সন্ধি

কল্যাণী, নদিয়া


ছোটোবেলায় আমি রাগী ছিলাম। সে একেবারে ভীষণ রাগ। মারমার কাটকাট। সে সব নানা দোটানায় আটকে থাকা দিন। হামাগুড়ি দেব না খাটেই চিৎ-উপুড় হয়ে গড়গড়িয়ে চলব; বাব্বা, দাদ্দা বলব নাকি মুখে কুলুপ এঁটে থেকে যাব আরও ক’দিন…। সেই সময় থেকেই চণ্ডালের রাগ আমার। কারও কথা পছন্দসই না হলেই ব্যস। দমাদম মাথা ঠুকতাম দেওয়ালে, মেঝেতে, খাটের কেঠো হেডরেস্টে। বড়রা বলত, "কোন খেঁচো হেডমাস্টার মরে এসেছে রে বাবা!" সেসব দিনে হেডমাস্টারমশাইরা রাগী হতেন। এসব দাদুর মুখে শোনা। একটু বড় হয়ে শুনেছি। আরও অনেক গল্প। আগুনের অক্ষরে লেখা। বম্বার্ডমেন্টের অগ্নি-আলেখ্য। একরত্তি একটা পুঁচকের দৌরাত্ম্যে থরহরি কাঁপছে বাড়ি। একবার গরিফায় ছোটমাসির বিয়েতে গিয়ে দিলাম দাদার পেটে দুটো দাঁত বসিয়ে। সে একেবারে রক্তারক্তি কান্ড। দাদা  আমার চকলেটটা চেয়েছিল শুধু। আমার তখন বছর দুই বয়স। নতুন ওঠা দুধের দাঁতের সুড়সুড়ানি আর মাথার নিখাদ চকলেট বোম। এই দুইয়ে মিলেই বোধহয়…। দাদা ছোট থেকেই ঠাণ্ডা, শান্ত, ভালমানুষ। নরম কাঠ। ঠিক আমার বিপরীত মেরু। ছুতোরের রোল নিয়ে নিলাম আমি। আঁচড়ে, কামড়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুললাম। ইতিমধ্যে বছর খানেক কেটে গেছে। বোমায় ড্যাম্প লাগেনি মোটে। সন্ধেবেলা ঠাকুমার কাছে নিয়ম করে রামায়ণ, মহাভারত শুনি। সেদিনও জুত করে গিয়ে বসলাম ঠাকুমার খাটের পাশটাতে। গল্পের ঝাঁপি খুললেই রঙিন মায়াবী পৃথিবী। রাজা-রানি, দৈত্য-দানো, ঢাল-তলোয়ার। ঠাকুমার হঠাৎ মাথাব্যথা শুরু হল। অসহ্য যন্ত্রণা। মাইগ্রেন ছিল তো। মাঝেসাঝেই হত অমন। গল্প বলার সময় আগে কখনও হয়নি। নিভু নিভু আঁচ উসকে দিল কে বা! ঠাকুমার মাথাটাকে মনে হল রাবণ। মাথা তাক করে দিলাম পেপার ওয়েট ছুঁড়ে। রামচন্দ্রের মত। নেহাত বছর তিনেক বয়স। হাতের টিপটা জমেনি তেমন। কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল সে মৃত্যুবাণ। সোজা দেওয়ালের বড় আয়নায়। ঝন..ঝন..ঝনাৎ। ঠিকঠাক কানেক্ট হলে বাঁ চোখ বেচারার ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া অবধারিত ছিল। জীবন নিয়েও টানাটানি হতে পারত। এমন হাড় হিম ঘটনারা ভেসে বেড়াতে থাকল বাড়িময়।  
 
ত্রস্ত হয়ে থাকত বাড়ি। বাবার ধমক, মায়ের উত্তমমধ্যম এসব নিয়মের মতো হয়ে গেল। নিষ্ফলা হয়ে যেতে থাকল সব চেষ্টা। নতুন নতুন শাস্তির উদ্ভাবন হতে থাকল। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনেরা অভিনব সব বিধান দিতে থকলেন। সে নানা রকম। হাত-পা বেঁধে রাখো; চোখের সামনে আয়না ধরো; মাথায় জল ঢালো; পৈতেটা কপালে ধরে ১০৮ বার গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে দাও… আরও নানা রকম! এসব কি সোজা কথা? তবু কসুর করা হল না এতটুকু। উলুবনে ছড়িয়ে দেওয়া মুক্তোরা বিফলে গেল দলে দলে। 
 
