এখানে আগের মতো শীত জাঁকিয়ে পড়ে না সুমেঘা। তোদের বাড়ির পাশের নদীটা আরো রোগা হয়ে বয়ে যাচ্ছে। যেন বিরহে শীর্ণ তবু অভিসারে যায় রোজ। আমাদের বাড়ির উঠোন সংক্ষিপ্ত হয়েছে তাও মা গাঁদার বিছন ছড়িয়ে দিয়েছিল। কুঁড়ি এসেছে তারই কয়েকটাতে। আমাদের উঠোনের আরেক দিকে কাকারা দোতলা বাড়ি তুলেছে। রোদ আসে না একটুও। নপিসি শুধু ডাকে, “ও ফুজন সব কুয়া কুয়া দেহি।” আমাদের জীবনটাই তো ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেছে বোঝাই কী করে? নপিসি হাঁটু বুকের কাছে নিয়ে বারান্দায় দোল খায়। থেকে থেকেই চিৎকার করে, “ফুজন ও ফুজন?” আমি সেই ডাক কানে নিয়ে তোদের বাড়ি এসে দাঁড়াই। বড়ো গেটটা আর নেই। বাগানের জোড়া নারকেল গাছটার তলা দিয়ে যাবার সময় রোজ দাঁড়িয়ে পড়ি। তুই আর আমি পিঁড়ি বাঁধিয়ে দোল খেতাম। “তুলব ফুল গাঁথবো মালা পরব দুজনে চলো না সেই ফুলের বাগানে” তোর গালগুলো শীতের চোটে লাল হয়ে ফেটে যেত। আমার যে কী মায়া হত। মাকে এসে বলতেই মা বলল, “হ্যারে নিয়া আসিস।” মা সত্যি ম্যাজিক জানত। গরম জলে তুলো ভিজিয়ে চেপে চেপে তোর গালটা পরিষ্কার করে বোরোলিন দিতেই তুলতুলে গাল চকচক করতো। আমাদের ছোটোবেলার সেই 'সুরভিত এ্যান্টিসেপ্টি ক্রিম বোরোলিন'!এখন আমাদের বোরোলিনের টিউব নিচ থেকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে তুলে অল্প বের করে আমার পায়ের ফাটায় লাগাই, ঐ হাতটাই ঠোঁটে বুলিয়ে শুয়ে পড়ি। মশারির উপর ছেঁড়া একটা চাদর দিয়ে রাখি শীত কম লাগে। রাতে শুয়ে নিজের শুকনো বুক হাতড়াই। কত সময় পেরিয়ে গেল কত সময়। বুকের উপর পাথরগুলো সাজিয়ে রাখি রোজ। যে ঘরে তোরা এখানে এলে থাকতিস মানে রাতে ঘুমোতিস ওর লাল মেঝেটায় আজ অনেকক্ষণ হাত বুলিয়ে এলাম। লুকোচুরি খেলতে গিয়ে তোদের পালঙ্কর তলায় লুকিয়ে পড়েছিলাম। ওর নিচে একটা প্যাকেট পেয়েছিলাম। কামসূত্র লেখা। আর দেখেছিলাম লাল জলের বোতল। জানি না কেন ভয় পেয়েছিলাম। তোদের শোবার ঘরে একটা চকচকে কাঠের বড়ো বাক্স আর তার ঠিক মাঝখানে ডিমের মতো আয়না ছিল। চারিদিকে কত বোতল সেই গন্ধগুলো ভালো এই গন্ধটা ভালো না। ছুটে বেরোতেই তোর মার সঙ্গে জোরে ধাক্কা। কী লজ্জা কী লজ্জা! আমার ছোটোকাকি তোদের বাড়ি কাজ করে বহুদিন, তখন লম্বা টানা বারান্দাটা মুছছিল। “মাইরা ফেলসে গো। রাকখুশিটা বৌমণিরে মাইরা ফ্যালসে!” তোর ঠাকমা,বাবা, কাকা