"স্কার্টটা তোল তিয়াষ!" বিভাদির গলায় অদ্ভুত এক সম্মোহনী সুর। তিয়াষ মুহূর্তকাল থমকায়। তারপর ধীরে ধীরে তুলে ধরে স্কার্টটা। গম রাঙা থাইতে শুকনো কালসা রক্তের সমান্তরাল রেখাগুলো একে অপরের সঙ্গে কাটাকুটি খেলছে। অসতর্ক মুহূর্তে মিতালীরা দেখে ফেলে ধরে নিয়ে এসেছে বিভাদির কাছে। "ব্যথা পেয়ে নিজেকে ব্যথা দিয়েছিস বুঝি!" মাথা নিচু করে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে তিয়াষ। "এমন কাটাকুটি আরও অনেক আছে তাই তো! মনে ব্যথা পেলেই নিজেকে এমনভাবে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না রে!" তিয়াষের শক্ত চিবুকের দিকে তাকিয়ে বিভাদি বলে চলেন, "কী ব্যথা পেয়েছিস ইচ্ছে হলে আমাকে বলতে পারিস! আবার নাও বলতে পারিস। তবে একটা জিনিস তোকে আমি শিখিয়ে দেব। দেখবি কীভাবে ব্যথাকে তখন লবডঙ্কা দেখাতে পারবি। টিফিনের সময় আমার কাছে চলে আসিস কিন্তু!" এরপর বেশ অনেকদিন টিফিনের সময় বিভাদির সঙ্গে লাইব্রেরিরুমে কেটেছে তিয়াষের। ধীরে ধীরে মেলে ধরেছে সে তার মনের গোপন বেদনা। সব সময় বাবা মায়ের গুরুত্ব ভাইকে দেওয়া থেকে কোচিংয়ের প্রীতমের সঙ্গে সম্পর্কের ওঠা পড়া। আর যখনই ব্যথায় টাটিয়ে উঠেছে মন, ব্লেড দিয়ে চিরে ফেলেছে শরীরের এখানে সেখানে। বিভাদি তাকে মনের সর্ব ব্যথা উপশমকারী এক মহৌষধির সন্ধান দিয়েছিলেন। ধৈর্য নিয়ে দিনের পর দিন শিখিয়েছেন ব্যথা পেলে কীভাবে সেই ব্যথাকে ছাঁচে ঢালতে হয়। বিভাদি শিখিয়েছিলেন রঙিন কাগজ ব্লেড দিয়ে চিরে অপূর্ব সব কারুকাজ। কতগুলো রঙিন কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, "এখন থেকে ব্যথা পেলে যেমন ব্লেড চালাস তেমনই চালাবি তবে নিজের শরীরে নয় এইগুলোতে। দেখব তোর ব্যথারা কেমন কারুকার্যময়!" পরে ছুরি দিয়ে মোমের তাল কুঁদতেও শিখিয়েছিলেন। তারপর চক, কাঠ আরও অনেক কিছু দিয়ে ব্যথার পারিজাত ফোটাতে শিখে নিয়েছিল তিয়াষ একটু একটু করে। এখনও সময়ে সময়ে এক টুকরো সুগন্ধী দীপের মতন মনে ভেসে ওঠে স্কুলের পিছনের মাঠে ছাতিম তলায় বসে বিভাদি গাইছেন, "আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন!" বর্তমানে স্বনামধন্য কারুশিল্পী তিয়াষ দাশ যখনই দেশ বিদেশের নানান সম্মানে ভূষিত হন তখনই সময় করে ছুটে যান তাঁর বিভাদির কাছে। তিয়াষের কাঁচা মনের নদীখাতটাকে একটু একটু করে কুঁদে কুঁদে ভিন্ন পথে চালিত করেছিলেন তো মানুষ গড়ার শিল্পী বিভাদি! যে খাতে এক সময়ের তিয়াষ নামের দুঃখ নদীটা আজ আপন আনন্দ ছন্দে বয়ে চলে নিজের সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!