অহল্যা

ক্যালগারি, কানাডা


মেয়েটাকে দেখতে ভারী সুন্দর। ঝকঝকে চোখ, ঘন কালো ভ্রূ, চাঁদের মতো কপাল। চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে টানটান করে খোঁপা বাঁধা। নাকটা অবশ্য বোঁচা, ঠোঁটদুটোও গোলাপের পাপড়ির ধারে কাছে যায় না। তবে চাপা হাসিটা চোখ টানে খুব। যেন কী একটা মজার ব্যাপার কেবল সে দেখতে পাচ্ছে। দৃঢ় চিবুকে একটা কাটা দাগ, আহা চাঁদের কলঙ্ক যেন। 

মেয়েটাকে বড় চেনা লাগে। কিন্তু কোথায় যে দেখেছেন ঠিক খেয়ালে আসে না। আরও কীসব যেন মনে পড়তে চায়, যেন অনেকদিন আগে পড়া কবিতার ভুলে যাওয়া প্রথম লাইন। ওটা মনে পড়লেই বাকি কবিতাটাও ঝপাঝপ মনে পড়ে যাবে। একবার জিজ্ঞেসও করেছিলেন মেয়েটাকে, সে তো হেসেই সারা। যেটুকু বুঝেছেন মেয়েটা নিরীহ প্রকৃতির একেবারেই নয়। এই যেদিন ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছিল, জানলার পর্দা সরিয়ে সে কী নাচ তার। খোঁপা খুলে কাঁধের উপর লুটিয়ে পড়েছে, আর সে মেয়ে শাড়ির আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নেচেই চলেছে। তিনি যে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন, খেয়ালই নেই। আবার একটা ছোট্ট নীল ডায়েরিতে লুকিয়ে লুকিয়ে লেখে। প্রেমপত্র না কবিতা না ঘোড়ার মাথা ব্যাঙের ছাতা কে জানে। ওকে বোধহয় ভালোবেসে ফেলছেন তিনি।

“ডক্টর আপনি নিশ্চিত উনি ব্রেন ডেড নন?” বছর ছাব্বিশের যুবকটির চোখে উদ্বেগের ঢেউ।
“দেখুন, সত্যি বলতে কী, কোমায় থাকা পেশেন্টের ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা মুশকিল। হয়তো উনি শুনতে পাচ্ছেন সব কিছু, বুঝতেও পারছেন, চিন্তাভাবনা করছেন, কিন্তু সেটা প্রকাশ করার ক্ষমতাটা হারিয়ে গেছে। আপনারা কথা বলতে থাকুন ওঁর সঙ্গে, যা ভালোবাসেন উনি সেগুলো মনে করান। মিরাকল্ হলেও হতে পারে!”
যুবকটির পাশে দাঁড়িয়ে এক বিষণ্ণ প্রৌঢ় আর এক যুবতী। অসহায়ভাবে তাদের দিকে তাকায় সে।
“কী ভালোবাসতো রে?” যুবতী মাথা নীচু করে। প্রৌঢ় সামনের চেয়ারটায় বসে পড়েন। এক সময় জানতেন বোধহয়, আজ আর মনে নেই কিছু। 

“মায়ের ঠাকুরের আসনে এক জোড়া ঘুঙুর ছিল না?” হঠাৎ বলে ওঠে যুবতী মেয়েটি।
“কবে? সে কি আর আছে এখনও?” চোখ বন্ধ করে যুবক। কাঁচাপাকা চুলে টেনে খোঁপা বাঁধা, দৃঢ় চিবুকের একটা চেহারা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মা নাকি খুব গেছো ছিল, চিবুকের কাটা দাগটা তার প্রমাণ। বিশ্বাসই হয় না। তাদের বিশাল যৌথ পরিবারের রান্নাঘরে দিবারাত্র কাজ করতে থাকা মা তার চেনা। 

“মা এখন সব হারিয়ে নিথর হয়ে...” কথা শেষ না করে ফুঁপিয়ে ওঠে যুবতী।

ও জানে না, সব হারিয়ে নিজেকে এতদিনে আবার খুঁজে পেয়েছেন তিনি। আর ফেরার মানে হয় না।

বৈশাখী ২০২৪