দুইঃ
সকলেই আমার প্রতিপক্ষ। মা, বাবা, দাদা, ঠাকুমা, বন্ধুরা… সক্কলে। অমন আগুনে রাগের ছ্যাঁকা খেয়ে কেউ আমার দলে থাকবেই বা কেন? শুধু মাত্র একটা লোক। আমার দাদু। কোনদিন ভুল দেখতে পেল না আমার। বলত, "রাগ পেলে রাগ করবি রে পাপান। খুব রাগ করবি। রাগটাকে গিলে ফেলবি না কিন্তু। তাতে বরং শরীর খারাপ হবে। রাগ হল বদ রক্তের মতো। শরীর থেকে বার করে দিতে হয়। আবার হাসি পেলে হাসবি। হা হা করে। প্রাণ খুলে। যা মন চাইবে তাই করবি। মনের মধ্যে বাধো বাধো রাখবি না। ইচ্ছেগুলো হল প্রজাপতি, উড়তে দিবি। যখের ধনের মতো লুকিয়ে রাখবি না। আর রাগ তো দূরের লোকের উপর করছিস না। একদম কাছের যারা তাদের উপর তো রাগ করতেই হবে। ভাল না লাগলে রেগে তো যাবিই। নিজের লোকেদের সামনে তো আর অভিনয় করা চলে না। কিন্তু রেগে গেলে আবার বোধ-বুদ্ধির সুইচগুলো বন্ধ হয়ে যায়, জানিস তো? শুধু একটু খেয়াল রাখবি, কেমন? আর দাঁত তো বাঘ সিংহ ব্যবহার করবে। মানুষের কাছে যে অনেক বেশি ধারালো অস্ত্র আছে রে! জিভ! বোধ চোখ বুজলে তার একচ্ছত্র শাসন। কত আদর করে গড়া স্বপ্নের রাজপ্রাসাদ, ছোঁয়াতে ধূলিসাৎ। দুহাতে আগলে রাখা ভালোবাসা জিভের স্পর্শে হাঁসফাঁস করে ওঠে।"  
 
