কলেজের পরে কয়েকটা টিউশন সেরে বাড়ি ফিরে দেখলাম, মা বাইরের ঘরে বসে, মুখ উদবিগ্ন। টিভিটাও বন্ধ রয়েছে। মা একটা প্যাথোলজিকাল ল্যাবে চাকরি করে। বললাম, “কখন ফিরলে মা?" “আজ হাফ ডে তো। চারটেতে ফিরেছি। তোর দাসকাকু এসেছিলেন।” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম “কেন?” “তোর বাবাকে হরিদ্বারে ওদের অফিসের একজন দেখেছে। কথা বলার সুযোগ পায়নি। একবার যা বাবুয়া, যদি কিছু খবর পাস।" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এর আগেও এমন খবর এসেছে, আর মা উতলা হয়েছে। মাকে বোঝাতে পারি না, পাঁচ বছর আগে যে লোকটা স্বেচ্ছায় চলে গেছে, তাকে খুঁজে পাওয়া অত সহজ নয়। যাবার আগে চাকরি ছেড়ে পাওনাগণ্ডা নিয়ে গেছে। একবারও ভাবেনি, আমার আর মায়ের কী হবে! কত কষ্ট করে মায়ের সামান্য কাজ, আর আমার টিউশনির ভরসায় সংসার চলছে। হরিদ্বারে না হয় একজন সাধু বাড়ল। আমরা তো ভালোই আছি। তাও মায়ের পীড়াপীড়িতে, হরিদ্বারের ট্রেনে উঠলাম। থাকলাম কালিকমলি ধর্মশালায়, খাই দাদা বৌদির হোটেলে। ভাত, মুগের ডাল, বেগুনভাজা। তিনদিন ধরে পুরো শহর পাক দিলাম, রোজ আরতি দেখলাম, পুজো দিলাম, বাবার চিহ্নও কোথাও দেখিনি। সাধুসন্তদের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে, বুঝতে চেয়েছি চেনা লাগছে কি না। অনেকের কাছে বাবার ছবি দেখিয়ে খোঁজও নিলাম। কেউ কিছু বলতে পারল না। মায়ের সঙ্গে রোজই ফোনে কথা হয়, আশা দিতে পারি না। মা চুপ করে যায়। ফেরার ট্রেনে ওঠার জন্য স্টেশনে এসে বসে ভাবছিলাম মাকে গিয়ে বলব, ‘যে লোকটা প্রতিদিন তোমাকে মারধর করত, কষ্ট দিত, তার আসার অপেক্ষায় বসে থাক কেন?’ আমার ট্রেনের দেরি আছে এখনও। অন্য একটা ট্রেন ঢুকছে স্টেশনে, দিল্লি- হরিদ্বার এক্সপ্রেস বোধহয়। লোক নামছে হুড়হুড় করে। আপনমনেই দেখছিলাম লোকজনের চলাচল। হঠাৎ চমকে উঠলাম। বুকের মধ্যে ধকধক করে উঠল। বাবা নেমেছে ট্রেন থেকে। সঙ্গে একজন ঘোমটা দেওয়া বৌ, আর বছর দুয়েকের একটা বাচ্চা। প্রচুর মালপত্র কুলির মাথায় চাপিয়ে, আমার সামনে দিয়েই গেল ওরা। হিন্দিতে বাবাকে বলতে শুনলাম, "তুমি খুকিকে নিয়ে এসো, আমি কুলির সঙ্গে যাচ্ছি।" বাবা তাহলে সাধু হয়নি, আবার বিয়ে করেছে! কী অদ্ভুতভাবে আমারই চোখে পড়ল। ফিরে এসে মাকে বললাম, "তোমাকে বলিনি। বাবার একটা খবর পেয়েছি। একজন ছবি দেখে চিনতে পেরেছে। বাবা হিমালয়ে সাধু হয়ে গেছে, আর ফিরবে না!" আমাকে অবাক করে মা বলল, "ভালো হয়েছে। এইজন্যই তোকে পাঠিয়েছিলাম খবর নিতে। উফফ শান্তি! বাকি জীবন, এই বুঝি ফিরে এল, ভেবে আর অশান্তিতে কাটাতে হবে না!"