মণি পিসি

বিষ্ণুপুর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা


সেই মেয়েবেলা থেকে এই বাগানটার উপর  পর্ণার ভারী লোভ। সরস্বতী পূজার ভোরে ওরা বন্ধুরা দল বেঁধে ফুল চুরি করতে ঢুকত এখানে। এই এত্ত বড় বড় পেল্লায় সাইজের গাঁদা ফুটত। গাঁদা না বলে আগুনের গোলা বলাই যায় অনায়াসে। আজ মাস ছয়েক হল এই বাগানের মালকিন সে নিজে। ছোট মালকিন।
 গায়ের চাদরটা সামলে বাগানের মধ্যেকার সরু পথটা ধরে দুলকি চালে হাঁটতে থাকে পর্ণা । দুপাশে নধর গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, কসমস সহ আরও হরেক রকমের শীতের মরশুমি ফুলেরা কুয়াশা মেখে দাঁড়িয়ে। কুয়াশার সোহাগজলে ভিজে পাপড়ি ফুলেরা মাথা ঝুঁকিয়েছে। দেখে নিজের একটু আগের অবস্থার কথাটা মনে পড়ে শরীরে পদ্মকাঁটা জাগে পর্ণার। ভোরবেলাতেও  ঘুম ভেঙে জয়ের ওকে চাই।
সেই সব মুহূর্তে টইটুম্বুর আদর সোহাগে পর্ণাও এমন গদগদ আহ্লাদী হয়ে থাকে।
আদর পর্ব শেষ করে তাকে জাপটে ধরে আবার একটা ঘুম দেয় জয়। পর্ণার আর ঘুম আসতে চায় না তখন। জয়ের ঘুম গাঢ় হলেই আলতো করে ওর হাত সরিয়ে পর্ণা এক ছুটে চলে আসে বাগানটাতে। এই বাগান কখনও খালি যায় না। গরমে বেলি, রজনী গন্ধা, সূর্যমুখী। বর্ষায় দোপাটি, জিনিয়া। আর শীত বসন্তে তো হাজার ফুলের মেলা বসে। এসব একা হাতে সামলায় দীনুদা। দীনুদাকে পর্ণার শ্বশুরমশাই কাকা ডাকেন। জয় কিন্তু ছোটবেলা থেকেই দীনুদা বলেই ডাকে। তাই পর্ণাও ডাকে ওই নামে। দীনুদার বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। তবু বাগানের প্রতি দরদ কমেনি এতটুকু। রোদ জল বৃষ্টি  রোগ শোক কোনও কিছুই তোয়াক্কা করে না মানুষটা। বুড়ি মানদাদির মুখে পর্ণা শুনেছে স্ত্রীর মৃত্যুর দিনেও এই বাগানে গাছেদের জল দিতে ভোলেনি দীনুদা। 

আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে বাগানের ঈশান কোণের দিকে এগুতে থাকে পর্ণা। ওখানে অর্জুন গাছ থেকে ঝুলন্ত দোলনাটা ওর বড় প্রিয়। কুয়াশা জমে আছে ওদিকটাতে। তার মধ্যে দিয়েও ঝাপসা দেখা যাচ্ছে মণিপিসি দুলছে। দুলছে মণিপিসির লম্বা বেণী। পর্ণা দ্রুত পায়ে এগুতে থাকে। যাক বাবা! হদিশ মিলেছে।
গতকাল থেকে মণিপিসি উধাও। রাতে বাড়ি ফেরেনি মানুষটা। অনেক খোঁজাখুঁজি শেষে জয় আর পর্ণার শ্বশুরমশাই থানায় ডায়েরি করে এসেছিল।
মণিপিসি দীনুদার একমাত্র মেয়ে। আজ বহু বছর হয়ে গেল স্ত্রী কন্যা সহ দীনুদা এ বাড়ির আশ্রিত। 
ছোট বেলা থেকেই মণিপিসির মাথার গণ্ডগোল। মণিপিসি হিংস্র পাগলদের দলে পড়ে না। বরং মণিপিসির পাগলামি আত্মভোলা ধরণের। সারাদিন এপাড়া সেপাড়া ঘুরে বেড়ায় সে সেই কিশোরী বেলা থেকেই। দুনিয়ার যেখানে যত ফুল সব কানে মাথায় বেণীতে গুঁজে ঘুরে বেড়ায় সে সারাবেলা। কিন্তু বেলাশেষে ঠিক ফিরে আসে বাড়ি। যেমন পাখিরা ফেরে সন্ধ্যার ছায়া ঘনালে।

