অন্য এক জীবনের কথা

হাবড়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা


১
মানুষ বারবার নদীর কাছে আসবে। কখনও দুঃখে কখনও আনন্দে। মানুষ আসলে নদীর কাছাকাছি থাকতে চায়, থাকতে চেয়েছে। নদীর খুব কাছেই থাকে প্রাচীন বট। তার খুব কাছেই মন্দির-- শিব অথবা কালী। নদীর লাগোয়া স্নানের ঘাট। ঘাটের কাছে নৌকা। নৌকার ওপর বসে থাকে মাঝি। সে খোলা গলায় ইচ্ছে হলে গান গায়। গান শুনতে শুনতে বেশ চলে যাওয়া যায় ওই পারে। ওই পারেও মন্দির থাকে, গাছ থাকে, গাছে পাখি থাকে। গাছতলায় বেদী বানানো থাকে। আর এক দীর্ঘ জটাজুটধারী ছাইমাখা সন্ন্যাসী - হাতে ত্রিশূল...'ব্যোম শংকর' নাদ তুলে তোমাকে ডেকেছিল কত কাল আগে। শরীর জুড়ে বাতের ব্যথা। আপাং গাছের মূল পরেছ কোমরে লাল সুতোয়। এইসব টোটকা বা তাবিজ-কবচে তোমার ভারী বিশ্বাস দেখেছি আমি। 

তুমি ফুল তুলতে তুলতে রামপ্রসাদ গাইছ। ভবা পাগলা গাইছ। কমলাকান্ত গাইছ। শিব মন্দিরের চাতাল জুড়ে ঝরে আছে অজস্র কাঠচাঁপা। পাশের গাছে হলুদ কলকে ফুল। তুমি এসব প্রতিদিন চয়ন কর। এই যে এখন জ্যৈষ্ঠের শেষ দুপুরে তুমি ফুলের গন্ধ পাচ্ছ। সে গন্ধ তুমি প্রাণ ভরে টেনে নাও। আরেকটু পরেই নদীতে জোয়ার আসবে। একটু একটু করে জল ধাক্কা দিচ্ছে বাঁধানো ঘাটে। নির্জন অপরাহ্নকালে তুমি সেই ম্রর ছলাৎ ছল শব্দ শুনতে পাচ্ছ। এই সময়টা তোমার খুব ভালো লাগে। কারণ এখন তুমি নদীর কাছে গিয়ে বসবে। পা দুটো ভিজিয়ে রাখবে জলে। সিঁড়িতে বসে বসে জল দেখবে। জলে ভাসতে থাকা পুজোর ফুল, মালা দেখবে। কচুরিপানাও দেখবে।

    দু-একটা জেলে নৌকা এই সময় দেখবে ফিরে যাচ্ছে ঘরপানে। কখনো বা দূর থেকে আসা যাত্রীবোঝাই নৌকা। হাট থেকে ফিরে আসছে সংসারী লোকজন। তুমি কি সংসারী লোক নও? একথা কি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলে কখনো? তোমার ভিতরে কী একটা নদী বয়ে যায় না অতল অসীম?

     আর কিছুক্ষণ পর। লোকজন ধীরে ধীরে এসে বসবে নদীর ঘাটে। সিঁড়িগুলি ভরে যাবে মানুষের আলাপনে। আরেকটু পর বিকেল নামবে। সন্ধ্যার আগে পুরোহিত মহাশয় এসে জ্বেলে দেবেন  কুলুঙ্গীতে আলো। আলো জ্বলে উঠবে দেবদেউলে। তোমার ভিতর-বাহির জুড়ে আলো। প্রদীপের নম্র মগ্ন আলো। সে আলো কেউ কি দেখেছিল? দেখতে চেয়েছিল? তুমি জানো কী তা! জানতে চেয়েছ কখনো?

    কেউ কি কোনো একদিন কিংবা  এক মুহূর্তের জন্যেও ভালোবেসেছিল তোমায় ? সংসার করতে চেয়েছিল এইসব অনিত্য সন্ধ্যায়? কেউ কি তোমার হাতে হাত রেখে বলেছিল: 'তুমি সুন্দর। তুমি নদী। তুমি উপবন। তুমি আশ্রয়। তুমি বন্ধু। তুমি ভালোবাসা...'কিছুই তোমার মনে নেই। শুধু এক নদীর মতো আকাশ লিখে রেখেছ খাতায়। শুধু এক নির্জন নদীর দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিয়েছ সারাবেলা।

     শুধু জলের ওপর জল লিখেছ। জলের ওপর কেবল ছোটো বড়ো অজস্র ঢেউ। সব সন্ধ্যার নিজস্ব কিছু গল্প থাকে। সব নদীর নিজস্ব কিছু ব্যথা থাকে। তুমি নদী ভালোবেসে , জল ভালোবেসে কাটিয়ে দিয়েছ জীবন। জবাফুলের মতো এই ক্ষণিক জীবন। আকন্দফুলের মতো গভীর এই জীবন। কলকেফুলের মতো নরম এই জীবন।সেই  জীবনের পদ্মপাতায়  জল হয়ে থেকে গেলে। এ জীবনকে প্রণাম। তুমি উপভোগ করেছ একাকীত্বের দহন। নিঃসঙ্গতার  আনন্দ। গভীর চিন্তন। আধ্যাত্মিক এষণা। তাই তো এই জীবনকে প্রণাম।

    মানুষ বারবার নদীর কাছে আসবে। ভালোবেসে আসবে। দুঃখ পেলে আসবে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করলে আসবে। সে জলের সঙ্গে কথা বলবে। খুব জরুরী এই জলের সঙ্গে কথা। গাছের সঙ্গে কথা। মন্দির চাতালে বসে ঈশ্বরের সঙ্গে কথা।

     ২
     যখন খুব চুপ করে বসে থাকি। ভিতরের কথা শোনা যায়। মনে হয় বুকের মধ্যে কে যেন গামছা নিঙড়ে নিচ্ছে। কত যে কষ্ট হয়। কেন কষ্ট হয়। আমি যে বুঝিয়ে বলতে পারি না। অকারণ অকারণ অকারণ তখন কেবল কান্না পায়। ঠিক তখন-ই কেউ যেন এসে বসে আমার পাশটিতে। অথচ তাঁকে দেখা যায় না। অনুভব করা যায় মাত্র। দূরে মন্দিরে আরতি হয়। ঘন্টা বাজে ঢং ঢং ঢং...নদীতে অশ্বথ পাতার ওপর মাটির প্রদীপ ভাসায় কেউ। দীপের আলোটি ভাসতে ভাসতে বিন্দুবৎ হয়ে ওঠে। আমি উঠে দাঁড়াই। ধীর পায়ে হেঁটে আসি চলমান গতিময় জীবনের কাছে। আমাকে যে এখুনি সাইকেল নিয়ে ছুটতে হবে গাঢ়তর অন্য এক জীবনের কাছে।

বৈশাখী ২০২৪