সবাই ছুটে এল। তোর মা পেট চেপে বসে পড়েছে। আমি দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি। ঠাকমা আমার গালে ঠাস করে চড়িয়ে দিল। তুই কেঁদে উঠলি। “জ্যাঠাইমা ভালো কইরা খোঁজেন অত ছুট লাগালো ক্যান কিছু চুরি করে নাই তো! অভাবে সভাব নষ্ট বলে কতা!” আমার কাছে কিছুই ছিল না কেবল যা ছিল সেই আত্মসম্মানটা কাকিমা টেনে নামিয়ে নিয়েছিল ইজেরের সঙ্গে। কাঁদতে কাঁদতে তোদের বাড়ি ছেড়ে নদীর পাড়ে এসে বসেছিলাম। তুইও পিছন পিছন চলে এলি। জটিবুড়ির কুঁড়ে ঘরে ভাত ফুটছে বগবগ করে। গন্ধে খিদে পেয়ে গেল। কত বললাম, “তুই চলে যা, আমি চোর!” তুই ঠোঁট ফুলিয়ে বললি, “আমি কি তাই বলেছি?” “আমি জটিবুড়ির বাড়ি যাব।” “আমিও যাব!” আমাদের দুজনকে নারকোলের খোলে ফ্যানাভাত দিল জটিবুড়ি। সেই ঘ্রাণ আহা, সব কষ্ট ভুলে গেলাম। আজও নদীর পাড়ে গেলেই সেই গন্ধ পাই। অথচ জটি নিজের ঘরে কাঁথা কম্বলের নিচে মরে পড়েছিল দুদিন। দুর্গন্ধে টেকা দায় হয়েছিল। মানুষটা কিন্তু সারাজীবন সুগন্ধ ছড়িয়েছে। ইতুপুজোর দিন শনের মতো চুল ছড়িয়ে রোদে পিঠ দিয়ে চষি কাটত। আমি বসে বসে দেখতাম। ওর ব্লাউজ ছাড়া পিঠটা আঁশ আঁশ দেখতে লাগত। আমি যদি বলতাম, “ও বুড়ি তোমার পিঠে কী?” বলত, “জমি জায়গারে ছেমড়ি, দ্যাখোস না আল দিয়া আলদা করসি, একটায় আউশ বুনুম, আরেকটায় আমন, কালিজিরা, হাঁসখোল, পদ্মজালি সব বুনুম!” আমি মুখ বেঁকিয়ে বলেছিলাম, “সবটাতেই চাল, ভাত ছাড়া আর কিছু খাবা না নাকি?” ভারী উদাস হয়ে বলল, “ভাত ছাড়া আর কিছুর দাম নাইরে!” জটিবুড়ি কনকনে শীতের সকালেও নদীতে ডুব দিয়ে স্নান করতো, সেই জটি শীতে বুকের ধুকধুকি বন্ধ করে ফেলল, ভাবলে অবাক হই। ঢ্যাঙাবাপি আমায় একদিন চুপিচুপি বলেছিল, “সব মিথ্যারে ফুজন, ঐ নদীর পাড় খালি করার জন্য বুড়িটাকে খুন করেছে পার্টির ছেলেরা। আমি দেখেছি, তোর ছোটকাকা ছিল ঐ দলে। ওখানে পার্ক হবে!” আমি ওকে চাপা স্বরে বলেছিলাম, “চুপ কর বাপি এসব কাউরে বলতে যাস না!” ভয় ছিল বাপি হয়তো চেপে রাখতে পারবে না। কিন্তু বাপি চুপচাপ দুবাই চলে গেল কাজে। ওর বাবা মাঝেমধ্যে আসে। ছেলের পাঠানো টাকায় বাড়িতে ছাদ দিয়েছে। সামনের বছর বিয়ে দেবে। আমায় মেয়ে দেখতে বলেছে। “দেখ ফুজন বাপি তো তোর বয়েসি, সামনের চোতে বত্তিরিশ হবে, সেই বুঝে মেয়ে দেখিস। দেখিস যেন বর্ষার নদী হয় শীতের নদী দেখলে মনে রস জমে না!” আমি বুঝতে পারি