ওয়ারড্রোবের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ খানিকক্ষণ হ্যাঙ্গারে টাঙানো জামাগুলোকে জরিপ করল মধুজা। এমনিতে কোথাও যাওয়ার নামে বিন্দুমাত্র সময় অপচয় করে না সে। কিন্তু আজকের দিনটা অন্যদিনের থেকে আলাদা। সকাল থেকেই বাড়িতে এই পশমী রোদ মাখা শীতের সকালে গুমোট ভাব বিরাজমান, আর ঠিক এই কারণে, পোশাক নির্বাচনে এতটা সময় নিচ্ছে সে। এ তো আর অন্যদিনের মতো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বা সিনেমা দেখতে যাওয়া নয়। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মানুষের সঙ্গে পছন্দ-অপছন্দের রঙ মিলন্তি খেলতে যাবে সে। এই নিয়ে তার চারটি বিয়ের সম্বন্ধ ভেস্তে গেছে। বলা যেতে পারে সে নিজেই ভেস্তে দিয়েছে। এটা পঞ্চম। মধুজার কাছে বিয়ের সম্বন্ধ ব্যাপারটা, অনেকটা জিগ-স-পাজেলের মতো মনে হয়। দুটো মানুষ নিজেদের কতগুলো এলোমেলো খাঁজকাটা পছন্দকে একে অন্যের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করে। সত্যিই কি দুটো মানুষের ছন্দ মেলে? এভাবে সত্যিই কি মনের অন্ত্যমিল হয়? কোনো ছেলের ড্রেসিং সেন্স খারাপ, তো কোনো ছেলে বড্ড গম্ভীর। জীবনে হিউমার শব্দের কোন অস্তিত্বই নেই। কারো সাহিত্যে আগ্রহ নেই, তো কারোর বিশাল কেউকেটা ভাব। মধুজা ওর বাবা মাকে কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারে না, যে মানুষটা ওর রোজনামচার জীবনের সঙ্গী হবে, তার আচার-আচরণে, চলনে ওর ভালোলাগাগুলো জড়িয়ে থাকবে। এক বিপরীত মেরুর মানুষকে সঙ্গী করে সারা জীবন নিজের পছন্দগুলো বাক্সবন্দী করে গুমরে মরে কী লাভ ? কথায় বলে, অপজিট অ্যাট্রাকস ইচ্ আদার। কিন্তু তাতে যে সমাধানটা শূন্য হয়! একটা মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হয় দুপক্ষ। সেটা কি কেউ ভেবে দেখে! তাই মধুজা পণ করেছে, যে ছেলের সঙ্গে তার সকল পছন্দ, ভালো লাগার বিষয়গুলো অক্ষরে অক্ষরে মিলবে, একমাত্র তার সঙ্গেই জীবনের তার জুড়বে। কোন্ মেয়ের বাবা-মা তাঁদের মেয়ের এ হেন অযৌক্তিক চাহিদাকে মেনে নিতে পারেন? তাছাড়া প্রতিবার সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবার পরও একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে মেয়ে বেঁকে বসে। ছেলের কোন না কোন খুঁত ঠিক খুঁজে বের করবেই। বিভান অঞ্জুর ছোটবেলার বন্ধু অনিমার ননদের ছেলে। অনিমা যখন মধুজার সঙ্গে বিভানের সম্বন্ধ আনে, অঞ্জু একটু দোনামোনা করেছিলেন। নিজের মেয়েকে তো হাড়ে হাড়ে চেনেন। সম্বন্ধ নাকচ করে দিলে অনিমার সঙ্গে বন্ধুত্ব না ভোকাট্টা হয়ে যায়। বিভানকে দেখেছিলেন অনিমাদের বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে। তখন মনে হয়েছিল এই ছেলের শুধু লেজটুকুই নেই। সারা বিয়েবাড়ি জুড়ে বাঁদরামি করে বেড়িয়েছিল। এখন অবশ্য সে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির আইটি প্রফেশনাল। