বারান্দায় আলপনা দেওয়া হচ্ছে। কলকাতায় থাকতে ও জানতোই না ওর ঘ্রাণশক্তি এতো প্রখর। 

“দেখছো কী ভাই? অনেক কাজ। আজ দেরি কোরোনা। পারলে একটু তাড়াতাড়ি চানটা সেরে নাও!” বলে কল্যাণী। 

“হ্যাঁ, এই যাই। গুড়গুড়ি কই গো?”

“দেখো গিয়ে, শিশির তুলছে হয়তো ”

সরসিজের মনে পড়ে ছোটবেলায় পুজোতে শিশির জমিয়ে চন্দন ঘষার রীতি তাদের। 

ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে পুকুরের দিকে এগোয় সে। একটু পরেই নতুন জামা পরা গুড়গুড়িকে দেখতে পায়। একটা ছোট্ট চন্দনের বাটি হাতে পুকুর ধারে কচুপাতাগুলো কাত করে করে জমে থাকা শিশির ঢেলে নিচ্ছে, আর মাঝে মাঝে একটু করে নাকের বেঁধানো পাটাটায় লাগাচ্ছে। দূর থেকেই গুড়গুড়ির অনেকগুলো ছবি তুলে ফেরে ঘরে। 

ফোনের রিংটোনটা বাইরে থেকেই শোনা যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে হাতে নিয়ে দেখল মা কল করছে। 

“কী রে, কাল তো ঘুমিয়েই পড়লি। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? আজ বিকেলেই ফিরছিস তো?”

বাইরে থেকে শম্ভুর ডাক আসে, “সরষে, এই সরষে...চানে যাবি তো চ...”

সরসিজের নাকে চন্দন, আতপ চাপ, নতুন গুড়ের গন্ধ ভেসে আসে। মুখে হাসি খেলে যায়, বলে, “না মা, আমি দিনকয়েক থেকেই আসব। এখন যাই। পুজোর ঢের কাজ আছে!” বলে ফোনটা কাটে। তারপর গলা তুলে বলে “আসছিইইইই।” 

2 Responses

  1. সৌমেন দাসগুপ্ত says:

    প্রতিটি শব্দ যেন একেকটি চিত্রকল্প তৈরি করেছে। কত নতুন শব্দ আর চিত্র যে গেঁথে গেল। সুন্দর,কোমল খেলহ।

  2. Tanusree Sarkar says:

    Awesome awesome awesome…mon vote

    Gondho nilam…pran vore galo….

বৈশাখী ২০২৪