সান্টার উপহার

সন্তোষপুর, কলকাতা ৬৬


ট্রেনের জানলা দিয়ে একদৃষ্টে বাইরের চলমান পৃথিবীকে দেখছে বছর ছয়ের মিতুল। ডিসেম্বরের হিমেল হাওয়ায় যাতে ঠাণ্ডা না লাগে, একটা স্কার্ফ দিয়ে ওর কান মাথা ঢেকে দিল স্বাতী। আর দুদিন পরে বড়দিন। এই প্রথম ক্রিস্টমাসের দিন ওরা ঘর ছাড়া। বাধ্য হয়েই যেতে হচ্ছে টাটা ইন্সটিটউট অব ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারে। মিতুলের শ্বেত রক্তকণিকার উৎপাদন স্বাভাবিক নয়। ক্লিনিক্যাল টেস্টে স্টেজ ওয়ান লিউকোমিয়ার উপস্থিতি। নিয়মিত ব্লাড ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট করতে হবে। প্রথম যেদিন জানতে পারল, সুজন আর স্বাতীর মনে শীত যেন স্থায়ী আসন পেতে বসেছিল।

“বাপি! এবার তো আমরা থাকছি না। সান্টা তাহলে গিফট কী করে দেবে? ঘর তো তালা বন্ধ!” মিতুলের কথায় দুজনের সম্বিত ফেরে। জোয়ারের ঢেউয়ের মতো একরাশ বিষাদ বুকের ঘরে আছড়ে পড়ে। আসলে প্রতিবার ২৪ তারিখ মিতুল ঘুমিয়ে পড়লে, বারান্দায় একটা বড় মোজার মধ্যে কখনও ওর প্রিয় চকোলেট, না হলে খেলনা, তা না হলে টিনটিনের বই বালিশের পাশে রেখে দিত সুজন। ক্রিসমাসের সকালে ঘুম থেকে উঠে সেসব আবিষ্কার করে মিতুলের সে কী আনন্দ! আর ছেলের খুশিতে সুজন, স্বাতী শীতার্ত ভোরের প্রথম রোদ্দুর গায়ে মাখত।

“সান্টা জানে তুমি সুস্থ হতে মুম্বাই যাচ্ছ। আমরা ফিরে এলে সান্টা ঠিক তোমার গিফট দিয়ে যাবে। দেখে নিও।” ছোট্ট মিতুল আশ্বস্ত হয়ে আবার বাইরে চোখ রাখে। ছেলেকে বলতে পারল না যে ডাঃ প্রিয়ব্রত রায়ের রূপ ধরে সান্টা এবার বড়দিনের আগেই ওকে গিফট দিয়ে গেছে। ডাক্তারবাবু সাক্ষাৎ ভগবান। নিজে উদ্যোগী হয়ে টাটা ইন্সটিটউট অব ক্যান্সার রিসার্চের সবচেয়ে বড় ডাক্তার ডাঃ মুরুগাথনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট সুনিশ্চিত তো করেছেনই, ব্লাড ট্র্যান্সপ্ল্যান্টের খরচ যতটা কম করা সম্ভব সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সাথে দিয়েছেন সুপারিশ করা চিঠি। “একদম চিন্তা করবেন না। নিয়মিত ব্লাড ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট করে যাবেন। আমি জোর দিয়ে বলছি একটা সময় ও সম্পূর্ণ সুস্থ, স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তখন আর কিচ্ছু করতে হবে না”। মিতুলকে কাছে টেনে আদর করে বলেছেন, “তাহলে মিতুল বাবু! আমরা দুজনেই টিনটিনের ফ্যান।” মিতুল মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল। তারপরে শিশুসুলভ সারল্যে বলেছিল, “ডাক্তারজ্যেঠু আমি পরের বার টিনটিনের বইগুলো তোমাকে দিয়ে যাব। পড়বে কিন্তু...,” অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন ডাঃ রায়। আশ্বস্ত সুজন, স্বাতীর মনে হল হো হো করে হেসে ওঠা ডাক্তারবাবুর মুখ আর সান্টার মুখের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

বৈশাখী ২০২৪