কর্দম

শ্রীপল্লি, পূর্ব বর্ধমান

আঁধার নামানো মেঘের মাঝে টানা করিডরটার একপ্রান্তে অনেকক্ষণ মন ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রণিতা। কুচোকুচো জলের ছিটে লাগছে মুখে। নাঃ, ঠিক সূচ বেঁধার অনুভূতি নয়। একটু ধারালো তবে নরম। অনেকটা থিতিয়ে পড়া দুঃখবোধের মত চিনচিনে একটা অনুভূতি। নাড়ায় না, থিতু করে। যেন ঝিমধরা আবেশ। 

তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ঘোর ভাঙাল রণিতার।
“ভিজছিস কেন রে?” 
ও প্রান্ত থেকে হেঁটে আসছে পিয়ালিদি। এগারোটা হতে চলল। হিসেবমত লেট। দশটা চল্লিশের পর মানেই লেট। তবে আজ হেডমাষ্টারমশাই লেটমার্ক করবেন বলে মনে হয় না। যা ঝমঝমে বৃষ্টি! লেট, বৃষ্টি তবু নিখুঁত পরিপাটি পিয়ালিদি। মেঘ-বৃষ্টির সঙ্গে রং মিলিয়ে নীলধোয়া ধূসর সালোয়ার কামিজে শোভিতা। বাঁ কাঁধে ঝোলান গাঢ় নীল শিফন ওড়না।  

“বাইরে একা একা দাঁড়িয়ে কেন? মনখারাপ?” 
সহানুভূতির বাষ্প দিয়ে এমনই সবসময় সব কলিগরা ঘিরে রাখে রণিতাকে সেই দীপ্তর মৃত্যুর পর থেকেই। অ্যাক্সিডেন্টে দীপ্তর মৃত্যুটা যথেষ্টই শকিং ছিল সবার কাছে। তবু হয়েও তো গেল বছর পাঁচেক। এবার বোধহয় একটু অন্যরকম ভাববারও সময় এসেছে। 
“না গো, ঠিক মনখারাপ নয়। একটু স্মৃতিচারণ করছি মনেমনে!” জবাব দেয় রণিতা। 
“দীপ্তর?” 
“উঁহু আজ একজনের মৃত্যুদিন, তার। সেদিনও আকাশ এমন করেই কেঁদেছিল, মনে নেই?” 
“ঋতুপর্ণ কী?” 

আলতো হাসে রণিতা। পিয়ালিদি বলে চলে, “কত বড়ো পরিচালক বল! অথচ সবাই একটা দিকেই কনসেনট্রেট করে গেল! ওঁর কথাবার্তা, সাজপোশাক নিয়ে কত হাসাহাসি। ক’জন আর সিনেমাগুলো মন দিয়ে দেখেছে?” 

“হুম…” বলে স্টাফরুমের দিকে এগোয় রণিতা। 

কথা বাড়াতে চায় না এই নিয়ে। কথা বাড়ানো মানে তো আলোচনা হবে সেই একটা বিষয় নিয়েই। শ্রদ্ধা করি বা হাসাহাসি- এক পরিচয়ের উর্দ্ধে ভাবতে পারি কী? 
রণিতার পিছুপিছু কিন্তু বকবক করতে করতেই আসতে থাকে পিয়ালিদি, “মানুষ বদলাবে না রে! যতই পড়াশোনা করুক মনগুলো সব কাদাতেই পড়ে থাকবে!”

এবার একটু বিরক্ত লাগে রণিতার। পিয়ালিদিকে কিছু না বললেই হত। খাদের সুর কেটে এখন ক্রমশ উচ্চনাদের দিকে এগিয়ে চলেছে পিয়ালিদি। থামাতে হবে। 
“পিয়ালিদি, বলেছিলে তোমার ছেলের ফুটবল কোচিং-এর নাম্বারটা আজ আনবে!” 

“ওঃ!” থমকায় পিয়ালিদি, “এনেছি রে!”
“এনেছ!” ঠোঁট টেনে হাসে রণিতা। 

একটু সরে আসে পিয়ালিদি, চাপাস্বরে বলে, “তুই বলছিলি না, তোর ছেলে তোর শাড়ি পরে, লিপস্টিক পরে আয়নায় ঘুরে ঘুরে দেখে। এসব একদম ভালো লক্ষণ নয়। আমি পড়েছি। ফুটবলে দিয়ে দে। মনটা ঘুরবে!” 

চট করে ঘুরে দরজার দিকে হাঁটা লাগায় পিয়ালিদি, দ্রুতপায়ে। সই করতে দেরি হয়ে গেছে আজ। হেডমাষ্টারমশাই একটু ধমকাবেন নিশ্চয়ই। 
নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে রণিতা। 

বৈশাখী ২০২৪