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে বুড়িও ছোটবেলায় কম মুখরা ছিল না, নাম তার যতই মধুজা হোক না কেন! কোন কিছু পছন্দমাফিক না হলেই তার বাক্যবাণ ছুটত। বড় ছোট জ্ঞান ছিল না। এখনো অবশ্য মানে না। এই দুইয়ের মেলবন্ধন কিভাবে ঘটবে সে নিয়ে অঞ্জু ও অখিলেশ বেশ সন্দিহান। মধুজাকে দেখতে অনিমার সঙ্গে বিভানের মা-বাবা এসেছিলেন। হাসিখুশি সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবার যেমন হয়। ওদেরকে বেশ পছন্দ হয়েছে অঞ্জু ও অখিলেশ দুজনেরই। মধুজাকে অহেতুক প্রশ্ন তারা করেননি। সন্ধ্যেটা প্রাণোচ্ছল গল্প গুজবেই কেটে গিয়েছিল। এর মধ্যেই দুই পরিবারের সখ্যতা জমে উঠেছে। প্রতিবারের মতো মধুজার উন্নাসিক স্বভাবের জন্য এত ভালো পরিবারের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ না হওয়ার আক্ষেপ থেকে যাবে। মধুজাকে তাই সকাল থেকে পাখিপড়ার মতো বুঝিয়ে চলেছেন অঞ্জু। —- দেখ্ বুড়ি, নিজের সকল পছন্দ যদি অন্য কারো সঙ্গে মেলাতে যাস, তাহলে বড় মুশকিল! প্রত্যেকটা মানুষ স্বতন্ত্র। প্রত্যেকের পছন্দ অপছন্দও আলাদা। সবকিছুর মিল খুঁজতে যাওয়া বোকামো ছাড়া আর কিছু নয়। —-মা আমি সব কিছু মেলাতে কোথায় যাচ্ছি? কিন্তু দুটো মানুষ যারা চব্বিশ ঘন্টা তিনশ পয়ঁষট্টি দিন একই ছাদের নিচে দিন কাটাবে, তাদের বেসিক পছন্দ অপছন্দগুলো তো মেলা উচিত? —-বেসিক বলতে কী বোঝাচ্ছিস? —- এই ধর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সাহিত্যে অনুরাগ, কোন মানুষ কী রকম গান শোনে বা বই পড়ে, তা থেকে তার রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। রুচিহীন মানুষের সঙ্গে কি করে জীবন কাটাব? —-- বুড়ি, কলেজে ছেলে মেয়ে পড়িয়ে তুই একটি উচ্চমার্গের আঁতেল তৈরি হয়েছিস! মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল্। সবকিছু মেলে না। বিভান ভালো চাকরি করে। দেখতে শুনতে ভালো। তোর সঙ্গে যখন আলাদা কথা বলতে চেয়েছে, তখন কথা বলে বুঝে শুনে নে। সব মেলাতে গেলে ইহজন্মে আর বিয়ে হবে না তোর! —--সে না হলে না হবে। বিয়েটাই আমার জীবনের মোক্ষলাভ নয়। বিয়ে করতে হবে বলে একটা অযোগ্য লোককে লাইফ পার্টনার বানাব না। আর বিভান কী করে ভালো ছেলে হল? তুমিই তো বলেছিলে কার বিয়েতে গিয়ে হালুইকরের খুন্তি দিয়ে গাছের টব ভাঙছিল! —-সে তো তখন ও খুব ছোট। এখনও কি