শীতঘুম

মহেশতলা, কলকাতা ১৪১


সকালের প্রথম আলো থেকে শুরু করে বিকেলের পড়ন্ত রোদটুকু সামনের ছোট ব্যালকনিতে এসে পড়ে। আলোয় রোদে মাখামাখি হয়ে থাকে ছোট্ট জায়গাটা।
ভোরের নরম আলো গায়ে মেখে প্রতিদিন সাধের ব্যালকনিটাতে চেয়ারে বসে আয়েস করে চা খায় আরশি। তবে এই আয়েসটুকু অল্প সময়ের জন্যই, একটু পর থেকেই শুরু হয়ে যায় দৌড় দৌড়। গৌতমের অফিস,ওর স্কুল।

অনেক দিন থেকেই এরকম একটা ব্যালকনির খুব শখ ছিল আরশির। তাই নতুন ঘরটা যখন হল, তখন আবদার করেছিল গৌতমের কাছে। সবাই বারণ করেছিল, ঘর ছোট হয়ে যাবে এই ভয়ও দেখিয়েছিল, কিন্তু গৌতম কারোর কথা শোনেনি। বউয়ের আবদার মাথায় রেখে ছোট্ট একচিলতে ব্যালকনি উপহার দিয়েছিল আরশিকে।

নভেম্বরের শুরুতে সকালের দিকে বেশ শিরশিরে একটা ঠাণ্ডা ছুঁয়ে থাকে। হালকা একটা ওড়না গায়ে জড়িয়ে এই নরম নরম ঠাণ্ডা ভাবটা উপভোগ করে আরশি এই সময়টায়। বাবা যতদিন ছিলেন ততদিন অল্প শীত পড়তে না পড়তেই গরম জামা পরার জন্য বকাবকি শুরু করে দিতেন। ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশি, বছর চারেক হতে চলল বাবা নেই। এখন আর বকাবকি করার কোনো লোকই নেই।

আরশিদের বাড়ির সামনে বেশ চওড়া ঢালাই রাস্তা, রাস্তাটা টপকে বিশাল মাঠ ছিল। পুরো শীতে ছুটির দুপুরগুলো দারুন কাটত সেখানে। বাড়ির সবাই মিলে রোদে পিঠ দিয়ে কৎবেলের আচার, চালতার আচার, আমড়া মাখা, আরো কত কী খাওয়া হত। লুডো নিয়ে চলে যাওয়া হত মাঠে, শাশুড়ি মা তো লুডো খেলার সময়ে দান দিতে গিয়ে ঘুমিয়েই পড়তেন। আর গৌতম কী ভীষণ চুরি করত লুডো খেলার সময়ে। একদিন তো রাগ করে আরশি লুডোর বোর্ড ছিঁড়েই ফেলেছিল। কী ছেলেমানুষীই না করত তখন!!

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই হেসে ফেলল আরশি। তারপরেই চাপা একটা কষ্টে মন ছেয়ে গেল। এখন আর কেউ নেই বাড়িতে ছেলেমানুষি করার মত। তাছাড়া এখন তো মাঠটাও নেই, মাঠের মধ্যে রোদে পিঠ দিয়ে বসে খেলার মানুষগুলোও নেই।

ঠিক কবে থেকে যে গৌতমের সাথে দূরত্ব তৈরী হয়েছে সেটা বলতে পারবে না আরশি। একেক সময় তো মনে হয় কয়েক যুগ পার হয়ে গেছে। অথচ একটা সময় এই গৌতমই চোখে হারাত আরশিকে। এখন সম্পর্কটা এতোটাই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে যে দুজনে কাছাকাছি থাকলেও শীত করে।

