আমাদের সবার মনের ভিতর একটা কমলবন আছে। সেখানে শত সহস্র গোলাপি কমলের ভিড়। কেউ নবোঢ়ার মতো লাজে অধোবদন। কেউ বা পূর্বরাগের ছোঁয়া পাওয়া আধুনিকার মত ঊর্ধ্বমুখী। এরা সবাই নিজেদের পেলব পাপড়ির আড়ালে একটি করে হলুদ ব্যথার বৃত্ত লুকিয়ে রাখে। সেই ব্যথার ঘ্রাণকে আমরা সকলে ভারি ভয় পাই। তাই কারও সামনে কমলবনের পরিচয় জাহির করি না। অথচ সারা জীবন আমরা বৃক্ষ সেজে থাকি। ক্লান্ত, রিক্ত শাখায় সবুজ কিশলয়ের মায়াকাজল পরি। ভাবি পুরনো পৃথিবী বুঝি এখনো আছে। মনে মনে যদিও আমরা জানি পুরোনো পৃথিবীর সব ছবি এখন ধুয়ে মুছে গেছে। প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীরা আমাদের মনের অপ্রাপ্তির ক্ষোভে ছাড়া আর কোথাও নেই। এই দ্রুত বদলে যাওয়া পৃথিবীতে মানানসই হওয়ার তাগিদে আমরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে অভিযোজিত হতে চাই। বৃক্ষাকৃতিতে না সই, বনসাই হয়েই সই - আমরা টিকে থাকি। লুক্কায়িত কমলবন যখন আমাদের উত্যক্ত করে তখন আমরা গুনগুন করে বলি, “তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্ত রাতে। আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল চরণপাতে।” ভাঙ্গনের গান আমাদের শৈশবে নিয়ে যায়। তখন প্রবল বর্ষণের জন্য নিম্নচাপের প্রয়োজন হত না। ঘোলা, কালো নোংরা জলে পথঘাট ডুবে যেত। সেই মেকি সমুদ্রে কাগজের যে নৌকা ভাসত তা মেকি হত না। লেখার খাতার পাতা ছিঁড়ে বানানো নৌকার গায়ে অপরিণত হাতের লেখায় কী কী ছড়া ভেসে গেল তা আজ আর মনে পড়ে না। মনে পড়ে না সেই বন্ধুর মুখ যাকে চিঠি লিখতে হলে খামে একটি গন্ধরাজ রেখে দেওয়া আবশ্যিক ছিল। আমাদের এই বিস্মরণ তারপর উড়ানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। ওর গায়ে হলুদ কালো রং জাগে। শক্ত সবল ডানায় ভর করে বিস্মরণ উড়ে যায় আমাদের কমলবনে। গোলাপি কমলের দল, নতমুখী কমলের দল দংশিত হয়। ব্যথায় নীল হতে হতে তারা অপরাজিতা হয়ে যায়। অপরাজিতা লতানে গাছ। ওর নামের মধ্যে পরাজয় নেই কারণ ও কখনো মহীরুহ হওয়ার প্রতিযোগিতায় নাম লেখায়নি। যারা জেতার জন্য লড়ে না তাদের গায়ে লবঙ্গ-গন্ধ থাকে।সেই সুঘ্রাণ এবং নরম শরীর নিয়েই অপরাজিতা সুখী। পরাশ্রয়ী হয়েও ও আলোক পথের যাত্রী। আলোর দিকেই নরম আকর্ষ বাড়ায় ও। কমলবনের আড়ালে যে টলটলে সরোবর ছিল তাকে কতবার প্রতিমা বিসর্জনের সাক্ষী হতে হয়েছে। যে কমল দেবীবরণের জন্য উন্মনা হয়েছিল সেই আবার দেবীমূর্তির বিলীয়মান রূপ দেখেছে কতবার। কাঠামোর সঙ্গে মৃত্তিকার রাখি বন্ধন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কাঠামোর শুধু রিক্ততা পড়ে থাকে। সে রিক্ততায় কমলবন কেঁদেছে কতবার। অপরাজিতার সে দুঃখ নেই। কমলবনকে তাই শেষমেষ নীল অপরাজিতা হয়ে যেতে হয়। অপরাজিতা বলে, বদলে যাওয়া পৃথিবীতে চাঁদ সেই একই আছে। বেদেনির ঝাঁপির মতো চাঁদ উঠলে আজও জ্যোৎস্না নেমে আসে ভুজঙ্গের মতো, যেভাবে শৈশবে আসত। শৈশবে বাবার হাত ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় একবার চাঁদ আর একবার বাবার মুখ দেখা হত। এখন ঘুমন্ত শিশুর মুখের উপর চাঁদের আলো পড়লে শৈশবের সেই ছবি ফিরে আসে। দুটি ছবিতেই জ্যোৎস্না রঙের অপূর্ব কারুকাজ। দুটি ছবিই হুবহু এক। বদলে যাওয়া পৃথিবীতে সব কিছু বদলে যায় না বলেই আমাদের মনে কোমল কমলবন জেগে থাকে অথবা মাচাভরা নরম অপরাজিতা। আমরা আজীবন খুঁজে ফিরি প্রেয়সীর নাভির মতো উর্বর জমি যেখানে ফুল হয়ে ফুটবে আমাদের নির্বাণ।