দু পা এগুতে না এগুতেই থমকায় পর্ণা। কোথায় মণিপিসি! দোলনায় কেউ নেই তো! তবে ফাঁকা দোলনাটা এখনো দুলছে। চারিদিকে পাতলা কুয়াশা স্তরে ঢেকে আছে। বাতাস থমথমে। রোদ উঠলে তবেই না উত্তুরে বাতাস বইবে। এখন এ ভাবে দোলনাটা দুলছে কীভাবে তবে এমনি এমনি! 
পর্ণার কেমন জানি অদ্ভুত অস্বস্তি লাগে। পায়ে পায়ে দোলনার দিকে এগিয়ে যায় সে। অদ্ভুত পাঁচমিশালি ফুলেল গন্ধটা ধক করে নাকে লাগে। এ গন্ধ মণিপিসির গায়ের। এ গন্ধ পর্ণা বিলক্ষণ চেনে। যেন এই মাত্র মানুষটা দুলছিল এই দোলনায়। অথচ মুহূর্তে ভ্যানিশ।

দোলনাটা এখনও দুলে চলেছে। বুকটা ধড়াস করে ওঠে পর্ণার। এমন নয় তো যে মণিপিসি এখনো বসে ওই দোলনায়! শুধু পর্ণা তার চর্ম চক্ষে দেখতে পাচ্ছে না তাকে! শুধু মণিপিসির তীব্র উপস্থিতি সে অনুভব করতে পারছে তার সবটুকু অনুভূতি দিয়ে!

নিজেকে ধমক লাগায় পর্ণা। কী সব আবোল তাবোল ভেবে চলেছে সে তখন থেকে। শীতের ভোরের ঝাপসা কুয়াশায় কী দেখতে কী দেখেছে তার ঠিক নেই। দোলনাটায় বসে দোল খেতে থাকে পর্ণা। চাদর ফুঁড়ে ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডা কাঁপিয়ে দিচ্ছে তাকে। দুলতে দুলতে আবার এতোল বেতোল ভাবতে  থাকে সে। আর ভাবতে ভাবতে হারিয়ে যায় তার মেয়েবেলার দিনগুলোতে। এই রায়নগর আসলে পর্ণার মামার বাড়ির পাড়া। এমনই ডিসেম্বরের শেষে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেলে ওরা দু বোন মামার বাড়ি আসত। সামনের খামারে এমনই এক ভোরে ও প্রথমবার খেয়াল করেছিল মণিপিসিকে। কানে মাথায় গলায় রঙিন ফুলে গাঁথা মালা। পর্ণা তখন ক্লাস ওয়ান। খুব অবাক হয়েছিল সে। এমন ভাবে ফুলের সাজে সাজতে সে দেখেছে স্কুলের ফাংশানে নাচের মেয়েদের। আর দেখেছে মেয়েদের যখন এই এত্তো গয়না আর ঝলমলে শাড়ি পড়ে বিয়ে না জানি কী একটা হয় সেই সময় এমন ভাবে সাজতে হয়। তবে তারা কেউই তো এমন ভাবে মাঠে ঘাটে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় না এমনতর ফুলের সাজে! তাছাড়া মণিপিসির পরণের সাদামাটা শাড়ি আর প্রসাধনবিহীন শরীরে এমন ফুলের সাজ আরও বিসদৃশ লেগেছিল।
দুপুরে যখন সামনের খামারে মাসি মামী আর পাড়ার গুটিকয়েক বউদের হাতের জাদুতে রঙ বেরঙের  উলের বলগুলো একটু একটু করে সোয়েটার মাফলারে বদলে যাচ্ছিল, তখন চুপিচুপি কাকলি মাসির কাছে পর্ণা জানতে চেয়েছিল,
--"মণিপিসি ওভাবে গুচ্ছের ফুল লাগিয়ে ঘোরে কেন রে?"