বিশাল খাটের দুপাশে দুজন শুয়ে থাকে, ভুলেও কেউ কাউকে ছোঁয় না। ঘুমের মধ্যে গায়ের থেকে চাদর সরে গেলেও আজকাল আর চাদরটা ঢাকা দিয়ে দেয় না গৌতম। তবে আরশির খুব ইচ্ছে করে, যেমন একটু আগেই করছিল। ঘর থেকে বেরোনোর আগে দেখেছিল, গৌতম কুঁকড়ে শুয়ে আছে, চাদরটা পায়ের কাছে পড়ে আছে। খুব ইচ্ছে করছিল ভালো করে চাদরটা ওর গায়ে চাপা দিয়ে দিতে, কিন্তু আরশি জেনে গেছে ওর এক্তিয়ারটা, চাদরটা ঠিক করে দিতে গেলেই গৌতম প্রচণ্ড বিরক্ত হবে। চিৎকার চেঁচামেচিও জুড়ে দিতে পারে।

বুবকাই যেদিন আরশিকে ছেড়ে হস্টেলে চলে গেল, সেদিনের ঘন্টা মিনিট সবটুকু আরশির কাছে আবছা, ও মনে করতে চায় না একদম। বড্ড কষ্টের সময় ওটা।

খুব দুষ্টু ছিল বুবকাই, সবসময় এটা ফেলছে, ওটা ভাঙছে। ওকে কোথাও নিয়ে গেলে আরশি তটস্থ হয়ে থাকত, এই বুঝি কিছু অন্যায় করে বসে! আর বুবকাই অন্যায় করলেই সব দোষ হয়ে যেত আরশির, তখন বুবকাই শুধু আরশির ছেলে।

বেশিরভাগ দিন স্কুল থেকে নালিশ আসত বুবকাই এর নামে। কারোর সঙ্গে কিছু মতবিরোধ হলেই তাকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছে অথবা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। অস্থির হয়ে গিয়েছিল গৌতম আর আরশি দুজনেই।

আরশি খুবই শান্ত স্বভাবের, শাশুড়ি মায়ের কাছে শুনেছে গৌতমও খুব দুষ্টু ছিল। কিন্তু স্কুল থেকে এরকম নালিশ কোনোদিন ওর সম্পর্কে আসেনি। আরশি তাই খুব চিন্তিত,কার মতো হল বুবকাই?

অনেক বুঝিয়েছে বুবকাইকে,কোনো লাভ হয়নি। তাই গৌতম যখন ওকে হস্টেলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল তখন ছেলের সপক্ষে কোনো কথা বলতে পারেনি। ওরা দুজনেই কাজে বেরিয়ে যায়, শ্বশুর শাশুড়ির বয়স হয়েছে। কে সামলাবে বুবকাইকে? এমন কাউকে পায়নি যে বুবকাইকে যত্ন করতে পারবে।

হস্টেলে পাঠানোর সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর বুবকাইয়ের চোখে যে অস্থিরতা দেখেছিল আরশি, তা আজও ওকে তাড়া করে বেড়ায়। একবুক অভিমান নিয়ে বাড়ি ছেড়েছে বুবকাই, হয়তো তখনই বাবা-মায়ের সঙ্গে ওর সম্পর্কটায় শীতলতা আসতে শুরু হয়ে গেছে।

প্রতি মাসে বুবকাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যেত আরশি, ফোনে যোগাযোগ রাখত ওর সাথে নিয়মিত। কিন্তু বুবকাই ততদিনে অভিমান জমিয়ে বিশাল একটা পাহাড় তৈরী করে ফেলেছে, আরশি কিছুতেই সেই পাহাড় ডিঙিয়ে ওর কাছে পৌঁছতে পারেনি।

ছোট্ট বুবকাই আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠল মা-বাবার সাহচর্য ছাড়াই। আশ্চর্যজনক ভাবে হস্টেলে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বুবকাই একদম শান্ত হয়ে গেল।

আরশির মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগে নিজেকে। বুবকাইয়ের বড় হয়ে ওঠাটা দেখতেই পেল না আরশি, ওর ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে পারল না। ওর সমস্যায় পাশে থাকতে পারেনি কোনোদিনই।

