বরফমুড়ি ডালহৌসি


“Didn't you wonder why it never fluttered or moved when the wind blew? Ah, darling, it's Behrman's masterpiece—he painted it there the night that the last leaf fell”
ও. হেনরির লেখা 'দি লাস্ট লিফ' এর অনুকরণে তৈরি হয়েছিল হিন্দি চলচ্চিত্র 'লুটেরা'। সেটা ২০১৩ সালের ঘটনা। তখন বরফঢাকা সাদাচাদরের সবটাই ছিল স্বপ্নরাজ্য। অধরা তখন উইন্টার ওয়ান্ডারল্যান্ড। এখন নিউ জার্সির প্রখর ঠাণ্ডায় শীতকামড় বসিয়ে দেয় তুষারপাত কিন্তু তখন সবটাই ছিল সিনেম্যাটিক। শীতকালের মিঠেকড়া রোদে চাদরমুড়ি দেওয়া সদ্যবিবাহিত প্রেম তাই ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিল 'লুটেরা' ছবিতে 'পাখি' আর 'বরুণ' এর সেই বরফমোড়া ফ্রেম। রবিবারের বায়োস্কোপ বারবেলায় দুই ভ্রমণপিপাসু মানুষের মনে প্রশ্ন আসে, এমন স্বর্গরাজ্য কোথায়? বিদেশে শুটিং তো মনে হচ্ছে না! খোঁজ করতেই গুগল জবাব দেয়, এ হল ডালহৌসি - মিনি সুইজারল্যান্ড অফ ইন্ডিয়া। বানজারা মন তখন ছুটে চলে সেই লাস্ট লিফের খোঁজে। যেখানে শিল্পীর তুলিতে প্রাণ পায় ন্যাড়া হয়ে যাওয়া গাছ। সেই বরফমোড়া শীতলপাটিতে জীবনের উষ্ণতা খোঁজে নীলচে স্নো বাইট।  যেখানে বিশ্বাস হারায় না পরিযায়ী প্রতিশ্রুতিরা। হিমাচল প্রদেশের “হিডেন ট্রেসার” ডালহৌসি আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে শীতগল্পের মধুবাসরে।

যেহেতু বরফ দেখাটাই প্রধান ইচ্ছে, তাই আমরা ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে রওনা দিই ডালহৌসির উদ্দেশ্যে। তখন আমরা গুরগাঁওতে থাকতাম। তাই নতুন দিল্লির কাশ্মীরি গেট থেকে হিমাচল রোড ট্রান্সপোর্ট কমিউনিকেশনের বাসে চড়ে বসতেই সাড়ে তেরো ঘন্টায় পৌছে গেলাম গন্তব্যে। ব্রিটিশদের নামকরণে জায়গাটির নাম ডালহৌসি। বাস থেকে নেমে কনকনে ঠাণ্ডায় গরম চায়ে চুমুক দিয়েই আবছা দেখতে পেলাম কুয়াশাঘেরা ধৌলাধার পাহাড়। কিন্তু লুটেরা ছবিটি দেখে যে জায়গার প্রেমে আমি পড়েছিলাম, তার জন্য গাড়ি নিয়ে যেতে হবে আরও একঘন্টা। 

সাদা মেঘ আর মিষ্টি রোদে গা এলিয়ে চোখ রাখলাম গাড়ির জানলায়। বাইরে তাপমাত্রা তখন চার ডিগ্রি সেলসিয়াস। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলে মেঘপিওনের ডাকে। পাইনগাছের সারি ভেদ করে যেন এই মুহূর্তে ছুঁয়ে ফেলা যাবে আকাশ। চোখ বুজে আসে প্রশান্তিতে। কতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানা নেই, হঠাৎ চোখ খুলে যায় রোদের সাদা আলোয়। হতবাক আমি জানলার কাচে হাত রাখি বিস্ময়ে। সাদা তুলোর আস্তরণে ঢেকে আছে চারিদিক। কাঁচ নামাতেই ঠাণ্ডা বাতাস এসে স্পর্শ করে মুখ, আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে 'লুটেরা'র প্লট। 