তেমন আছে নাকি! তুই যা, ওর সঙ্গে কথা বল। ওদের পরিবার এত ভালো, ছেলেটাও নিশ্চয়ই ভালো হবে, যেমনটি তুই চাইছিস। কলকাতায় এখন শীত পড়ছে ঝুরো ছাতিম ফুলের মত। হাওয়ায় এক মিঠে সুবাস। দুপুরের মোলায়েম রোদের ওম গায়ে মেখে, শিরশির হওয়ার আলতো স্পর্শ নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাত ধরে হাঁটছিল মধুজা। গাড়িটা পার্ক করেছে বেশ খানিক দূরে। নভেম্বরের শেষ দিকে আদুরে শীতের প্রবেশ ঘটতেই সাহেবপাড়ায় সাজসাজ রব ওঠে। বেকারিগুলোয় কেকমিক্সিং এর তোড়জোড়। আধলো গায়ে বাচ্চা ছেলেগুলো হাতে গোলাপ আর বেলুন নিয়ে সিগন্যালে দাঁড়ানো গাড়িগুলোর কাচে আটকে যাচ্ছে। বেশ লাগে এই সময়টাকে উপভোগ করতে। শীত যেন পৌরুষের আতর মাখা কোন হ্যান্ডসাম হাংক। যত এগিয়ে আসে তত পুরুষালি আঘ্রাণে কোনো নারীর হৃদয় শিহরিত হয়। অ্যান্টিক শপটা পেরোতেই ক্যাফেটা নজরে এলো। লাভার্স ক্যাফে, এখানেই তো আসতে বলেছে বিভান। এখন কলকাতায় প্রতি মাসেই নতুন ক্যাফে গজিয়ে ওঠে। নতুন প্রজন্মের ব্যস্ত সময়ের ফাঁক গলে কথারা তুরুপের তাসের মতো পিঠোপিঠি খেলা খেলে। বিভানকে একবারই ছবিতে দেখেছিল মধুজা। ওই একই ছবি হয়ত ওর অফিসের সিভিতেও সেঁটে আছে। চশমা আঁটা চোখে, গোমড়া মুখে, ইস্ত্রি করা পরিপাটি শার্টে, নিজেকে উচ্চপদস্থ সুচাকুরে প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা। মধুজা আজ ডেনিম জিন্সের ওপর ব্ল্যাক রেড চেক ফুলস্লিভ শার্ট চাপিয়েছে। এ নিয়েও তার মায়ের বিস্তর অনুযোগ ছিল। অত পাত্তা দেয়নি। কোণের টেবিলের সামনে চেয়ার থেকে রেড টি-শার্ট পরা এক যুবক মধুজাকে হাত নেড়ে স্বাগত জানাল। ছবির গোমড়া মুখ না হলেও বিভানকে চিনতে অসুবিধা হল না মধুজার। ছবি তোলার সময় প্রতিটা মানুষ বড় বেশি সচেতন হয়ে পড়ে নিজের আপাত ভালো নির্যাসটুকুকে নিংড়ে বের করে আনতে। অন্য সময় সেই একই ব্যক্তি তার মিশ্র সত্ত্বাটাকে নিয়ে আলুথালু হয়ে থাকে। বুঝে পায় না ঠিক কোন সত্ত্বাকে প্রকাশ করবে, এই যেমন বিভানকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ টেনসড। অফিসিয়ালি এটা ওদের ফার্স্ট ডেট বলা যায়। দুজনের পোশাকের রং মিলে যাওয়ায়, লাল যে ওদের দুজনেরই পছন্দের তালিকায় রয়েছে তা তো বোঝাই যায়। প্রথম দর্শনেই রংমিলন্তিতে মধুজার মনের কুয়াশার স্তর কাটল। —- আপনাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম। —- না আমিও কিছু আগেই এসেছি। স্মার্ট ওয়াচে চোখ বোলায় বিভান। —কফির অর্ডার দিই? হানি সিনামন কফি চলবে তো? বিভানের প্রশ্নে অবাক হয় মধুজা। —- আরে ওটা আমারও ফেভারিট, আপনারও