যখনই ওর সঙ্গে দেখা হত, তখনই মনে হত বুবকাই খুব বড় হয়ে গেছে। অন্যান্য মায়েদের মত ওকে ছেলের পড়াশুনার জন্য রাত জাগতে হয়নি, প্রোজেক্ট তৈরীর জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হয়নি। নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগে, মনে হয় এই পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যর্থ মা ও।

স্কুলের ছুটির দিনগুলোতেও পড়াশোনার অজুহাতে হস্টেলে থেকে গেছে বুবকাই। এতগুলো বছরে হাতে গুনে কয়েকবার বাড়িতে এসেছে ও। ঠাম্মি,দাদুভাই, দাদান আর দিদানের মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল নিজে থেকেই, আবার শ্রাদ্ধের কাজকর্ম মিটে যাওয়ার পরই রওনা দিয়েছে হস্টেলের উদ্দেশ্যে। বাড়তি একটা দিনও ওকে এখানে রাখা যায়নি। গৌতম একবার বলতে গিয়েছিল থাকার জন্য, এমন দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়েছিল বুবকাই যে, আরশির বুকের ভেতরটা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল।

বুবকাই হস্টেলে চলে যাওয়ার পরও স্বাভাবিকভাবেই গৌতমের সাথে জড়িয়ে ছিল আরশি। এক এক করে যখন বয়স্ক মানুষগুলো ছেড়ে চলে গেলেন ওদের, তখনও ভেবেছিল গৌতম ওর জীবন জুড়ে আছে।

হঠাৎ করেই কয়েকটা বছরে গৌতম আরশির সম্পর্কে নিরুত্তাপ হয়ে যেতে থাকে। ওদের সম্পর্কটার চারপাশে যেন অনেকগুলো হিমবাহ ঘুরে বেড়াচ্ছে, যে কোনো সময় ঠোক্বর লাগলেই খান খান হয়ে যাবে সম্পর্কটা। আরশির ভালো মন্দ কোনো কিছুই আর কোনো প্রভাব ফেলে না এখন গৌতমের জীবনে।

আরশির শ্বশুরবাড়ির পিছনদিকে একটা ছোটখাটো পুকুর আছে, সঙ্গে বিশাল বাগান। বড় বড় আম, জামরুল, আঁশফল, নিমগাছে ভর্তি। শুধু গাছই নয়, বাস্তুসাপও আছে একজোড়া। বাগানে ঘুরে বেড়ায়, কতবার শঙ্খ লাগতে দেখেছে ওদের। শীতকালে মাঝে মাঝে উঠোনে লম্বা হয়ে শুয়ে রোদ পোহাতে দেখা যেত।

হঠাৎ সাপের কথা কেন মনে হল আরশির নিজেও জানে না। তবে সাপের যেমন শীতঘুম রয়েছে ওদের সম্পর্কটাও তেমনি শীতঘুমে চলে গেছে। ঠাণ্ডা কমে গেলেই সাপেরা গা ঝাড়া দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, কিন্তু আরশি আর গৌতমের সম্পর্কটা যেন চিরস্থায়ী শীতঘুমের একটা বন্দোবস্ত করে নিয়েছে।

বুবকাই এখন কলেজ, ফাইনাল ইয়ার। এখন মাঝে মাঝে ছুটিছাটাতে বাড়িতে আসে ও, তবে বেশিদিন থাকতে চায় না। দু'দিন যেতে না যেতেই হস্টেলে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। পুরোপুরি না হলেও আগের থেকে অনেকটাই সহজ হয়েছে বুবকাই মা-বাবার সঙ্গে। তাই ও হস্টেলে চলে যাওয়ার কথা বললেই আরশি যখন ওকে কোনো বান্ধবীর কথা জিজ্ঞেস করে তখন বেশ লজ্জা পায়। আজকাল গৌতমও চেষ্টা করে বুবকাইয়ের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলতে।

হঠাৎ একটা হর্নের আওয়াজে চমকে ওঠে আরশি, তাকিয়ে দেখে শীতের সবজি ভর্তি ভ্যান নিয়ে একজন সবজিওয়ালা আসছে। ইস্, আজকে অনেক দেরি হয়ে গেল, কী সব যে ছাইপাঁশ মাথায় ঘুরছে আরশির! তবে আজ রবিবার বলে একটু বাঁচোয়া।