প্রতিবার রাগ থামলে এমন সব কথা বলত দাদু। আদ্ভুত সব কথা। নানা রকম। নখ-দাঁত বার করত না। হাত চালাত না। বকত না। বন্ধুদের থেকেও বেশি বন্ধু হয়ে যেত। সামনে বসে কথা বলতে বলতে কেমন আমার ঢাল হয়ে উঠত। মনে হত দাদুর হাতটা আমার কাঁধে এসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। দাদু যে ভেতর থেকে রোগটার শিকড় ধরে টান দিয়েছে তা বুঝতে পারিনি। আমার রাগের দমকটা কমে আসতে থাকল। জিভটাকে সামলে রাগ করা কঠিন। ভোঁতা জিভের মালিকের রাগও ভোঁতা হয়। আবার গম্ভীর হয়ে থম মেরে বসে থাকাও যাবে না। দাদুর নিষেধ। এইসব চক্করে আমার রাগ করার কনফিডেন্সটা গেল টাল খেয়ে। আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে গেলাম আমি। তখন আবার মন খারাপ করত দাদু। 
- বদলে যাচ্ছিস তো রে পাপান!      
- কই দাদু? বদলাইনি তো। 
- রাগ-টাগগুলো বন্ধ করলি যে। 
- তুমিই তো বললে…
- আমি তো উল্টে রাগ চালিয়ে যেতে বললাম।
- তুমি কিন্তু খুব বুদ্ধিমান দাদু। রাগ করতেও বললে আবার কড়া ‘সাবজেক্ট টু’ও লাগিয়ে দিলে। রাগ বেচারা একেবারে ঘেঁটে ঘ।  
- ছি ছি। এটা তো তাহলে খুব খারাপ হয়েছে রে। রাগ করবি পাপান। নাহলে আমি আমার পাপানকে চিনতে পারব না যে। প্রত্যেকটা মানুষের নিজস্ব স্টাইল থাকে। কেউ ছিঁচকাঁদুনে, কেউ মজারু আবার কেউ তালভোলা, উদাসীন। সেটাই তো আইডেনটিটি। সেখানে বদল এনে ফেললে মুশকিল। দাদু দুদিনের জন্য পিসির বাড়ি যাবার নাম করলে বাবানের চোখে যদি জল না আসে তবে সে কি আর বাবান রইল?   
- একদম ঠিক দাদু। চোখে এমন ঘন ঘন জল না এলে দাদা আর দাদা থাকবে না। 
- তবে একটা গল্প বলি শোন। আমার তখন ক্লাস নাইন। সামাদ্দার স্যার ভূগোল পড়ান। ভয়ানক রাগী। নিদারুণ বকেন। ক্লাস শুদ্ধ সবাই ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি। স্যার কিন্তু মারেন না কাউকে। শুধু ঐ বকাটুকু। একদিন ক্লাসে আমি দ্রাঘিমার মিনিট আর সময়ের মিনিট গুলিয়ে ফেললাম। অন্যারাও ফেলল। স্যার আমার দিকে ডাস্টার ছুঁড়ে মারলেন। সে একেবারে কাঠের খটখটে  ডাস্টার। ডান হাতের কব্জিতে এসে লাগল। ব্যথা হল খুব। একটু ফুলেও গেল। তারপর থেকে দেখি স্যার আর ক্লাসে বকাবকি করেন না। কাউকে না। রাগেন না। স্যারকে আর চিনতে পারি না। দুদিন পর সন্ধ্যাবেলা স্যারের বাড়ি গেলাম। বললাম, ‘স্যার আমার সেদিন লাগেনি কিন্তু। শুধু আপনি বদলে যাওয়ায় খুব মন খারাপ হয়েছে’। স্যার কেঁদে ফেললেন। জানিস! নারকোলের খোলার মতো শক্ত বহিরাবরণটা ভেঙে গেলো। আবার আগের মতো হয়ে গেলেন স্যার। যেখানে দাবি আছে সেখানেই রাগও আছে। সম্পর্কের আশেপাশে আছে। হয়তো লুকিয়ে আছে। কিন্তু আছে। আছেই। 
 
তিনঃ      
প্রতিবার জানুয়ারিটা ক্ষুধার্ত কুমিরের মতো হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসতে থাকত। নিঃসাড়ে। নিয়মনিষ্ঠ। কোনও ব্যত্যয় নেই। একটা শিরশিরানি। ঠাণ্ডা। ভয়। সে সব দিনে শীত-গরম দুইয়েরই দাপট ছিল। খুব। এখনকার মতো হাল্কা ব্লাঙ্কেট, রাজাই বাজারে আসেনি। পাঁচ, সাত কেজি তুলোর ভারী লেপ। চেপে বসত বুকের উপর। সকালে ঘাড়ে করে বাইশটা সিঁড়ি ডিঙিয়ে ছাদে রোদে দেওয়া। শেষ দুপুরে রোদ কমে এলে আবার তুলে আনা। রাতে যতক্ষন লেপের ওমটুকু থাকত ততক্ষন আরাম। তারপর সে কী ঠাণ্ডা! অঙ্ক স্যারের চোখের মতো। শান দেওয়া নখ, হিলহলে জিভ। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ত লেপের পলকা ডিফেন্স। গরমে অবস্থা আরও কাহিল। ভয়াবহ। এসির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি মানুষের। হাসপাতাল, সিনেমাহল এসব জায়গাতেও এসির বালাই নেই। দুপুর খাঁ খাঁ রোদ্দুর। শহরের পথে পাঁপর-সেঁকা গরম। শপিং মলের ওয়েসিসের প্রশ্ন নেই। মলের অন্য দুটো মানে ছিল তখন। তারও একটা আবার বেমালুম উবে গেছে। রাস্তার পাশে মিনারেল ওয়াটারের বোতল? প্রশ্নই নেই! শুধু হিমায়িত গোল্ডস্পট, লিমকা...।       
 