পর্ণার থেকে বছর ছয়েকের বড় কাকলি পর্ণার খুড়তুতো মাসি। সে বলেছিল,
--"এ বাবা তুই জানিস না! মণিপিসিকে তো সবাই মুণিপাগলি বলে এই জন্য। ও সেই কবে থেকে পাড়া ঘুরে বেড়ায় এভাবেই।"

তারপর আরও চুপিচুপি পর্ণার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল,
--"বাড়ির মনিবের ছেলের প্রেমে পড়েছিল। তারপর সে ছেলে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই মাথা বিগড়ে এভাবেই... বলিস না যেন আবার বড়দের যে আমি তোকে বলেছি এসব কথা।"

 তখন থেকে পর্ণার মনের ভিতর প্রেম সম্পর্কে কেমন যেন একটা শিরশিরে ভয় গুটিপোকার মতো বাসা বেঁধেছিল। তবে সে গুটিপোকা অবশ্য গুটি কেটে পালিয়েছিল বেশ কিছু বছর পর।
এরপর এক বছর সরস্বতী পূজায় মামার বাড়ি এসেছে পর্ণা। পূজার দিন কাকলি মাসির কয়েকজন বন্ধুর সাথে পর্ণাও ভোর রাত থাকতে গাঁজা ঘোষদের বাড়িতে গেছে ফুল চুরি করতে। কয়েক পুরুষ আগে এদের গাঁজার বিজনেস থেকে এমন রমরমা অবস্থা। এখন যদিও সে ব্যবসা উঠে গেছে। তবুও এই বাড়ি এ অঞ্চলের সব লোকের মুখে মুখে গাঁজা ঘোষের বাড়ি নামেই পরিচিত।

কুয়াশা জড়ানো বাগানে তখন গাঁদারা হাসছে। পর্ণারা সবাই তখন পটপট করে গাঁদা ছিঁড়ছে। পর্ণার নজর পড়েছিল ঈশান কোণের দোলনাটার দিকে। চুপিচুপি উঠে বসে দোল খেতে লেগেছিল পঞ্চদশী পর্ণা। প্রথমটা খেয়াল করেনি সে। তারপর হুটোপুটির শব্দটা বাড়তেই হঠাৎ সে দেখে দুটো পুরুষালি হাত পেছন থেকে খপ করে ওর হাতের পাতাদুটো চেপে ধরেছে  দোলনার লোহার তার মুঠো করে ধরা অবস্থায়। 
কানের কাছে ফিসফিসিয়ে পুরুষালি কণ্ঠটা বলে উঠেছিল,
--"বন্দিনী ফুলকুমারী। এখন কেমন মজা!"

তারপর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল এক টগবগে যুবক।
ভয় ছাপিয়ে অন্যতর কিছু একটা আবেশ জড়িয়ে ধরছিল পর্ণাকে।
এভাবেই জয়দার সাথে প্রথম সাক্ষাৎটা ক্রমে প্রেমের জোয়ারে ভেসে গেছিল। এরপর বেশ কয়েকটা বছর ডুবেডুবে জল খেল দুই প্রেমিকযুগল।
তারপর একদিন বধূবেশে পর্ণা পা রেখেছিল এই গাঁজা ঘোষের বাড়ির চৌহদ্দিতে।

গাছের ফাঁক দিয়ে এক ফালি ভোরের মিঠে আলো এসে পড়েছে পর্ণার চোখে। ভাবনার জগত থেকে  বেরিয়ে আসে সে। জয়ের এবার ওঠার সময় হলো। দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় পর্ণা। আর টুপ করে কী একটা যেন খসে পড়ে তার কোল থেকে। নীচে তাকিয়ে দেখতে পায় শিশিরে ভেজা চাপ ঘাসের বুকে সোনার নোলকটাকে। হাতে তুলে নেয় পর্ণা।  মণিপিসির নোলক।  মণিপিসির নাকের পাতায় কোনো ফুটো ছিল না। ছিল নাকের ডাঁটিতে। প্রদীপের  আকারের নোলকটার থেকে লাল পাথরটা ঝুলত ঠিক উপরের ঠোঁটের মধ্যেখানের খাঁজের থেকে একটু উপরে। ঋতু বদলে মণিপিসির ফুলের সাজের ফুল বদলে বদলে যেত। কিন্তু ওই নোলক ছিল তার সর্বক্ষণের সাথী।