না, আর বসে থাকলে সব কাজে দেরি হয়ে যাবে। এমনিতেই শীতের বেলা, ঝুপ করে কখন যে শেষ হয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরে ছুটল আরশি। জলখাবার বানিয়ে ছেলেটাকে একবার ফোন করবে। গতকাল থেকে শরীরটা বিশেষ ভালো নেই বুবকাইয়ের। বাবা-মা ওকে নিয়ে যাতে চিন্তা না করে তাই অনেক কথা বলে না বুবকাই। ওর রুমমেট আদিত্য খুব ভালো, কোনো সমস্যা হলেই আরশিদের জানায় ও।

"আরশি আরশি, শিগগিরই শোনো এদিকে", গৌতমের হাঁকডাক শুনতে পেয়ে আরশি রান্নাঘর থেকে দৌড়ে উপরের ঘরে আসে। এসে দেখে গৌতম ফোনটা হাতে নিয়ে অসহায়ের মত বসে আছে বিছানায়। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে আরশির, কিছু খারাপ খবর নয় তো?

"শিগগিরই কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে তৈরী হয়ে নাও। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরোতে হবে", গৌতমের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় আরশি।
"কোথায় যাব? তাও এরকম হঠাৎ করে?"
"আঃ! যা বলছি কর। বেশি প্রশ্ন করবে না।" চীৎকার করে ওঠে গৌতম।
এই এক সমস্যা গৌতমের, নিজের যেটা ভালো মনে হবে সেটাই করবে। আরশিকে ধর্তব্যের মধ্যেই ফেলে না।

অকারণ অশান্তি একদম ভালো লাগে না আরশির, প্রতিবাদ না করে জামা-কাপড় গোছানোর জন্য আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। ঠিক তখনই কানে আসে, "বুবকাই খুব অসুস্থ। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। আদিত্য একটু আগে ফোন করে জানাল।"

মাথাটা যেন হঠাৎ ঘুরে যায় আরশির, এই শীতেও দরদর করে ঘামতে থাকে। কালই তো ছেলের সঙ্গে কথা হল,কই ও যে এতটা অসুস্থ সেটা একটুও টের পেল না তো আরশি!

"কী বলছ তুমি? হঠাৎ কী এমন হল যে হাসপাতালে ভর্তি করতে হল বুবকাইকে? কী গো, চুপ করে আছ কেন?", কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আরশি।

অনেক দিন পর আরশিকে জড়িয়ে ধরে গৌতম, ওর বুকের মধ্যে তিতির পাখির মত আরশির ছোটখাটো শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে কান্নার দমকে।

ফোনের আওয়াজে আলিঙ্গন আলগা হয় গৌতমের। চেন্নাই থেকে আদিত্য ফোন করেছে। যতক্ষণ গৌতম কথা বলল ওর সঙ্গে, ততক্ষণ আরশি উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

গতকাল সন্ধে থেকে শরীরটা বিশেষ ভালো ছিল না বুবকাইয়ের, বেশি রাতে আরো খারাপ হয়ে যায়। হস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট আর সব বন্ধুরা মিলে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। অ্যাকিউট ডায়রিয়া, সঙ্গে জ্বর বমি। সেই থেকে স্যালাইন চলছে সমানে, এখন খানিকটা ভালো আছে বুবকাই।

কী করবে ভেবে পায় না গৌতম। এখন ট্রেনের টিকিট কেটে যেতে গেলেও প্রায় তিনদিন সময় লেগে যাবে চেন্নাই পৌঁছতে। ততদিনে হয়তো বুবকাইকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু ওর শরীরের এই অবস্থায় হস্টেলে রাখা এখন নিরাপদ নয়।