জানিস আমি বর্ষার নদী নই। তোদের বাড়িটা পরিষ্কার করত দোদনকাকা। আমি মাতব্বরি করতাম, ওখানে ঘাস আছে, এদিকে জলবিচুটি থেকে গেল যে, কী করছ, ভেটুল গাছটা কেটো না, সুমেঘা ভালোবাসে। দোদনকাকা দা তুলে মারতে আসত। “ভাগ ভাগ এখান থেকে, তোরে নায়েব রাখসে নাকি?” সেই আমাকে তুই নায়েব রাখলি সুমেঘা! ভাঙার নায়েব। হ্যাঁ কাজটুকু পেয়ে আমার যে উপকার হয়েছে সত্যি কিন্তু আমার কথা কে মানবে বলতো। লেবারগুলো খ্যাঁখ্যাঁ করে হাসে। বাজে ইঙ্গিতে তাকায়। বাবা মাঠে যাবার আগে মা মোটা মোটা লাল চালের ফ্যানাভাত ঝাল করে আলুসেদ্ধ মাখা দিয়ে খেতে দিত। তুই সকালে এলে হুশহাশ করতে করতে খেতি। এখন আমাদের বাড়ি একবার ভাত হয়। চাষের জমি আমরা পাইনি। নপিসি কাকাদের বাড়ি থেকে যেদিন চলে এল আমি আর মা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। নপিসির শরীরে এখন আর জোর নেই, গাধার মতো খাটতে পারে না, তার উপর মাথাও বোধহয় সামান্য নষ্ট হয়ে গেছে। কাকিমারা বের করে দিয়েছে, শুয়ে বসে খাওয়ানোর মতো তাদের টাকা নেই। “ও বউ হ্যারা তাড়ায় দিসে, তুই থাকতি দিবি? আমি কই যাই বলতো?” মা কেঁদে ঘরে এনে বসিয়েছে। আমি অবাক হয়ে যাই মায়ের ধৈর্য দেখে। একটা মানুষকে দুঃখে দুঃখে জর্জরিত করবে বলেই বোধহয় ঈশ্বর এত ধৈর্য দিয়েছেন। বাবা যখন চলে গেল বুকের আচমকা ব্যথায়, শেষবারের মতো হাপর টেনে বলল, “ফুজনের মা ফুজনরে বিয়া দিও, আমি যাই।” মা বাবার মাথায় হাত রেখে বলল, “সাবধানে যাও গিয়া।” সুমেঘা মা কাঁদেনি জানিস। বাবার মুখটা আঁচল ভিজিয়ে মুছে দিল। তারপর চন্দনের ফোঁটা দিল। আমায় বলল, “বাইরে যা, আমারে ওর লগে কিছুক্ষণ একা থাকতি দে!” মা জানত আমার বিয়ে কোনোদিন হবে না। তাও চেষ্টা চরিত্র করে দু একটা সম্বন্ধ এনেছিল। একটা দুটো পাঁচটা বিয়ে ভাঙতেই আমার শরীরের সব মাংস গলে গালের হনু বেরিয়ে এল। শীতের নদীর মতো না চাইতেও ঠেলে যাই জীবন। কাকিরা রাস্তায় দেখলে হাসে, আমার বোনদের বলে, “সরি আয়, ওর বাতাস লাগাও পাপ, বাবা, ভয়ে থাকি!” ভাবতেও মজা লাগে আমায় কেউ ভয় পায়। বকুলের বর যেদিন তোর সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিল খুব অবাক হলাম। তোদের বাড়ির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। মনে পড়ল, আমরা তখন বোধহয় নাইনে পড়ি। সেবার তুই যখন এলি আমি তোকে দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। এত