শীত আসত। প্রতিবার। সঙ্গে করে আশঙ্কার ধূসর মেঘেদের নিয়ে। অলঙ্ঘ্য নিয়মের মত। অমোঘ। আমাদের বাড়িতে দুজনের ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা। দাদা আর দাদু। ঐ হেঁপো আর কী। শীত এন্ট্রি নেবার নাম করলেই হাঁপের টান চাগাড় দেয়। হাঁপরের মতো ওঠা নামা করতে থাকে বুক। ফুসফুস অব্দি পৌঁছনোর পথ হাতড়ে ফেরে হাওয়া। তখনও স্যালবুটামল আবিষ্কার হয়নি। ইনহেলার যন্ত্রটাও নয়। দ্বিতীয় আশঙ্কাটা আরও মারাত্মক। শিরদাঁড়া ঠাণ্ডা করা একটা স্রোত। ভয়। মৃত্যুভয়! প্রিয়জনের। হয়তো বা নিজেরও। এই অলক্ষুণে জানুয়ারিটা ভগ্নদূতের মতো আসে। আমাদের পরিবারের তিন জনের শরীরের সব উত্তাপ শুষে নিয়েছে জানুয়ারির শৈত্য। আলো মুছে দিয়েছে তার কুয়াশার অন্ধকার। আমার মেজদাদু, মানে দাদুর ঠিক পরের ভাই; মেজ ঠাকুমা আর ছোটদাদু। সবাই ঐ পৌষ সংক্রান্তির ঠিক আগে আগে। আমাদের পৌষ সংক্রান্তিতে পাটিসাপটা, পুলিপিঠে ছিল না। মিষ্টতা ছিল না। গরম নোনতা জল আর ঠাণ্ডা স্রোত। ব্যাস। ফুলকপির সিঙাড়া নেই। পিকনিকের আধসেদ্ধ কচি পাঁঠা নেই। জয়নগর নেই। স্বাদ কোরকেরা সব নুনে মাখামাখি হয়ে থাকত। 
 
চারঃ  
নবমীর রাত। বাতাসে ছাতিম ফুলের গন্ধ। বন্ধুদের সাথে পুজো দেখে বাড়ি ফেরার সময় গরম হাওয়ার ঝাঁঝটা বেশ কম লাগল। সবার চোখ চিকমিক করে উঠল। চিটচিটে গরম থেকে মুক্তির আনন্দ। শীতের আগাম আগমন বার্তা। মন কেমন নবমী নিশি। বিষাদের ধাক্কা। শীতের আভাসে হয়তো সে বিষাদ কমে এল খানিক। আমার মন কু গাইল। এত আগে আগে আসতে আছে? ভয় দেখাতে হয় এভাবে? বাড়ি ফিরে হয়তো দেখব দাদু আধশোয়া হয়ে বসেই আছে প্রায়। পিঠের নীচে চারটে মোটা বালিশ। টানটা প্রথম শীতে বাড়ে। আবার তিন চারটে মাসের অসহনীয় কষ্ট। অনিষ্টের আশঙ্কায় সিঁটিয়ে থাকা। মনটা একদম তেতো হয়ে গেল। মা দুর্গা শ্বশুরবাড়ির পথে যাত্রা শুরু করার আগেই পুজো শেষ হয়ে গেল আমার।   
মা আর ঠাকুমা না খেয়ে বসে ছিল। যথারীতি। কত বলেছি সময়মতো খেয়ে নিতে। কারও দেরি হলে শবরীর মতো হাপিত্যেশ করে বসে থাকার দরকার নেই। বয়স হচ্ছে সবার। কথা শোনে না কেউ। রাগ হল খুব। দপ করে জ্বলে উঠতে ইচ্ছে হল। কিন্তু ঐ জিভ। আগল দিয়ে নিলাম। রেগে যাওয়াটা আর হল না। রেগে গেলেই হয়তো ঠিক হত। পরের বার আর এমনটা করবার সাহস পেত না। পাপানও পাপান থাকত। রাগ করতে না পারায় রাগ হল আমার। পর্দা সরিয়ে দাদুর ঘরে ঢুকলাম। অবাক কান্ড! নিঃশব্দে ঘুমোচ্ছে দাদু। সাড়া শব্দ নেই। এমনটা হওয়ার তো কথা ছিল না। আমি ভয় পেলাম। দাদুর নাকের কাছে হাত নিলাম। নিঃশ্বাস পড়ছে। একদম স্বাভাবিক। দৌড়ে বাইরে এলাম।  
- কী ব্যাপার মা? দাদুর আজ টান ওঠেনি?
- সন্ধেবেলা উঠেছিল তো রে। বেশ বাড়াবাড়ি রকম। তোর বাবা ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। উনি একটা ওষুধ দিয়েছেন। নতুন আবিষ্কার হয়েছে নাকি। খাবার নয় কিন্তু। একটা যন্ত্রের মধ্যে থাকে ওষুধটা। গাঁজার কলকের মতো চেহারা। ইনহেলার না কী একটা নাম। ডাক্তার বাবু বলেছেন - ‘দুটো করে দম, দিনে দুবার। ব্যাস। বাবা অনেক ভাল থাকবেন।’ 
মনের তেতো ভাবটা কেটে গেল। ভাবলাম শীতের সঙ্গে আড়িবাদটা মিটিয়ে নেব এবার। সবার জন্য ঢাকেশ্বরীর ফুলকপির সিঙাড়া কিনে আনব কাল। বাজারে এখন দিব্যি ফুলকপি উঠে গেছে।   
 