শেষে অবশ্য আরশির প্রস্তাবটা মনঃপূত হয় গৌতমের, "ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার কোনো দরকার নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেলের কাছে পৌঁছতে হবে আমাদের। টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করলেও চলবে না এখন। যতটুকু রোজগার সেটা তো ছেলের জন্যই। যে কোনো উপায়ে ফ্লাইট ধরতে হবে চেন্নাইয়ের, বুবকাইয়ের পাশে থাকাটা এই সময়ে খুব জরুরি।"

"বুবকাই, একদম অবাধ্যতা করবে না। এটুকু খাবার খেয়ে নিতে পারবে তুমি। ঠিক আছে, হাঁ করো, আমি খাইয়ে দিচ্ছি," মায়ের কথায় চোখে জল এসে যায় বুবকাইয়ের। ছোট থেকে এটাই তো চেয়েছিল ও।

গৌতম আবার সেই দেখে একটু ইয়ার্কি করতে ছাড়ে না, "এত বড় ছেলের চোখে জল? তার মানে যতটা স্ট্রং বলে নিজেকে দেখানো হয় ততটা স্ট্রং মোটেই নয় আমাদের বুবকাই, কী বল আরশি?"
মুচকি হেসে আরশি বলে, "তাই তো। নইলে এতবড় ছেলেকে কি খাইয়ে দিতে হয়?"

মুখে কথাগুলো বললেও মনে মনে জানে আরশি, এত বছর পর ছেলেকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে পেরে কতটা আনন্দ হচ্ছে।

গত রবিবার যে পরিস্থিতি ছিল এই বাড়িতে, ঠিক তার বিপরীত পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে এই মুহূর্তে।

অনেক কসরত করে দুপুরের ফ্লাইটে সেদিন দুটো টিকিট পায় গৌতম। চেন্নাই পৌঁছে হাসপাতালে যেতে যেতে সন্ধে পেরিয়ে গিয়েছিল। আরশি সারাটা পথ দুশ্চিন্তায় কাঁটা হয়ে ছিল। কী জানি কেমন আছে ছেলেটা!

অনেক অনুরোধ উপরোধের পর একঝলক দেখতে পেল বুবকাইকে, তাও দূর থেকে। স্যালাইন চলছে তখনো, একটা দিনের মধ্যেই ছেলের চেহারাটা ভেঙ্গে গেছে। চোখ ফেটে জল আসছিল আরশির, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল। 

হঠাৎ এত শীত করছে কেন আরশির? তবে কি ওর ভেতরের অনুভূতিগুলো মরে যাচ্ছে? না, এই তো ওর কান্না পাচ্ছে খুব। বুবকাইয়ের কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। তাহলে কেন এই শীত ভাবটা বারবার ফিরে ফিরে আসছে? ভয় করছে ওর, বুবকাইকে সুস্থ করে বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে পারবে তো?

ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলল গৌতম, আশ্বস্ত করলেন উনি। দিন তিনেকের মধ্যেই ছেড়ে দিতে পারবেন হাসপাতাল থেকে। খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একটা হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল দুজনে।

চারদিন পর বুবকাইকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে সোজা নিজেদের বাড়িতে, কলেজে আর হস্টেলে কথা বলে রেখেছিল গৌতম আগেই। বুবকাই অন্তত দুটো সপ্তাহ বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে একটু সুস্থ হয়ে তারপর কলেজ জয়েন করবে।

কবে যে শেষ মায়ের হাতের রান্না খেয়েছিল বুবকাই, মনেও করতে পারে না ও। অনেক দিন পর নিজের ঘরে এসে যেন ভীষণ নিশ্চিন্ত লাগছে। হাসপাতালে একটু সুস্থ হওয়ার পর বাবা-মায়ের উদ্বিগ্ন মুখ দেখে যেমন খারাপ লেগেছিল, তেমনি আবার ওদের দুজনকে একসাথে দেখে খুব খুশি হয়েছিল মনে মনে।

কয়েক বছর ধরেই বাড়িতে এলে দেখত বাবা-মায়ের একে অপরের সঙ্গে অদ্ভুত একটা ঠাণ্ডা ব্যবহার,খুব কষ্ট হত ওর। কিন্তু এবার যেন কোথাও সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে।