সুন্দর তুই। এক বছরে এতটা বড় হলি কী করে? তুই যখন বললি, “কী দেখছিস ফুজন?” আমি খুব লজ্জা পেয়ে পালিয়েছি। ইস্ নিজেকে ভালো করে আয়নায় দেখলাম যখন তখন মনে হল ঠিক যেন ছেলে। দুপুরে ঘুমোচ্ছিলাম। মনে হল পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি। চমকে দেখি তুই। “এ্যাই চল্ নদীর ধারে!” “এখন! ঠাণ্ডা লাগবে তোর!” “চল না তোকে একটা কথা বলব বলে ছটফট করছি, চল না!” জটিবুড়ির বাড়ির কাছে নদীর ধারে বসে কমলালেবু দিলি আর দিব্যজ্যোতির গল্প বললি। তোর ঘাড়ের নিচে লাল দাগ। হাত বুলিয়ে বললি, “এই দেখ পনেরো দিন আমায় ছেড়ে থাকবে বলে এই উপহার চেয়ে এনেছি!” “এমন কী করে হল? কামড়ে দিয়েছে?” “ধুস তুই যাতা। আচ্ছা কাল দুপুরে আমাদের বাড়ির সিঁড়িতে তোকে বোঝাবো বুঝলি?” সেই দুপুরটা ময়ালসাপের মতো আমাকে গিলে নিল। আমি কখনো এমন আদর পাইনি, কাউকে করিওনি। শীতের দুপুর আমার শরীরে আগুন জ্বেলে দিল। এক নিষিদ্ধ ভালো লাগায় আমি ডুবতে লাগলাম। পনেরোটা দিন আমি ভেসে গেলাম। ফিরে গিয়ে তুই চিঠিতে লিখলি এক আশ্চর্য কথা। প্রিয় ফুজন, আমার নেট প্র্যাকটিস ভালো হয়েছে তাই রোজ ম্যাচে জিতছি দিব্যজ্যোতির সঙ্গে। ভালো থাকিস। সামনের শীতে আবার দেখা হবে। এই এক বছর আমার বিরহ সইতে পারবি তো? আমি ভেবেছিলাম চিঠি লিখি। জটি বুড়ি তোর কথা জিজ্ঞাসা করে। তোর ঠাকুমার পায়ে তেল মালিশ করি, বলেছে, এই শীতকালটা রোজ স্কুল থেকে এসে পায়ে মালিশ করে দিস, দশ টাকা করে দেবো আর মুড়ি খেয়ে যাস। তোর ঠাকুমার পা তোর মতোই ধবধবে। তোর কথা মনে হয় বলে রোজ টানেটানে যাই। তোরা শীতেই আসিস কেন শুধু? গরম বা বর্ষায় আসতে পারিস না? কিন্তু জানি বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে তবে তুই আসিস, আর অন্য সময় ছুটিতে পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্রে যাস। আজ সিঁড়িটা ভাঙা হল। আমার বুকের ভেতর সব বিকট শব্দ করে ফাটছিল। আমার চোখে জল দেখে লেবারগুলো ছোপধরা দাঁতে হাসছিল। মাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে, তবু তোরা এলি, সেদিন শনিবার। আমি তোর ঠাকুমার পায়ে তেল ডলছিলাম। গাড়িটা থামল। তোর মা বাবা থমথমে। তোর চোখ ফোলাফোলা, চোখের তলায় কালি। আমায় দেখে ছুটে ঘরে চলে গেলি। আমি বেরিয়ে এসেও ঘুরঘুর করছিলাম। পিছনের চাঁপা গাছের কাছ দিয়ে তোদের ভিতরের উঠোনটা দেখা