পাঁচঃ  
বেশ কাটল শীত এবার। অবশ্য পুরোটা কাটতে আরও কিছু পথ চলা বাকি। ডিসেম্বরের শেষ বাঁশি বাজব বাজব করছে। দাদু, দাদা দুজনেই অনেক ঝরঝরে আছে এবার। ইনহেলার বেশ কাজ দিয়েছে। কমলা লেবুর খোসা চিপে রস দিতে নিয়েছি দাদার চোখে। কয়েকবার। এ সব নাগপুর লেবু। পেল্লাই চেহারা। মোটা খোসা। রসে টইটম্বুর। দাদা দুদ্দাড় পালিয়েছে সিঁড়ি টপকে। হাঁপিয়ে যাবার ভয় পায়নি। আমার চোখে উল্টে রস ফেরত দেবার বুদ্ধি ওর মাথাতে আসবে না। ইট-পাটকেলের ঐ গল্পটাতে ওর বিশ্বাস নেই।  তবে এই চোখ জ্বালা করার ভয়ে দৌড়টা এবার নতুন। টানের ভয় কমে গেছে।  
 
শীতের জড়সড় ভাবটা কেটে গেল। বিরক্তিটা উধাও হয়ে গেল একেবারে। পুনরুদ্যমে নতুন জীবন শুরু করল দাদু। থিতু হবার জন্য শুরুতে যে পা রাখার জায়গাটা লাগে, নতুন ওষুধটা দাদুকে সেই জায়গাটা দিয়েছিল। সকালে হাঁটা শুরু করল। সাথে উলিকট, ট্র্যাকপ্যান্ট, স্নিকার, মাঙ্কিক্যাপ আর আমি। কখনও দাদাও। বেরোবার আগে ইনহেলারে দুটো দম দিয়ে নিত। তারপর হনহন করে আধ ঘন্টা। আমি জগ করতে নিলে দাদুও শুরু করত। থামাতে নিলে বলত, “এ বুড়োর ফুটবল খেলা কাফ মাসল রে। দেখবি নাকি একবার?” বলেই প্যান্টের নিচের দিকটা গুটিয়ে  নিত। বদলে যেতে থাকল বাড়ি। একটা খুশির হাওয়া ভেসে বেড়াতে থাকল বাড়িময়। 
 
দরজায় কড়া নাড়া নতুন বছরটাকে দু-হাতে আলিঙ্গন করে স্বাগত জানাবার প্ল্যান হল। প্রথমবারের জন্য। দাদার সঙ্গে আমিও লেগে পড়লাম। গোটা মুরগি কেনা হল। বেশ কয়েকটা। বাগানে লাইভ বার-বি-কিউ। কাছের লোকজনেদের ডাকা হল। টগবগ করে ফুটছিলাম আমরা। প্রথম নিউ ইয়ার্স ইভ। 
 