//2//

প্রায়দিনই রাতের আদর সোহাগের পর পরই জয় কেমন বেশ ঘুমে ঢলে পড়ে। পর্ণার ঘুম আসতে সময় লাগে। অনেকটা সময় ধরে ধীরে ধীরে শরীরে জেগে ওঠা ছোটবড় আন্দোলনের তরঙ্গগুলোর ওঠাপড়া শান্ত হতে বেশ খানিক সময় লাগে। পর্ণা ওই সময়টা আবেশে চোখ বুজে শুয়ে থাকে। 
আজও তেমনই শুয়েছিল সে। হঠাৎ কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে যেন শরীরে! আজ রাতে অনেকগুলো ফুলকপি মটরশুঁটির সিঙাড়া খেয়ে ফেলেছিল পর্ণা। এ বুঝি বা তারই ফল। এ বাড়িতে এসে পর্ণা তার শাশুড়ির থেকে এসব শিখেছে। শীতে নতুন ফুলকপি মটরশুঁটির পুর ভরা সিঙাড়া, নতুন ধানের চালের গুঁড়ি আর নলেনগুড়ের মিলমিশে হরেক পিঠেপুলি। ভাজা পিঠে, রসপুলি , সরুচাকলি,  চন্দ্রপুলি আরও কত কী। এমন কী রোদে পিঠ দিয়ে ডাল ফেনিয়ে ফেনিয়ে টোপর বড়ি, পোস্ত ছড়ানো গয়না বড়ি দিতেও শিখেছে সে এ বাড়িতে এসে।

পর্ণার গলাটা কেমন শুকিয়ে উঠছে। তাই জলের বোতলের জন্য তাকে উঠতেই হল। বাইরে ডাইনিং হলটা আবছা অন্ধকারে ডুবে আছে। কেমন জানি একটা শিরশিরানি ভাব জাগে।
গত পরশু মর্গে গিয়ে মণিপিসির দেহ শনাক্ত করে এসেছিল জয়রা। বেপাড়ায় রেলের পুকুরের ধারে বেহুঁশ দেহটা পড়েছিল দেখে কারা যেন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তাররা মৃত ঘোষণা করে।  স্ট্রোক। বেওয়ারিশ দেহটা মর্গে পাঠিয়ে দিয়েছিল ওরা। পরদিন থানা থেকে ফোন এসেছিল।
 
এক দৌড়ে তখন জলের বোতল নিয়ে পর্ণা ঘরে ঢুকে পড়তে পারলে বাঁচে। কিন্তু দরজার চৌকাঠে তার পা আঁটকে গেল।
জয়ের মাথার কাছে ও কে দাঁড়িয়ে! 
নীলচে রাতবাতির আলোয় সেই অপার্থিব শরীরের কান মাথা গলার সাদা ফুলগুলোতে অপার্থিব মৃত্যুর নীল আভা। উড়ন্ত খোলা চুলে বিদ্যুতের ঝলক।
মুহূর্তে পর্ণার মনে হয় মণিপিসি কি তবে তার নাকের নোলকটা ফেরত নিতে এসেছে! 

মণিপিসির পিছনেই দেওয়ালের গা ঘেঁষে  আলমারি। আর ওই আলমারিতেই নোলকটা তুলে রেখেছে পর্ণা।
'মণিহার' সিনেমার কথা মনে পড়ে যায় তার। মনে হয় মণিপিসির শাড়ির আড়াল থেকে একটা হাড় সর্বস্ব কঙ্কালের হাত হাতল ঘুরিয়ে এখুনি খুলে ফেলবে আলমারির পাল্লা।
কিন্তু  না। পর্ণা অবাক হয়ে দেখে তার ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে মণিপিসির ছায়া শরীর জয়ের কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পরম মমতায়। 
কয়েকটা মাত্র মুহূর্ত। মণিপিসির শরীরটা যেন ধোঁয়ার মতো মিশে যেতে লাগল বাতাসে। কোনও চিহ্ণ আর অবশিষ্ট রইল না এক সময়।
লেপের ভিতর কোনও ক্রমে সেঁধিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত জয়কে জড়িয়ে ধরল পর্ণা।

