খাঁদু

কলকাতা ৫৪

দুপুর দুপুর শঙ্কর মন্ডল ‘শরবতের গাড়ি’ নিয়ে পৌঁছে গেল ইস্কুল মাঠে। বিকেলে ‘রোবিন্দ জয়েনতির ফানশান' হবে। মালতী বলেছিল, “ভ্যাপসা গরম, জল টানবে খুব…. বেশি করেই মাল নে যেও।” 
সেইমতো বেশি করে বরফ, পাতিলেবু, সিরাপ, জল নিয়েছে। মালতীর কথা এখন আর ফেলতে পারে না শঙ্কর। অথচ কালো আর নাক খাঁদা বলে মালতীকে বিয়েই করতে চায়নি সে।
“আমার জন্যি শেষকালে ওই কেলটে খেঁদিটাকে ধরে আনলে গা ঘটকঠাকুর? তল্লাটে আর ভালো মেয়ে পেলেনে?”
“তুই কোথাকার রণবীর এলি, যে আলিয়ার মতো মেয়ে জুটবে। আছেটা কী তোর? ওই তো ছ’ইঞ্চি বুকের খোল, ফুঁ দিলে উড়ে যাবি। জমিজিরেত কিচ্ছুটি নেই। খোলার চালের ঘর একখানা, তাও বর্ষায় জল পড়ে। মেয়ে যে একটা কপালে জুটছে এইই তো ঢের। শোন, মালতী বোঝদার সংসারী মেয়ে, পাড়া বেড়ানি নয়। খাঁদা, কালো বলে পায়ে ঠেললে পরে পস্তাবি। কথায় বলে ইস্তিরি ভাগ্যে ধন।”
মালতীর গায়ের রঙ, খাঁদা নাক নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে শঙ্করও ‘খাঁদু’ বলে খোঁটা দিত প্রথমে। মালতী নির্বিবাদে হজম করত সে সব। দেখতে যেমনই হোক মালতী খাটিয়ে, বুদ্ধিমতী সর্বোপরি মিষ্টি স্বভাবের। ইস্কুল সেক্রেটারির গিন্নিকে পটিয়ে মিড-ডে মিল এর রান্নার কাজ আর বরের জন্য ইস্কুলে ঝাড়ুদারের চাকরিটা বাগিয়ে নিয়েছে। বিনিময়ে সেক্রেটারি গিন্নির ফাইফরমাশ খেটে দেয় হাসিমুখে। অবসরে বাড়ি বাড়ি মুড়ি ভেজে, ধান সেদ্ধ করেও দু’পয়সা আনে ঘরে। বলতে গেলে মালতীর একার পরিশ্রমে তৈরি কোঠাবাড়ির দাওয়ায় বসে শঙ্কর আজ বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে ভাবে ঘটক ঠিকই বলেছিল - “ইস্তিরি ভাগ্যে ধন!”  
শঙ্কর আসার আগেই চা নিয়ে বলাই, ঘুগনি নিয়ে কাশী, থার্মোকলের বাক্সে পেপসি নিয়ে হারু হাজির। শঙ্কর বেচছে বরফ দেওয়া নুন-লেবুর জল এক টাকা গ্লাস, আর রঙিন সিরাপ দেওয়া শরবত তিন টাকায়। শরবতের খদ্দেরই বেশি— বিকোচ্ছেও দেদার। ইস্কুলের দুজন মাস্টারমশাইও শরবত খেয়ে গেছেন। তেষ্টায় ঠাণ্ডা শরবতের বিকল্প কিছু হয় নাকি! আইসক্রিমের ঠেলাগাড়িতে বসে বসির মেহেন্দিরঙা দাড়িতে হাত বোলাচ্ছে আর শঙ্কর খদ্দের সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বরফ শেষ। বরফের সঙ্গে আনাতে হল সিরাপও। 
"বিক্রি-বাটা কত হল গো?"
"লাভ প্রায় আটশো--- এত বিক্রি হবে ভাবিনি মালতী। বেশি করে মাল নিয়েও কুলানো গেল না।”
“খাঁদুর কথা শুনে ‘লোসকান’ হয়নে বলো?” 
“তা হয়নে বটে, তবে সবই রোবি ঠাকুরের জন্যে।”
“সব নয়---- খানিকটা আমার জন্যেও।” মালতীর মুখে চাপা হাসি চোখে রহস্য।
"তোমার জন্যে... মানে?"  
"ইস্কুলের দুটো ‘টিউকল’ই বিগড়ে দিয়ে এসেছিলাম যে!" 

বৈশাখী ২০২৪