প্রায় দশ ইঞ্চি বরফ আমাদের হোম স্টে-র চারদিকে। 'বার্ডস এন্ড চিপস্ হোম স্টে', ডালহৌসি গেলে চেষ্টা করবেন হোটেলে না থেকে এই হোম স্টে গুলোয় থাকতে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে, পাইনের কোলে সূর্যমুখী রং মেখে যদি ছুটি কাটাতে হয় তবে এই হোম স্টে সেরা। আমাদের ট্রিপ ছিল চার রাত পাঁচ দিনের। গাঞ্জি পাহাড়ির স্নো-পয়েন্টে অবস্থিত এই হোম স্টে তে থাকা। দিল্লী থেকে বুকিং করেছিলাম যখন, ওরা জেনে নিয়েছিল আমরা কী কী খেতে চাই। পাহাড়ের ওই উচ্চতায় বরফ পড়লে সবসময় নামা যায় না, তাই এই ব্যবস্থা। কাঠের ঘরসংলগ্ন একটা ছোট্ট বারান্দা, তাতে হ্যামক টাঙানো। ফায়ারপ্লেসের সামনেই একটা কফি টেবিল আর বিছানার সামনের জানলা দিয়ে যতদূর দেখা যায়, পুরোটাই সাদা। ফিরে আসতে হবে বিকেলের আগে, তাই একটু ফ্রেস হয়ে বেড়িয়ে পড়ি বিভিন্ন জায়গা দেখার উদ্দেশ্যে। আগেই বলে রাখি, শীতকালে ডালহৌসির অনেক দ্রষ্টব্য স্থানই বন্ধ থাকে। বরফ-ছুটির সৌন্দর্য অন্যরকম। হোম স্টে থেকে আরো কিছুটা উপরে উঠলে পৌছনো যায় স্নো পয়েন্টের শিখরে। খুব সাবধানে পৌঁছলাম যেখানে, সেখানে পাহাড়ের ফাঁকে পাথর আর ঝর্ণা সব মিশে গেছে বরফে। পা ডুবে যায় পনেরো ইঞ্চি বরফে। অবর্ণনীয় সেই দৃশ্য। আকাশ তখন সাদা মেঘে আচ্ছন্ন আর মিষ্টি রোদে কেউ যেন মুক্তো ছড়িয়ে দিয়ে গেছে চারদিকে। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু ঠাণ্ডা বাতাস জ্যাকেট ভেদ করে গায়ে  লাগতেই বুঝলাম, এখনই নেমে না পড়লে স্নো বাইট অবধারিত। নামার পথে পাহাড়ি ম্যাগি না খেলে ঠিক জমে না, তাই কিছুক্ষণ বসলাম ছোট্ট একটা  ক্যাফেতে। চেষ্টা করবেন এই ছোট ছোট দোকানগুলোয় গরম মোমো খেতে। স্বাদ মুখে লেগে থাকবে সারাজীবন।

নিচে নামার রাস্তাতেই একটা সুন্দর স্পট আছে, যা গ্রিন ভ্যালি নামে পরিচিত। পাইন গাছের সৌন্দর্য কেমন হয়, সেখানে গেলে স্পষ্ট বোঝা যায়। মনে হবে গাছগুলো যেন একই রকম করে কাটা হয়েছে, অথচ এগুলো প্রাকৃতিক নিয়মেই এমনভাবে গড়ে উঠেছে। ক্যামেরাবন্দী করলাম এই প্রাকৃতিক বিস্ময়। সবশেষে পৌছলাম গান্ধী চৌক। এখানে কিছু মার্কেট আছে, যেগুলো থেকে টুকটাক শপিং করেন অনেকেই। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ছিল অন্য। এখানে একটি স্পট আছে, যেখান থেকে মোটামুটি পুরো ডালহৌসি শহর দেখতে পাওয়া যায়। অপরাহ্নের আলোয় ঘরে ফেরার ডাক। ঠাণ্ডা বাড়ছে অস্তমিত সূর্যের সঙ্গে। হাজার বাতিতে সেজে উঠছে কম্বলমুড়ি দেওয়া পাহাড়ি শীতকাতুরে ডালহৌসি। হোম স্টে-র দিকে ফেরার পথে একটা  মজার জিনিস দেখতে পেলাম, ‘তন্দুরি চা’। এটা এখানকার 'মাস্ট ট্রাই আইটেম'। 