যায়। “প্রেম করতে শিখেছে তোমার নাতনি। যেমন তেমন প্রেম নয়, সব শিখে গেছে। ইচ্ছে করছে মেরে ছাল তুলে নিই। বুঝিয়ে দাও ওকে, হয় এসব করা ছাড়বে নয় থাকবে এই গ্রামে। যেতে হবে না কোলকাতায়!” এইকথা শুনে আনন্দে দাঁত বের করে খানটেক নেচে নিয়েছিলাম। রাতে উত্তেজনায় ঘুম এল না। কিন্তু সকালে কখনো তোদের বাড়ি যাইনি। কী করে যাব ভাবছিলাম। ঘুম থেকে মা উঠিয়ে দিল, “রস নিয়া আইসে বিশু, দৌড়ে যা অগো বাড়ি দিয়া আয়, মাইয়াডা রস খাতি বড়ো ভালোবাসে, যা!” মন থেকে কিছু চাইলে তবে কি ভগবান রাস্তা করে দেন? চাদরটা গায়ে দিয়ে জোরে জোরে হাঁটা লাগালাম। তোদের বাড়ি তখন আধো ঘুমে। গোবর ছড়া দিচ্ছিল মুনির মা। আমি কিছু বলার আগেই কাঁধের চাদরে টান, ঠোঁট কাঁপছে গালে চোখের জলের দাগ। আমি বোকার মতো গামলাটা এগিয়ে দিলাম। চিনচিনে ঠাণ্ডা খেজুরের রস অনেকটা চোঁচোঁ করে খেয়ে নিলি। আমার হাতটা ধরে বললি, “দুপুরে খাবার পর আসিস!” সময়টা পার করতে বহু যুগ লেগেছিল। সিঁড়িতে বসে অনেকক্ষণ কাঁদলি আমায় জড়িয়ে। তোর চুল থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছিল, তোর শরীর থেকেও। চোখ বন্ধ করে বললি, “আমায় একটু আদর করো দিব্য, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, আমি বোধহয় আর কখনো তোমায় দেখতে পাব না, বাবা তোমার বাড়িতে গিয়ে শাসিয়েছে আমি জানি!” দুহাতে কতটা নরম মাটি লেগে যায়? কতটা রেণু? কতটা গভীরে চলে যায় ঠোঁট, শুকনো বুকের ভিতর কত জল? আকাশ নেমে আসে যদি মরুভূমির ঊরুতে গোপন অরণ্যে অধিকার করে কোন আদিম সন্ততি? কে কাকে আদর করছিল? আমি দিব্যজ্যোতি নাকি ফুজন? তুই কাকে চাইছিলি? “ওমা গো একি সব্বোনাশ গো, ও বৌমণি গোওওও তুমার কী সব্বোনাশ হল গো। ওগো কুথায় তোমরা আসগো। এই রাকখসিরে দেকো গো!” পালিয়ে চলে গেলি তুই, তোকে যেতে দিল আমার ছোটকাকি। আর আমার হাত দুটো চেপে ধরলো। আমার পোশাকটাও যে ঠিক করা ছিল না সুমেঘা। মারতে মারতে আমার দাঁত ভেঙে দিল, ঠোঁট কেটে ঝুলে পড়ল। কে কখন কী করে বাড়ি পৌঁছেছিল জানি না। আমার কানে শুধু একঘেয়ে গুমগুম শব্দটা বাজতে থাকল, ঘুরতে থাকল। এত বছর পরেও আমি লুকিয়ে থাকি, আমায় দেখলেই লোকে হাসে। আমি নাকি আসলে...! তুই তো জানিস, আমি আদতে কী? সিঁড়িটা দাঁত মুখ বের করে ওর ভেতরের সত্যিটা প্রকাশ করে দিল, কেবল তুই দিলি না। তোদের বাড়িটাও দেখতে দেখতে একা হয়ে গেল। তোর