এরপর একদিন এক নিস্তব্ধ দুপুরে বড় হলটাতে আর্ম চেয়ারে গা এলিয়ে গল্পের বই পড়ছে পর্ণা। নিস্তরঙ্গ দুপুরগুলো এমনই কাটে পর্ণার।
ডানহাতি পশ্চিমের জানালার ওপাশে ডোবা মতন পুকুরটা। কলমি শাকের দল পাড় ছেড়ে বুক সাঁতারে এগুতে চাইছে মাঝপুকুর পানে। ডোবার ডানদিকের ঝুঁকে পড়েছে একটা বেঁটে কুল গাছ। গাছটার যেন স্থির জলের আরশিতে মুখ দেখে দেখে আর আশ মেটে না। তার সারা শরীর ছেয়ে টোপা টোপা হলুদ কুল। পুকুরের জলেও পড়ে ভেসে আছে বেশ কিছু। মানদাদি রেকাবিতে করে রেখে গেছে কতকগুলো। সাথে বিটনুন।
পুকুরের জলছবি জেগে আছে বামহাতি দেওয়ালের আয়নাটাতে। আজ গল্পের বই ছেড়ে বারেবারে চোখ চলে যাচ্ছে সেদিকে। একসময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পর্ণা। কেমন যেন নেশা ধরছে। পায়ে পায়ে উঠে যায় আয়নাটা সামনে। মুখোমুখি দাঁড়ায়। ছু মন্তরে বদলে গেল আয়নার বুকের জলছবি। পুকুরের বদলে আয়নায় এখন পেছনের দেওয়ালের খানিক অংশের প্রতিবিম্ব। প্রতিবিম্বে ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটাতে শ্বশুরের পাশে মণিপিসি! দুজনেরই কম বয়স তখন। মণিপিসির কপালের আধলা সাইজের দগদগে লাল সিঁদুরের টিপ। আর বাঁশির মতো টিকালো নাকের ডাঁটির থেকে ঝুলছে নোলক সহ বেদানা লাল টুকটুকে পাথরটা। থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পর্ণা। তবে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে গিরগিটির মতো ভোল পাল্টে গেল ছবিটার। কই মণিপিসি! এ তো তার দিদিশাশুড়ি। জয়ের ঠাকুমা। জয়ের ঠাকুরদা ঠাকুমার কম বয়সের যুগল ছবি। 
জয় তার বাবা আর ঠাকুরদার হুবহু কার্বন কপি। তাই মণিপিসির পাশের যুবককে তার শ্বশুর বলে ভ্রম হয়েছিল হয়ত পর্ণার। তবে এ কেমন বিভ্রম! মণিপিসির সাথে তার শ্বশুরকে কেনইবা দেখল সে.....
মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে পর্ণার। 

আয়না ছেড়ে উল্টো দেওয়ালে ছবির মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। এ ছবি সে অনেকবার দেখেছে। কিন্তু এত কাছ থেকে এই প্রথমবার। কিন্তু নোলকটা তো সে ভাবে খেয়াল করেনি সে এত দিন । অবিকল মণিপিসির নোলক!

//3//

শীতের বেলা জলদি শেষ হয়ে আসে। ঠাকুর দালানে মুখোমুখি বসে আছে পর্ণা আর মানদাদি।
সাঁঝ বাতির শিখা উত্তুরে বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে। ধূপধুনোর ধোঁয়ায় স্পষ্ট মুখ দেখতে পাচ্ছে না কেউ কারো । আঁচলের গিঁট খুলে পর্ণা তার মেলে ধরা তালুর উপর নোলকটা রেখে বলে,
--"মণিপিসির নোলকটা কি আসলে ঠাম্মার নোলক?"