চায়ে গলা ভিজিয়ে চলে আসি হোম স্টেতে। নিঝুম রাতে বিছানায় গা এলাতেই ঘুমপরী এসে জাদুকাঠি ছোঁয়ায় দু’চোখে। একদিকে পীরপাঞ্জালের সঙ্গবদ্ধ সারি, অন্যদিকে ধৌলাধার পাহাড়ের নিশ্ছিদ্র প্রহরা, এমন মায়াময় ল্যান্ডস্কেপে আমি খোঁজ করি লাস্ট লিফের। 

“ওঠো ওঠো বেরবো তো!” 
স্বপ্ন ভাঙতেই মুক্তোমালায় সেজে ওঠে রোমান্টিক ডালহৌসি। আজ প্রথম গন্তব্য সেন্টজন’স গির্জা। যেহেতু ডালহৌসি ব্রিটিশদের একটি গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটানোর জায়গা ছিল, সেই কারণে এখানে বেশ কয়েকটি গির্জা দেখতে পাওয়া যায়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এই পাহাড়ি উপত্যকা গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির এতটাই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল যে তিনি এটিকে অবসরযাপনের হিলস্টেশন-এ পরিণত করতে দারুণ উদ্যোগী হয়ে উঠেছিলেন। গির্জার রাস্তা ধরেই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে দেখা যায় রাভি, বিয়াস আর চাক্বি নদীর নীল জলধারা। উপত্যকা জুড়ে দেওদার, চির, কয়াল প্রভৃতি গাছের ঘন সবুজ আলিঙ্গন। যদিও সবটাই বরফস্নাত তখন। 

হাজার চারেক লোকের বাস চাম্বা জেলার অন্তর্গত এই শহরে। সর্পিল পথ বেয়ে নেমে আসার সময় পাইনের জঙ্গলের অপূর্ব সামিয়ানা ভেদ করে সূর্য লুকোচুরি খেলে আমাদের সঙ্গে। জড়িয়ে রাখে রোমান্টিক ওমে। গাড়ি বলা ছিল দৈনকুন্ড শৃঙ্গের জন্য। ডালহৌসি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জায়গাটিতে পৌঁছে গেলে সমস্ত অঞ্চলটির এক অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু বাদ সাধে বরফের চাঁই। অগত্যা আবারও ফিরে আসা গান্ধীচকে। ব্রিটিশ শাসনের সময় রিট্রিট প্যারেড-এর জন্য বাছা হয়েছিল এই স্থানটিকে। ডালহৌসি বেশ পরিষ্কার। এখানে রাস্তায় আবর্জনা ফেলায় নিষেধাজ্ঞা আছে। পাঁচটি পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত ডালহৌসিতে প্লাস্টিক ব্যবহারও প্রায় নেই বললেই চলে। স্কটিশ ও ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের বাংলো ও গির্জা এই শহরের অন্যতম দ্রষ্টব্য। বিলেত ভাবতেই মনে পড়ল, কালই প্রথম চাক্ষুষ করব ভারতের 'মিনি সুইজারল্যান্ড'। ঘরে ফিরে অনেকক্ষণ বসে থাকি ফায়ারপ্লেসের সামনে। চারিদিক ম’ম’ করছে দেশি মুরগির গন্ধ। রহস্যময়ী ডালহৌসিতে লেখা হয় আরেকটা রাতকাহিনি।
 