অবাক হয়ে দেখছে বুবকাই, ওর বাবা শুধুমাত্র ওর জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিয়েছে। বাড়িতে অফিসের যেটুকু কাজ না করলে নয় সেটুকু করে বসে পড়ছে বুবকাইয়ের সাথে গল্প করতে। এই বাবাকে ও চেনে না, মায়ের সঙ্গে একটুআধটু গল্প করলেও বাবার সঙ্গে গল্প করা হয়ে ওঠেনি কখনো। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এখন বেশ ভালোই লাগছে বাবার সঙ্গে কথা বলতে। অনেকটা ভারমুক্ত লাগছে নিজেকে।

বাড়ির কাছাকাছি জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে মেলা বসেছে, হঠাৎ একদিন বাবা ওখান থেকে মায়ের পছন্দের চিনেবাদাম আর ওর জন্য বাদাম চিট নিয়ে এসে হাজির।
"বুবকাই এসব খাবে এখন? কদিন আগেই ছেলেটা অসুখ থেকে উঠল, কত সাবধানে খাবার দিতে হচ্ছে, আর তুমি ওর জন্য বাদাম চিট নিয়ে এসে হাজির করলে?" আরশির বকুনি খেয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে গৌতম বলে উঠল, "আমার একদম খেয়াল ছিল না গো। আসলে ছোটবেলায় বায়না করত, তখন শরীরের কথা ভেবে কিনে দিইনি। তাইই মনে হল…"

এর আগে এতটা তৃপ্তি কখনো বুবকাই পায়নি। বাবা নাকি মায়ের কাছে বকুনি খাচ্ছে!! আর মাকেও আগে কখনো দেখেনি বাবাকে এরকম ভাবে বকাবকি করতে। এখন বুবকাইয়ের মনে হচ্ছে ভাগ্যিস অসুখটা হয়েছিল।

তাই তো যে সম্পর্কগুলো শীতঘুমে চলে গিয়েছিল সেগুলো আবার উষ্ণতায় ভরে যাচ্ছে।

আর শীতঘুম নয়, বাকি জীবনটা একে অপরকে জড়িয়ে বুকের মধ্যে উষ্ণতার ওম নিয়ে এভাবেই কাটিয়ে দিতে পারবে ওরা তিনজন।

2 Responses

  1. Mohammad Kazi Mamun says:

    ‘’আলোয় রোদে মাখামাখি হয়ে থাকে ছোট্ট জায়গাটা’’
    ছোট্র ব্যালকনির গল্প এটি। শীতঘুমের কবলে পড়েছিল। কিন্তু জেগে উঠল জীবনকে উচ্চে তুলে ধরে।

    “খুব ইচ্ছে করছিল ভালো করে চাদরটা ওর গায়ে চাপা দিয়ে দিতে, কিন্তু আরশি জেনে গেছে ওর এক্তিয়ারটা, চাদরটা ঠিক করে দিতে গেলেই গৌতম প্রচণ্ড বিরক্ত হবে”
    আলতো মায়ার পরশ। মিহি। নরম। কিন্তু আবার সেখানেই অভিমানের তীব্র ঢেউ।

    “লুডো নিয়ে চলে যাওয়া হত মাঠে, শাশুড়ি মা তো লুডো খেলার সময়ে দান দিতে গিয়ে ঘুমিয়েই পড়তেন।“
    আহা! ছেলেবেলায় দেখা দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দিল।
    “স্কুলের ছুটির দিনগুলোতেও পড়াশোনার অজুহাতে হস্টেলে থেকে গেছে বুবকাই।“
    অপুর কথা মনে পড়া গেল। আসলে গল্পগুলি এমনই, একই রকম, ফুরোয় না।
    ভাল লেগেছে, তন্বীদি!

  2. manjulika ray says:

    খুব ভালো গল্প। সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে গল্প।

বৈশাখী ২০২৪