বছরের শেষ দিন। তিন জনে একসঙ্গে মর্নিং ওয়াকে বেরোলাম। দাদার দেখাদেখি দাদু জগিং শুরু করল। হঠাৎ পা টলে উঠল দাদুর। কাটা কলা গাছের মতো পড়ে যাচ্ছিল। দু’হাতে ধরে ফেলল দাদা। কলকল করে ঘাম হচ্ছিল। ডিসেম্বরের ঠাণ্ডাতেও সারা শরীর ভিজে চুপচুপ। কথা জড়িয়ে যেতে থাকল। বুকের মাঝখানে ভীষণ ব্যথা। দাদা বুকে পাম্প করতে থাকল। বরাত জোরে একটা গাড়ি পাওয়া গেল। গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে পৌঁছলাম হাসপাতাল। স্ট্রোকটা জোরদার হয়েছিল। বাইপাসের দিন ওটির বাইরে আমরা অনেক লোক। দুরুদুরু বুক। চোখে উৎকণ্ঠা। নেভার আগে দপ করে জ্বলে ওঠা প্রদীপের কথা মাথায় আসছিল বারবার। শীতকালের নিয়ম মতো নোনতা জল গিলে নিতে থাকলাম।
 
তিন সপ্তাহ হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরল দাদু। পা একটু কমজোরি। পা থেকে রগ কেটে নেওয়া হয়েছিল অপারেশানের সময়। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, "শীতকাল, হাওয়া শুকনো, তাই কাটা ছেঁড়া শুকিয়ে গেছে চটপট। কষ্টটাও একটু কম হয়েছে। এবার কিন্তু সব রকম তেল খাওয়া বন্ধ। ভাজাভুজি বন্ধ।" মনটা টুনটুনি পাখির মতো ফুরফুর করে উঠল। শীতের সাথে সন্ধি করে নিলাম মনে মনে। সব রাগেদের ছুটি দিয়ে দিলাম। ব্রট ফরোয়ার্ড মনখারাপদের গায়ে আলতো বুলিয়ে দিলাম ইরেজার।  
 
যাই যাই করছে ফেব্রুয়ারি। শীতও। সন্ধেবেলা অঙ্কের টিউশান পড়ে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ দেখি দাদু। ঢাকেশ্বরীর সামনে। জোরে জোরে কথা বলছে। স্পষ্ট কানে এল..
- দুটো ফুলকপির সিঙ্গাড়া দেবেন তো। 
- আর কিছু?
- হ্যাঁ, আর দুটো গরম পান্তুয়া।
- খাবেন না নিয়ে যাবেন?
- খাব, খাব। চটপট দিন।
দিগভ্রষ্ট রাগটা আবার পথ খুঁজে পেল। অগ্নিসংযোগ হল সলতেয়। মারণ ক্ষেপণাস্ত্রর মতো ছিটকে বার হল  রাগের ফুলকিরা। 
- লজ্জা করে না তোমার? তোমার না সব ভাজাভুজি বন্ধ! যেই শীতটা একটু কমেছে অমনি সাপের পাঁচ পা দেখেছ?
পুরনো অবাধ্য জিভটা আবার ফিরে এল। অনেক দিন পর। আর সামলাতে পারলাম না। পিছন থেকে বেরিয়ে এল দাদা। সঙ্গে ঠাকুমা। হাসি হাসি মুখ। দাদু বলল...
- এই তো চাই পাপান। আমাদের চেনা, পুরনো পাপান। ব্যাক উইথ আ ব্যাং। দীর্ঘ অফ ফর্মের অবসান। কেমন বুদ্ধি করে তিনজন মিলে ফাঁদ পেতেছিলাম, বল? 
ফাঁদে আটকা পড়েছি। পুরো বোকা বনে গেছি। তবু হাসি পেল। হাসলাম। গলা ছেড়ে। অট্টহাস্য। যোগ দিল বাকিরা।

বৈশাখী ২০২৪