নাকি? —- হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। মধুজার আলস্য জড়ানো আবেগগুলো যেন প্রশ্রয় পাচ্ছে। এরপর দুজনের গল্পের জোড়া শালিখ ডানা ঝাপটে কখনো এ ডালে কখনো ও ডালে গিয়ে বসে। আলোচনার বিষয়বস্তু সাহিত্য থেকে রাজনীতি, সংগীত থেকে খেলাধুলায় অবাধ বিচরণ করে। মধুজার উন্নাসিক পছন্দরা একজোট হয়ে ওকে সমস্বরে বলতে শুরু করেছে, "মিলেছে মিলেছে, হি ইজ্ ইওর ম্যান" বহুক্ষণ বাদে মধুজার চোখে চোখ রেখে বিভান জিজ্ঞেস করে, —- সন্ধ্যে হয়ে আছে এবার তো উঠতে হবে। কেমন লাগল আমাকে আপনার। জানি বড্ড বেশি তাড়াহুড়ো করছি, তাও... বাবা মাকে কি আপনার বাবা মার সঙ্গে কথা বলে বিয়ের ডেটটা ফিক্স করতে বলব? ঠোঁটের কোণে রহস্যময়ী হাসি খেলিয়ে চোখের পলক নামিয়ে হাতের পাতায় ত্রিকোণ থুতনি ঠেকিয়ে মধুজা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। —- তাহলে শীতটা কাটুক, মার্চের প্রথম দিকেই ভালো হবে। ভ্রু কুঁচকায় মধুজা। —- সে কি গরমে বিয়ে? —- মার্চের প্রথমে সেরকম গরম কোথায়? আর তাছাড়া শীত ব্যাপারটা আমার ঠিক পোষায় না। এই তো দেখুন, এক্ষুনি বাইরে বেরোলেই খুনখুনে কাশির মতো একটা অস্বস্তিকর ঠাণ্ডা হাওয়া এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে আপনার উপর। কুঁকড়ে যাবেন আপনি। তারপর ঠাণ্ডা লাগা, গলাব্যথা, মাথা যন্ত্রণা, গার্গেল, জ্বর, জলপট্টি, প্রেসক্রিপশন, ওষুধ এসবের ঝক্কি সামলাতে হবে। শীতকালের বিয়ে বাড়ির কথা আপনি একবার ভাবুন, এত সেজেগুজে কী লাভ? সেই তো গায়ে শাল, সোয়েটার, ব্লেজার চাপাতে হবে। যারা নিমন্ত্রিত তাদের দিকটাও তো ভাবতে হবে। আমাদের আবার লতায় পাতায় আত্মীয়। তাদের থাকার জন্য লেপ-কম্বল গদি - এগুলোর অ্যারেঞ্জমেন্ট। মধুজা পাল্টা বলে, —- শীত আমার কাছে বড় রোমান্টিক। ভোরবেলা জানলা খুললেই কুয়াশা এসে আপনাকে ভিজিয়ে দেবে। হাতে গরম চায়ের কাপ থেকে ওঠা ধোঁয়া তাতে আলপনা আঁকবে। —- সেই কুয়াশা কেটে ড্রাইভ করে যারা অফিস যায় তাদের কথা ভেবে দেখেছেন? কী রিস্কি ব্যাপারটা! আর শীতের ভোরে স্নান! আমি তো সাওয়ার খুলে কিছুক্ষণ ইষ্টনাম জপ করি। বিভানের প্রতি মধুজার যেটুকু অনুরাগ জন্মেছিল, একটু একটু করে তিক্ত হতে লাগল। — এই যে দুপুরের মিঠে নরম রোদ, এর উষ্ণতা নিয়েছেন কখনো? রোদ তো নয়, যেন মায়ের আদর! আর আপনার গরমের দুপুর? ঘাম, দুর্গন্ধ - ম্যাগো! নাক কুঁচকায় মধুজা। কল্পিত ঘামের দুর্গন্ধ যেন ওর নাকে ঠেকে। —-- দুপুরের নরম রোদ কতক্ষণ আর থাকে বলুন? আমাদের অফিসের শৈবালদা, কিউবিকলে বসতে না বসতেই বাড়ি যাবার তাড়া। ওই সূর্যদেবকেও শীতকালে আমার শৈবালদার মতো মনে হয়। দুপুর হতে