মানদাদি থমকায় খানিক। যেন মনে মনে মেপে নিচ্ছে কতটা বলা উচিত আর কিভাবে বলবে সেটা।

--"জানো, সেদিন ভোরে মণিপিসির নোলকটা পাওয়ার পর থেকে আমি প্রায় দিন মণিপিসিকে দেখছি। নোলকটা কি ফেরত চায় মণিপিসির আত্মা? আজ আমি খেয়াল করলাম ঠাম্মারও একখানা অমন নোলক ছিল। কিন্তু শাশুড়িমাকে সে নোলক কখনো পরতে দেখিনি আর মারা যাবার আগে তাঁর গয়নার বাক্স তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন আমায়। তার মধ্যেও দেখিনি ওই নোলক।"

একটু ইতস্তত করে মানদাদি বলে,
--"ওই নোলক বড় কত্তামায়েরই। মণিমালাকে তিনি ভারি পছন্দ করতেন। আর মণিমালা পছন্দ করত ছোটকত্তা বাবু মানে তোমার শ্বশুরমশাইকে। বড় কত্তাবাবুর এসব পছন্দ ছিল না। একটা মালির মেয়ে কিনা এই ঘোষবাড়ির বউ হবে, এটা মানতে পারেননি তিনি। ছোটবাবু তখন কলকেতার কলেজে পড়াশুনা করেন। ওখানকার বোর্ডিংয়ে থাকতেন। সপ্তাহ শেষে বাড়ি আসতেন। বড় কত্তাবাবু সব জানতে পেরে তড়িঘড়ি সপরিবারে কাশী চলে গেলেন গুরুদেবের আশ্রমে তিথ্যি করতে। ফিরে এলেন ছেলের লক্ষ্মীমন্ত বউ সঙ্গে নিয়ে। বেনারসী শাড়ি, রজনীগন্ধার মালা মুকুটে নতুন কনের বেশে তোমার শাশুড়িমাকে দেখে মণিমালা কেমন গুম হয়ে গেল প্রথমটা। ঝড় ওঠার আগে প্রকৃতি যেমন থম মেরে যায়। পরদিন সকাল থেকে নতুন বউয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে থাকল গলায় মাথায় ফুলের মালা জড়িয়ে। বড় কত্তাবাবু ধমক দিলেন। তাও সরে না মেয়ে।
কত্তামা ম্লান মুখে বললেন,
--"থাক না বাপু ও ওর মতন। কারো কোনও ক্ষতি করছে না তো বেচারি।"	

সেদিন কালরাত্রির রাতেও নতুন বউয়ের কাছ ছাড়া হয়নি মণি। পরদিন বউভাতের দিন ঘটল ঘটনাটা। দুপুরে যখন ছোটকত্তাবাবু অন্ন বস্ত্র সহ থালা তুলে দেবে বউমণির হাতে সেই সময় নতুন শাড়ির উপর রাখা বড়কত্তামার নোলকটা খপ করে মুঠোয় নিয়ে মণি বলতে লাগল,
--"এটা আমার। এটা আমি কাউকে দেব না।"

সবাই হাঁ হাঁ করে উঠল। কত্তামা মণির মাথায় হাত বুলিয়ে কত্ত বোঝালেন। মেয়ের সেই এক গোঁ।

 বউমণি কী বুঝেছিল কে জানে। আনমনা হয়ে বলেছিল,
--"থাকনা ওটা ওর কাছে। তাছাড়া আমার তো নাকের ডাঁটিতে কোনো ফুটোও নেই।"

সেদিন সেই যে নোলকটা নাকে পরে নিয়েছিল মণি, আর কখনও একটা মুহূর্তের জন্যও সেই নোলক ছাড়া হয়নি সে।  
কত্তাবাবুও এ নিয়ে আর কথা বাড়াননি।"

--"যে নোলক তাঁর পুত্রবধূকে দেবার কথা সেটা অনাত্মীয় একজনকে ঠাম্মা দিয়ে দিলেন এভাবে! এ নোলকে তবে মণিপিসির থেকে আমার অধিকার বেশি তাই না! বড়কত্তামার নোলকের উত্তাধিকার তো আমার উপর বর্তায়।"
 