পরের দিন ভীষণ উদ্দীপ্ত আমি। আজ প্রেমিকের সুইজারল্যান্ডএর মুখোমুখি। গন্তব্য  ডালহৌসির অন্যতম বিখ্যাত স্থান, সুন্দরী খাজ্জিয়ার। তবে সেখানে পৌছনোর আগে ঘুরে যেতে হবে কালাটপ অভয়ারণ্য। পুরু দেওদার গাছপালা, বন্যপ্রাণী, বরফঢাকা পাহাড় - এই সবকিছু নিয়েই তৈরি কালাটপ। কালাটপ নামের অর্থ কালো টুপি, যা অভয়ারণ্যের সর্বোচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় ঘন কালো বনের আবরণকে নির্দেশ করে। রাভি নদীর ওপর চাম্বা বাঁধ এবং চামেরা জলাধার থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কালাটপ। ঘন কালো বন তখন সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে শীতঘুম দিচ্ছে। যতদূর চোখ যায় শুধুই একরাশ মুগ্ধতা। কালাটপের হাইকিং ট্রেলের প্রাকৃতিক শোভা মনোমুগ্ধকর। এখানেই গাড়ি নামিয়ে দেয় আমাদের। যতদূর চোখ যায় তুলতুলে সাদায় নরম নীলচে তুলি বোলায় শীতের আকাশ। হাল্কা মেঘ সরে যেতেই কেউ যেন গোলাপি মুক্তো ছড়িয়ে দেয় স্বপ্নিল উপত্যকায়। ধৌলাধার আর পঙ্গিধর শিখরের বেষ্টনিতে এক অপূর্ব নিসর্গের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা দু’জন। সন্ধ্যা নেমে আসছে, কিছুটা এগোলেই খাজ্জিয়ারের হোটেল। দূর থেকে শোনা যায় শিয়ালের ডাক। ফায়ারপ্লেসের আগুন, ধূমায়িত কফি কাপ আর জানলার কাচে বাষ্পে মোড়া 'পাহাড়ো কি রানি' খাজ্জিয়ার।
 
ডালহৌসির মেন পয়েন্ট থেকে মোটামুটি চব্বিশ কিলোমিটার গেলে পৌঁছে যাওয়া যায় খাজ্জিয়ার। নিঃসন্দেহে বলতে পারি, এমন জায়গায় যাওয়ার পর মন প্রকৃতির রূপের কাছে হার মানতে বাধ্য। লুটেরা ছবির যে লোকেশন আমরা দেখতে চেয়েছিলাম কোনও সিনেম্যাটিক এফেক্ট ছাড়াই, তা চোখের সামনে ধরা দিল। দেখলাম হর্স রাইডিং বন্ধ থাকলেও প্যারাগ্লাইডিং করছে কয়েকজন। নির্মল হ্রদ, অত্যাশ্চর্য চারণভূমি আর চাদরমুড়ি দেওয়া শীতঘুম - প্রাকৃতিক শিল্পীর তুলিতে এখানেই প্রাণবন্ত হয় প্রত্যেকটা কবিতা। হোটেলের বারান্দা জুড়ে বোগেনভিলিয়ার গালিচা। একগুচ্ছ তুলে নিই কোটের পকেটে। ছড়িয়ে দিয়ে আসি সবটা শীতের সাদা চাদরে। হয়ত এই ভেবেই, যে শীতসঙ্গমে থেকে যাবে আমাদের সব মুহূর্তেরা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে।
 
অদ্য শেষ রজনী। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে শ্বেতশুভ্র কল্পরাজ্যে। কল্পরাজ্যই বটে! যেখানে মেঘমল্লারে উষ্ণতা ছড়ায় ব্যাকুল শীতবাসর। বরফ রোদের আলতো ছোঁয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় ভুলে যাওয়া দৈনন্দিন প্রেম। রহস্যময়ী পাহাড়ের বুকে জড়িয়ে পড়ে থাকে  হিমায়িত ঝর্ণা। খোলা প্রান্তর ছুঁয়ে যায় পড়ন্ত শীতের বিকেল, গোধূলির লাল সাজে সেজে ওঠে কালাটপের দিগন্তরেখা। জোনাকির কোলাহল বলে দেয়, হাতে সময় খুব কম। ফিরে আসতে হয় শহরের ক্যাকোফোনে। কুয়াশায় মিশে যায় গ্রীনউইচ ভিলেজ। শীতসোহাগী হয় সুন্দরী হিমাচল।

2 Responses

  1. Nairita says:

    Khuub sundar !!

  2. Atreyi Ganguly Roy says:

    As usual, khub shundor likhechis💜

বৈশাখী ২০২৪