না হতেই, 'আসি রে' ! ছোটবেলায় এত রাগ হত বিকেলে খেলতে নামতে না নামতেই সন্ধে! —- শীতের নলেন গুড়, ওটা তো ইউনিক। অন্য সময় পাবেন না। পিঠে পুলি, ওফ্! ভাবলেই জিভে জল। —- কে বানায় আপনার বাড়িতে? নিশ্চয়ই আন্টি! ভেবে দেখেছেন আন্টির কথা? কত পরিশ্রমের কাজ। সামনে বসা বেরসিক ছেলেটিকে মধুজার এবার বেশ অসহ্য লাগতে শুরু করেছে। কিন্তু সে দমবার পাত্রী নয়। —- বাড়ির কোনো কাজ করেন আপনি? শীতে সবজি বাজারে গেছেন কখনো? কত কালারফুল সবজি ওঠে ওই সময়। —- কিছু মনে করবেন না। শীতের প্রত্যেকটা সবজি খাওয়ার আফটার এফেক্টটাও নিশ্চয়ই জানেন। ফুলকপি বাঁধাকপি খেয়ে বিয়ে করা নতুন বউয়ের সামনে—- না না আমি ভাবতেই পারছি না। বাই দ্য ওয়ে আপনাকে জানিয়ে রাখি, আমার এক্স-ও আপনার মত শীতবিলাসী ছিল। কথায় কথায় ঠান্ডা হাত আমার গালে ঠেকাত। উফ! বিশ্বাস করবেন না, শীতের দিনে মনে হত সারা গায়ে ইলেকট্রিক শক লাগল। আমাদের ব্রেকআপ হওয়ার ওটাও একটা কারণ। আপনি আবার ওরকম করবেন না তো? গরম তেলে ঝাঁপ দেওয়া শীতের ফর্সা বার্তাকু সুন্দরীর ন্যায় মধুজা জ্বলে উঠলো। টেবিলে চাপড় মেরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, —- আপনি, আপনি একটা অসহ্য, ইতর প্রাণী। শীতের নরম রোদ, নতুন গুড়ের গন্ধ যে উপভোগ করতে পারে না, তার সঙ্গে আমি মানালিতে হানিমুনে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ বসে বসে। আমার তো সন্দেহ হয়, আপনি শীতকালে আদৌ স্নান করেন কিনা! একটুও বিচলিত না হয়ে শান্ত স্বরে বিভান মধুজাকে ক্যাফের কাচের জানলার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, —- উল্টো ফুটপাতের ওই অর্ধনগ্ন বাচ্চাগুলোকে দেখুন, আপনি যখন রুম হিটার জ্বালিয়ে লেপের নরম উষ্ণতায় নিজেকে সঁপে শীত উপভোগ করবেন, ওই উদোম গায়ের ছেলেটা তখন শীতের কামড় থেকে বাঁচার জন্য ওর মায়ের কোলে উষ্ণতা খুঁজবে। মধুজা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে হিল দাপিয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল। এতক্ষণের যুক্তির দাপাদাপিতে বিভানের খেয়ালই ছিল না যে, সে একটা ক্যাফেতে বসে আছে। চারপাশের টেবিলগুলোতেও তখন স্তব্ধতা। কয়েক জোড়া চোখ ওর দিকেই নিবদ্ধ। বিল মিটিয়ে চেয়ারের কোণে ঝুলিয়ে রাখা হালকা জ্যাকেটটাকে গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে আসে ক্যাফের বাইরে। ত্রিসীমানায় মধুজাকে দেখতে পেল না। পকেট থেকে মোবাইল বের করে কন্টাক্ট লিস্ট ঘেঁটে অঞ্জু আন্টির নাম্বার প্রেস করল বিভান। —- হ্যালো আন্টি, কেস জন্ডিস হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। উদ্বিগ্ন