--" তা বটে সোনা বউমণি। তবে এ কথা অনেকে জানলেও জানে না অন্য আর এক গোপন কথা। এবাড়ির নুন খেইছি। তাই আমিও এই পোড়া বুকে সে কথাখান মাটি চাপা দিয়ে রেকিছিনু এতকাল। আজ তোমারে বলে একটু হাল্কা হই। উড়ে এসে জুড়ে বসে মণি এই নোলকের দখল নিয়েছিল ঠিক কথা কিন্তু প্রতিদানে এই বংশকে সে যে রতন দিয়ে গেছে তার জন্য এই ঘোষ বংশ তার কাছে বংশপরম্পরায় ঋণী থেকে যাবে।"

পর্ণা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে মানদাঝির মুখের পানে।

--"অনেক বছর পরেও যখন বউমণির কোল খালি রয়ে গেল তখন আবার বড়কত্তা সপরিবারে কাশীতে গুরুদেবের আশ্রমে গেলেন। এবার সঙ্গে নে গেলেন মণিমালাকেও। আর বছরখানেক পর বউমণির কোল আলো করা জয়দাদাবাবুকে নিয়ে ফিরে এলো সবাই। 
খুব গোপনে কাজ সারতে চেয়েও আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি কেউ। সোনাদাদাবাবুর বোতলের দুধ খেয়ে বেড়ে ওঠা আর মণিমালার ফুলের মালা চাপা পড়া বুকের দুধে ভিজে ওঠা শাড়ি - কোনওটাই আমার চোখ এড়ায়নি গো সোনাবউমণি।"

বেশখানিকক্ষণ থ হয়ে বসে থাকে পর্ণা। মানদা উঠে যায় চায়ের জল চাপাতে। যাবার সময় বলে যায়,
--বেশিক্ষণ এখানে একা বসে থেকুনি সোনাবউমণি। পোয়াতি মানুষ। সাঁঝের বেলা ভালো সময় নয়।"

******

পুকুরঘাটে এসে দাঁড়িয়েছে পর্ণা । নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে পূর্ণিমার সদ্য হলদেপানা চাঁদ। হাঁটু জলে নামতেই পায়ে কামড় বসায় পৌষের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। হুঁশ নেই তাতে পর্ণার। হলদেটে ঝরা কদম পাতার ফলকটা ভাসিয়ে দেয় সে জলে। উপরে রাখে মণিপিসির নোলকটা। হাত দিয়ে জলে ছোট ছোট ঢেউ তুলে গভীর জলের দিকে পাঠাতে থাকে পর্ণা। যার জিনিস  তার কাছে ফিরে যাক। 
মাঝপুকুরে তখন কুয়াশার দলা জমাট বাঁধছে। একটা কালো মাথা ভেসে উঠছে কি জলের বুকে! না কি পানকৌড়ি। 
দূরের থেকে মিঠে কোনো এক ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে, মাতিয়ে তুলছে  চারপাশ।
ঘোরের মধ্যে পর্ণা দেখে পানকৌড়িটাকে যেন মনে হচ্ছে কুয়াশা জমাট বাঁধা একটা আবক্ষ ছায়ামূর্তি। আর ডানা দুটো যেন দুই প্রসারিত হাত। আবক্ষ ছায়া শরীর জল ঢেউয়ে ঢেউয়ে টুপ করে ডুব দিল জলের গভীরে। জলের বুকে আন্দোলনের তরঙ্গ বিভঙ্গগুলো গোল গোল বৃত্তাকারে ছড়িয়ে যেতে লাগল পুকুরের পারের দিকে। আর সেই তরঙ্গের অভিঘাতে কদমপাতাটা ফিরে আসতে লাগল পর্ণার দিকেই। 
নোলক বুকে নিয়ে পাতাটা পর্ণার সমুখে এসে স্থির হয়ে ভেসে রইল।

পর্ণা বুঝল এ প্রীতি উপহার মণিপিসি তাকেই দিতে চেয়েছিল সেই ভোরে। আদর করে তুলে নিল সে আশীর্বাদী যৌতুকটা। নাকের ডাঁটিটা তাকে বিঁধিয়ে নিতে হবে শীত থাকতেই।

বৈশাখী ২০২৪