"কেমন আছ মাসিমা এদেশে?" মাইক্রোফোন এগিয়ে আসে বৃদ্ধা রুবি দুলের মুখের ঠিক সামনে। রুবির কোলে থাকা এক বছরের নাতনি ছোট্ট হাতে নাক থেকে গড়িয়ে আসা সর্দি মুছে খপ করে মাইকটা চেপে ধরে। সাংবাদিক পিছিয়ে যায় এক পা। তারপর আবার বলে, "কী গো, এতকাল ছিটমহলের বাসিন্দা ছিলে। না ভারত না বাংলাদেশ, কোনওটাই তোমার দেশ ছিল না। না ঘরকা না ঘাটকা। এখন তো দেশ পেয়েছ।" রুবি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে। বাংলাদেশের দহালা খাগড়াবাড়ি থেকে হলদিবাড়ির অস্থায়ী ক্যাম্পে এসেছিল বছর তিন আগে। এখন সেখানেই নাকি ফ্ল্যাট হবে, ভোটার কার্ড দেবে। এটাই নাকি দেশ। তাহলে আগেরটা কী ছিল! যেখানে রুবির জনম। ওটা ছিটমহল ছিল, জমিটা বাংলাদেশের, দেশটা ভারতের। এখন সেটা বাংলাদেশ নিয়ে নিয়েছে। তাই রুবিরা ঠাঁইনাড়া হয়ে এখানে। এটাই দেশ কী করে হল? রুবি না বুঝে ফোকলা দাঁতে একগাল হেসে বলে, "বালো, খুব বালো তুমাগো দ্যাশ।" সাংবাদিক রুবির সাদা শাড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, "বিধবা ভাতা ঠিক মতন পাচ্ছ তো?" রুবি উত্তর দেবার আগেই ওর ছেলে হরেন বেরিয়ে আসে। তেড়েফুঁড়ে বলে, "হ্যাঁ পায়। আমরা ভালো আছি। খুউব খুশি।" পটাপট ছবি ওঠে। হরেন মনে মনে বড় করে হাসে। ভাবে এই ভিডিয়ো নিশ্চয়ই নেতা মন্ত্রীরা দেখবে। মুখটা চিনে নিলে কেল্লা ফতে। এখনও ভোটার কার্ড হয়নি। ও হয়ে যাবে ঠিকই, ভোটের আগে। "তাহলে মাসিমা, এদেশে মন বসেছে তো?" রুবি এবার এদিক ওদিক চেয়ে বলে, "এদেশ? হ। তুমাগো দ্যাশে মন বসন তো করাতেই অইব।" "'তুমাগো' নয়, মাসিমা, বলুন 'আমাগো।' এখন আপনারা ভারতের।" সাংবাদিক তড়িঘড়ি বলে। ২০১৫ সালে ছিটমহল নিয়ে বাংলাদেশ আর ভারতের বোঝাপড়া হয়ে গেছে। এখনও 'তোমাদের দেশ' বলতে দিলে ভুল বার্তা যাবে। টিভিতে সকলে দেখবে। সাংবাদিক সতর্ক হয়। "হ মাগো। ভুল হই যায়। আসলে হরুর বাপরে উইখ্যানের মাটিতে হারাইসি। আমাগো দ্যাশে। যাউক তুমাগো দ্যাশরে 'আমাগো'ই বলুম। তুমাগো জমিন, তুমাগো কথা তো শুনা লাগে।" রুবি চোখ পিটপিট করে বলে। "’তুমাগো জমিন' নয় মাসিমা, বলুন 'আমাগো দ্যাশ', আরে, এখন আপনারা ভারতের নাগরিক। সব সুবিধা সুযোগ পাবেন, ভারতে যা যা আছে।", সাংবাদিক বুঝিয়ে চলেন। হরেনও সমান তালে ঘাড় নাড়ে। রুবি সব বুঝেছে এমন ভঙ্গিতে বলে চলে, "হ হ। তুমাগো দ্যাশরে আমাগো কইসি তো!" এক সারি সাদা বক ঠিক সেই সময়ে হলদিবাড়ির আকাশ ছুঁয়ে তিস্তা নদী পেরিয়ে দূরের বাংলাদেশের রোদ মেখে আরও দূরে কোথাও উড়ে যায়।