তিস্তা

কলকাতা


মিষ্টি যখন ইন্দ্রিয়ের অতিরিক্ত ভারী হয়ে ওঠে তখন জিভে তেতো লাগে। আমরা বলি হাকুচ তেতো। আসলে যেটা হাকুচ তেতো, সেটার মধ্যে মিষ্টত্ব অধিক বলেই সেটুকু ভার হয়ে পিঠের ওপর চেপে বসে। 

এভাবেই তিক্ত সম্পর্কগুলো আস্তে আস্তে একটা তিক্ততার প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়ায়। আমি খারাপ আছি। তোমার ধারণা আছে আমি ঠিক কতটা খারাপ আছি? তুমি একটু খারাপ আছ, আমি বেশি খারাপ আছি। তারপর শুরু হয় খারাপ থাকার দৌড়। যে বেশি খারাপ আছে, যেন তাকে ত্যাগের মহামহিম দেবতার মুকুট পরিয়ে দেওয়া হবে। সেই মুকুট পরে সে একটা একটা করে দরজা, একটা একটা করে জানলা বন্ধ করে দিতে থাকবে। আলো আসা বন্ধ হবে, বাতাস আসা বন্ধ হবে। তখন হাঁসফাঁস করতে করতে অভিযোগের পৃথিবী নেমে আসে মাটির কুঁড়েঘরে। 

সেজন্যই তিক্ততা যখন আসে, মনে হয় সেটুকু বড় বেশি। তখন হাত ছাড়তে নেই, আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরতে হয়। সম্পর্কও তো নদীর মতো। তার সব বাঁকে সমাদরের আসন বিছান থাকে না, যে বাঁকে প্রবেশ নিষেধ লেখা থাকে, সেটাও আসলে প্রবেশ নিষেধ নয়, তার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় আমায় জয় করো। সব নদীকেই নিজের পথ নিজেকে করে নিতে হয়, সব সম্পর্ককেই তৈরি করে নিতে হয় তার নিজস্ব প্রপাত। তিক্ততার প্রতিযোগিতা ভুলে মানুষকে শান্ত হয়ে তখন দেখতে হয় পেছনে ফেলে আসা সুদূরবর্তী নদীর চর। সেখানে তখনও ফেলে আসা পথের বকুল পড়ে আছে তীরে তীরে। সেখানে তখনও লেগে আছে স্নেহের, ভালোবাসার, নির্ভরতার স্থির উষ্ণতার মিঠে দাগ। 

তিক্ততা আসলে তাই ছুটির ঘন্টা নয়। তিক্ততা আসলে নতুন ক্লাসে ওঠার রিপোর্ট কার্ড। এবার নতুন বই, নতুন মলাট, নতুন স্টিকারে লেখা পুরোনো সম্পর্কের নতুন নতুন গল্প। অথবা আর এই কুঁড়েঘরে জায়গা ধরছে না, এবার আমাকে আকাশের অধিকার দাও। গভীরভাবে দেখতে গেলে জীবনে যেটুকু সহজভাবে ধরা দেয়, সেটুকু সহজভাবে চলেও যায়। যেটুকু যায় না, সেটুকু বুকের ভেতরে একটা সুড়ঙ্গ খুঁড়তে থাকে। মানুষ নিজের গভীর গোপন গুপ্তধন রেখে আসে সেই সুড়ঙ্গে। যাতে সেটুকু সুরক্ষিত থাকে। সেটুকু হারিয়ে গেলে কোথাও গিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না।

আর দুখীসুখী মানুষ ভাবে সব গেল বুঝি। সে তখন অধৈর্য হয়ে ওঠে। আঙুল তোলে, যন্ত্রণার জন্য একজন অপরাধী খাড়া করতে যায়। পোড়াতে চায় তার কুশ পুত্তলিকা। অথচ অবিশ্বাসের কাঁটার ঠিক পাশেই থাকে বিশ্বাসের সেতু, জ্বরের প্রদাহের ঠিক পাশেই থাকে সাহচর্যের শীতলপাটি। তাই দগ্ধ হওয়ায় সময় চুপটি করে বসে থাকতে হয়। ছটফট করতে নেই। অপেক্ষা করতে হয় কখন যেটুকু চোখের দৃশ্যমানতার বাইরে ছিল, সেটুকু উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে নিজের আলোয়। অপেক্ষা করতে হয় যেটুকু আকুতি, যেটুকু প্রার্থনা, যেটুকু নৈকট্যের সুর শ্রবণের অগোচরে রয়ে গিয়েছিল, সেটুকু কখন অতীন্দ্রিয় মহাসঙ্গীতের মতো মরমের মিড়ে এসে ঝঙ্কার তুলবে। তখন আর কুঁড়েঘরে জায়গা ধরে না, তখন গুপ্তধনের নতুন ঠিকানা, সুড়ঙ্গ তখন আরও গভীর, আরও মহনীয়, আরও রমণীয়। তারপর একদিন সেটুকুও বাড়তে থাকবে, সদ্যনির্মিত প্রাসাদের দিকে তাকিয়েও একদিন মনে হবে এইটুকু জায়গায় এত জারুল কোথায় রাখি! তখন আবার তিক্ততা আসবে, আবার আকাশ ছেয়ে যাবে তিক্ততার প্রতিযোগিতায়। 

আবার নতুন করে শুরু হবে সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়, আর নির্মিত হবে নতুন রাজপ্রাসাদ। বৃহত্তর, মহত্তর, সুন্দরতর। ছায়া দেবে, মায়া দেবে, নির্ভরতার হাত দেবে। আর এভাবেই একদিন বাড়তে বাড়তে পৃথিবীর সব রাজপ্রাসাদগুলো আর প্রাসাদ থাকে না। পাহাড় হয়ে যায়। হিমালয়ের মতো বিশাল। আর সবকটা তিক্ততা তখন হিমকন্যার মতো গলে গলে নেমে আসতে চায় দুটো হাতের উষ্ণতার সমতলে। 

তখন আমরা তাদের তিস্তা বলে ডাকি।।

বৈশাখী ২০২৪