সাড়ে চারটেতেই শীতকালের বেলা ফুরিয়ে আসে, উপরন্তু আজকের দিনটাও মেঘলা। বিল্ডিংয়ের বাইরে, শেডটার তলায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রুচিরা। মৌসুমীও পাশে ছিল একটু আগে, এখন রজনীগন্ধার মালা, ধূপকাঠি কিনতে গেছে। ভোর থেকে ছোটাছুটি তো কম হল না! প্রথমে হসপিটাল, তারপর থানা, শেষে এই অটোপসি সেন্টার। একটু আগে ডোমটা কথা বলে গেল সোমের সঙ্গে, “একটা ইন্টারন্যাশনাল লাক্স, এক প্যাকেট সিগারেট আর দু'বোতল মদ, হিসেব করে দেখুন যেটা হয় তার থেকে একটা টাকাও বেশি চাইনি। আর আমিই তো কাটব, সেলাই করব, রগড়ে রগড়ে চান করিয়ে দেব আপনার বউটাকে। এইটুকু দেবেন না?" মুখ থেকে ভকভক করে গন্ধ বেরোচ্ছিল লোকটার, রুচিরা নাকে রুমাল চাপা দিয়ে শুনছিল। টাকাটা পকেটে গুঁজে ডোমটা বলল, "শাড়িটাড়ি থাকলে দিন, একেবারে পরিয়েই আনব।" সোম হলুদ জামদানিটা কাঁপা কাঁপা হাতে এগিয়ে দিল, এসবও মনে করে এনেছে! রুচিরা একবার ভাবল, দামি শাড়িটা মড়ার গায়ে দিয়ে নষ্ট করার মানে হয় না, কিন্তু সোমকে এখন এসব কে বোঝাবে? চশমাটা খুলে আঁচলের খুঁটে মুছে আবার চোখে দিল রুচিরা। গা'টা যেন একটু গুলিয়ে উঠল। অনেকক্ষণ পেটে কিছু পড়েনি। এন আর এসের মেইন গেট থেকে অনেকটাই ভিতরে এই বিল্ডিংটা। শেষ প্রান্তে। ডক্টর সুকান্ত সান্যাল পোস্টমর্টেম করবেন। খুব সুনাম ওঁর। মৃতদেহকে ছেনে ছেনে ঠিক আসল কারণটা খুঁজে বের করেন। টেমপ্লেটেড ফরম্যাটে রিপোর্ট লেখেন না, ফ্রিস্টাইল ফরম্যাট ফলো করেন। অনেক ডিটেলিং থাকে তাতে। কখনও কখনও কাব্যিক হয়ে যায় সেই রিপোর্ট। মৃতদেহ ছেনে ছেনে সব অস্বাভাবিকত্ব উঠিয়ে আনেন ডক্টর সান্যাল। পড়তে ভালো লাগে, মনে হয় মৃত্যুর সহজ ব্যবচ্ছেদ। রুচিরা চিন্তিত, ডাক্তারবাবু কি সত্যিই আসল কারণটা খুঁজে পাবেন? বাঁ হাতের অনামিকার আংটিটা টাইট হয়ে গেছে। আগে ঘুরত। টেনশন হলেই ওটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভাবত রুচিরা। সোমও ক্লান্ত। ওকে পাশ কাটিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় রুচিরা, বিল্ডিংয়ের ভিতরে। ট্রেতে শোয়ানো মৃতা। দেহ কি শুধুই কতগুলো অঙ্গের সমাবেশ আর তার বিকলতাই মৃত্যু? রুচিরা অপেক্ষা করছে। এক এক করে কলকবজা ঘাঁটছেন ডাক্তারবাবু। গলা, ফুসফুস, পাকস্থলী, শিরা, ধমনীর পরিব্রাজন শেষে হৃদয়ে উপস্থিত হয়েছে হাতদুটো। রুচিরার মৃত শরীরটা কি একবার কেঁপে উঠবে? দীর্ঘদিন ভালোবাসার অভাবে সবকটা অলিন্দে মরচে পড়ে গেছে, হাত দিলেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে। ডক্টর সান্যাল দেখতে পাবেন মরচে লাগা সেই হৃদযন্ত্রের চারখানা খোপ? তাঁর ফ্রিস্টাইল রিপোর্টিং তো বিখ্যাত। নাকি তিনিও লিখবেন বাসের ধাক্কায় অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণই নারীটির মৃত্যুর কারণ। উফ্, রুচিরা যে ধৈর্য হারাচ্ছে!