মেজকাকি অনেকদিন একা সব সামলেছে। আমায় ডাকত দেখতে পেলে, “ও ফুজন শোন। বোস। তোর কাকির শয়তানি সব বুঝি রে কিন্তু চোখে দেখা জিনিস কেউ ভুলতে পারে না। কষ্ট পাস না। জানিস তো মেঘার ঠাকমার সব গয়না চুরি হয়ে গেছে। জানি কে নিয়েছে কিন্তু কিছু করতে পারলাম না। তোর ছোটকাকা এখন লোকাল নেতা! মা মরে গেল মেঘার মেজকাকাও একদিনের জ্বরে চলে গেল। ছোটজন ফলতায় বাড়ি করেছে ওর ছেলে পুনায় চাকরি করে ওরা এই গ্রামে আসবে না আর মেঘা চলে যাবে অস্ট্রেলিয়া। ওর বিয়ে, সামনের বছর ডিসেম্বরে। এত বড় বাড়িতে কেউ নেই। আমি আর কতদিন?” তোর বিয়ে? কার সঙ্গে? তুই বিদেশ চলে যাবি? আর দেখা হবে না? রাতে বালিশে মুখ গুঁজে খুব কাঁদলাম। মনে হল তুই যদি আমার একটা সম্বন্ধ আনতি, যদি ছেলের বাড়িতে বলতি আমার কোনো শারীরিক দোষ নেই তাহলে আমিও জাপটে সংসার করতাম। আর শীতকাল এলে ঝাঁটার কাঠি দিয়ে নারকেল তেল খুঁচিয়ে বার করে চুলে ঘষতে ঘষতে বলতাম, আমি শীত ভালোবাসি, মেঘার সঙ্গে দেখা হত বলে। মা গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। নদীর ওপারে বকুলের বিয়ে হল। ওর বর কন্ট্রাকটারি করে। বকুল বলে কয়ে ওর বরের টুকিটাকি কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। যা পাই তিনজনের চলে না। মা রাতে ঠোঙা বানায়, দুপুরে ব্লাউজে হেম করে। বকুলের বর সেদিন আমাদের বাড়ি এসে হাসল, “ও ফুজন, তোমার বন্দু বাড়ি ভাইঙা রিসট করবো। আমার সাথি কথা বলতি বলতি বলল, আমাগো পাড়ার ফুজনরে আপনার কামে নেওয়া লাগব, ক দেখি, মায়ের কাছি মাসির গল্প, আমি কলাম, হেয় আমার হিসাব দ্যেহে, ব্যস, কলো, অরে বাড়ি ভাঙার দাইত্ব দেন, টাকা আমি দুবো। এই নাও কতা বলো!” বলে ফোনে তোকে ধরিয়ে দিল। কত বছর পর আমি তোর গলা শুনছি, মনে করতে পারলাম না। হবে হয়তো চোদ্দ পনেরো বা তারও বেশি। “ফুজন, আমি সুমেঘা। কেমন আছিস তুই। কী রে কথা বলবি না? এখনো এত রাগ তোর? আচ্ছা বলিস না, শোন, রিসর্টটা তৈরি হলে প্রথম শীতেই তোর কাছে যাবো, ছোটবেলার সব আমার ফেরৎ চাই কিন্তু!” কী ফেরৎ দেব সুমেঘা, কিচ্ছু যে নেই। জটিবুড়ি নেই, তেমন শীত নেই, মায়ের বড়িতে মৌরী নেই আমাদের সিঁড়িটাও নেই, কিচ্ছু নেই। কেবল আমি আছি, আমার স্মৃতি আছে। বন্ধুত্বের স্মৃতি, ভালোবাসার স্মৃতি। তুই আসিস আমি তোকে সব ফেরৎ দেব, সব। কিন্তু তুই আমায় কী ফেরৎ দিবি? বল না! আমায় কিছু ফেরৎ দিতে পারবি?