হয়ে অঞ্জু বললেন, —- কেন? এত করে বুড়ির কী পছন্দ অপছন্দ সব তোমায় শিখিয়ে পড়িয়ে দিলাম, তারপরেও কাঁচালে কী করে? —- শীত যে মধুজার ভীষণ প্রিয়, সেটা তো তুমি বলনি? তোমার মেয়ে তো ভীষণ রেগে বেরিয়ে গেল। —- ঠিক আছে, তুমি ছাড়ো, আমি এদিকটা সামলাচ্ছি। নাছোড়বান্দা, বেখাপ্পা খুলতে না চাওয়া কৌটোর ঢাকনার মতন মধুজার মুখ যে এখন কোনমতেই খুলবে না, তা মা হয়ে অঞ্জু বিলক্ষণ জানেন। মেয়ে বাড়ি ফেরার পর থেকে তাকে ঘাটানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেননি তিনি। আগামীকালের আগে যে মুখের আগল খুলবে না তাও তিনি জানেন। শুধু একবার রান্নাঘর থেকে বেশ উঁচু স্বরে বললেন, —- এই ঠাণ্ডা পড়লে, ঠাণ্ডা জলে বাসন মাজা যে কী কষ্ট, তা শীতপ্রেমীরা কীভাবেই বা বুঝবে? নিজের ঘরে টেবিল ল্যাম্পের সুইচটা অন অফ এর খেলায় মেতেছিল মধুজা। ওর মনেও আজ দুপুরের ভালো, তিক্ত অনুভূতিগুলো ল্যাম্পের আলোর মত কখনো জ্বলে উঠছে, আবার নিভে যাচ্ছে। বিভানের শেষ কথাগুলো চোরা ঘূর্ণির মত টানছিল মধুজাকে। ওর যুক্তিগুলো তো অকাট্য নয়। বিভানের জন্য একটা মৃদু ভালোলাগা, চায়ে ডোবা বিস্কুটের মত মনের তরলে ভিজছিল। খুব সন্তর্পণে মধুজা তাকে তুলে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই ভালোলাগাটুকু যেন মধুজার কপট শাসানি উপেক্ষা করে টুপ করে ডুব দিচ্ছে। ফোনের সুরেলা ধ্বনিতে সম্বিত ফেরে মধুজার। স্ক্রিনে ভাসছে 'বিভান কলিং' । ইতস্তত করে ফোন ধরল মধুজা। —- হ্যালো, বিভান বলছি, রাগ করেছেন? এরপর আমি যা বলব আপনি আরো রেগে যাবেন। আমি অঞ্জু আন্টির কাছে আপনার পছন্দ-অপছন্দ জানতে চেয়েছিলাম। তাই আপনার পছন্দগুলো আমি আগেই জানতাম। আপনাকে পাওয়ার জন্য এইটুকু কপটতার আশ্রয় আমাকে নিতে হয়েছে। ভেবে দেখলাম, এভাবে নতুন সম্পর্ক গড়া যায় না। বাড়িতে এসে মেইল চেক করতে গিয়ে দেখি, আমার সুইডেনের স্টকহোমে অনসাইট হয়েছে। শীতকালে সেখানে তাপমাত্রা মাইনাস ফাইভ ডিগ্রীতে নেমে যায়। সারা শহরটা বরফে ঢেকে যায়। ক্যান্ডিফ্লসের মত গাছের পাতার খাঁজে ঝুলে থাকে পেঁজা বরফ। কখনো চলার পথে বরফ ঢাকা পথে এরান্তিস ফুল উঁকি দেয়। লেকগুলো কাচের টেবিলের মত হয়ে থাকে। যাবেন নাকি আমার সঙ্গে এক বৃদ্ধ শীতের দেশে? এ কথার কী উত্তর দেবে মধুজা ভেবে পাচ্ছিল না। ওপারের নীরবতায় বেশ ঘাবড়ে গেল বিভান। — মধু, আপনি কি শীত ঘুমে? এবার হেসে ফেলে মধুজা। —- যেতে পারি, তবে বিয়ের তারিখ মার্চের বদলে জানুয়ারিতে এগিয়ে আনতে হবে। বিভানের হৃদয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। শীতল স্বরে বলে, —- তবে তাই হোক।