একটা বিকেল নামতো মায়া মেখে! গরমের ছুটি তখনও শেষ হয়নি। স্কুল কলেজ সব বন্ধ। তপ্ত দুপুর ঘরের ছায়ায় কাটিয়ে গ্রাম-মফঃস্বলের মানুষগুলো সূর্যের তেরছা নরম আলো মেখে বাইরে এসে দাঁড়ায়। সারা দুপুর পিঠে 'লাভলি' আইসক্রিমের সবুজ কাঠের বাক্সটা নিয়ে অলিগলি, মেঠো পথ ঘুরে হেঁকে হেঁকে কাঠি আইসক্রিম বিক্রি ক'রে, হা-ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে গেছে তখন আইসক্রিমওয়ালা। পাড়ার চকে ছেলেপুলেরা জটলা করে বৌবসন্তী, খো খো খেলায় মেতেছে। লুকোচুরি খেলে, ছুটে বেড়ায় গোয়ালের পেছনে, পুকুরের খোলে, নিম-তেঁতুল গাছের আড়ালে! দোলমঞ্চের পাশে বউ ঝিদের গল্পের আসর বসে। সোয়েটার বোনে, আসন সেলাই করে কেউ। চুল বাঁধে! সুখ দুঃখের গল্প করে। বড় রাস্তার ধারে বল খেলার মাঠটায় ফুটবল খেলে বড় ছেলেদের দল। হো হো আওয়াজ ওঠে থেকে থেকে। ডুবে থাকে খেলায় সব, বেলা গড়ায় হুঁশ থাকে না কারও। মাঠ ঘেরা ঝাউগাছের তলায় গায়ে গায়ে ঠেকানো থাকে তাদের সাইকেল। ছাতারে পাখির দল এসে বসে গাছের ডালে, ঝগড়া করে, উড়ে যায় আবার। পাকা রাস্তার ওপরে, দোকানের ঝাঁপ খুলে তোলা উনুনে আঁচ দেয় দোকানি। কয়লার আগুনের ধোঁয়া ওড়ে! চায়ের জল চাপে উনুনে। বাস এসে থামে একটা দুটো শহর থেকে। ধুলো ওড়ে চাকায় চাকায়, কাজফেরত লোক নামে বাস থেকে। ঘন্টি বাজিয়ে বাস চলে যায় আবার, মিলিয়ে যায় দূরে। বাড়ি যাওয়ার গ্রামের পথ ধরার আগে চা দোকানের কাঠের বেঞ্চে বসে জিরিয়ে নেয় বাস থেকে নামা লোকজন। চা খায়, শহরের হাল হকিকতের খবর জানায়। ভিড় বাড়ে একে একে। রাজনীতির গল্প হয়, ভোটের কথা। কলকাতা ময়দানের ফুটবলের গল্প। চেনাজানা সব, পরিজন। ভয়দ্বিধাহীন আলাপচারিতা চলে। রাস্তার গায়ে শীতলা মন্দির লাগোয়া জেরক্স দোকান, বইখাতার দোকান। বিকেলের টিউশন সেরে ছেলেমেয়েদের ভিড় উপচে পড়ে সেখানে। এটা ওটা চাহিদার বায়নাক্কা চলে। হাজারও কথার খই ফোটে মুখে মুখে! বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই, লতায় পাতায় গল্প বোনে কৈশোরবেলা! পাশের ক্যাসেটের দোকানে গান বেজে চলে, “…ছুপানা ভি নেহি আতা, যাতানা ভি…!” বাস স্ট্যান্ডের পাশেই সবজি বাজার। সকালের ভিড়ভাট্টা হইচই নেই! সারি সারি বন্ধ চালাগুলো ঘুমিয়ে থাকে এই বিকেলে। বস্তা চাপা দেওয়া দোকান কুড়োনো মাল, কাঠের তক্তা পড়ে থাকে অবহেলায়। ফলের দোকানের পাশে কাঁঠালের এঁতো, আম-লিচুর পাতা ঢিবি করা। ডুমো ডুমো নীল মাছি ওড়ে ভনভন করে। খালের ধার বরাবর চওড়া ইঁটের রাস্তা। রাস্তার গায়ে পুটুসের ঝোপ। বুলবুলি খেলা করে আর শিস দেয় সেখানে। সাইকেল টেনে পায়ে পায়ে হেঁটে চলে সে রাস্তায় কলেজের ছেলে মেয়ে। অধোবদন, প্রায় নিশ্চুপ দুজন মানুষ। লাজুক পায়ে শাড়ির কুঁচি জড়ায় মেয়েটির। খালের জলে অনর্থক কাটাকুটি খেলে মরে জলফড়িং! কী যে করে সে, নিজেই জানে না। তির তির করে হাওয়া বয় জলের ওপর দিয়ে! সময় যায়, শেষ হয়না মনের কথা। তবু শেষ হয় পথ, বড় রাস্তায় গিয়ে মেশে! সূর্য পশ্চিমে ঢলে, ফুরিয়ে আসে দিন। অশ্বত্থ গাছের তলায় ঝুপসি হয় আঁধার। সরু আলপথ ধরে গরু নিয়ে বাড়ি ফেরে গৃহস্থ। দূরে কোথাও শাঁখ ঘন্টা বেজে ওঠে। দিঘির জলে গাছগাছালির ছায়া দীর্ঘ হয়। পাখিদের ডানায় ঘরে ফেরার তাড়া। বিষণ্ণ একলা বিকেল নামে আজ একলা ঘরে! স্মার্ট জীবনে দুপুর গড়িয়ে এখন সোজা সন্ধেতে গিয়ে মেশে। হাজারো ব্যস্ততার মাঝে হারিয়ে গেছে রোদেলা বিকেল! অলস বিকেল! অলি গলি, মেঠো পথে বন্ধুতা-আত্মীয়তা আর খেলা করে বেড়ায় না আগের মতো। চেনা মুখগুলো দূরে সরে সরে আবছা হয়ে গেছে। অব্যক্ত প্রেম আর স্বপ্ন খুঁজে ফেরে না শেষ বিকেলে! বিকেল নামে না আর মায়া মেখে! গ্রামে মফঃস্বলে!