বিষণ্ণ নদীর গায়ে শেষ সূর্যের আলো আহ্নিকে বসলে আমি উঠে দাঁড়াই। এবার পথচলা কঠিন মনে হয় না। ভ্রম আর সন্ধ্যার সম্পর্ক গাঢ়। শিরদাঁড়া অবসন্ন হলে এমন ভোজবাজি ভালো লাগে। আরাম জিরিয়ে ওঠে শরীরে, মনে। রাসুর মায়ের আগুনছেঁচা মুখের মতো আগলহীন কজনই বা হয়? সব আলাপ সব সংলাপ মিথ্যে। ভ্রম আসলে মুক্তি, ভরসা এবং সান্ত্বনা। এইকথা বলামাত্র নাকের ডগায় চশমা রেখে মুদিখানার তেলচিটচিটে হিসেব রাখে কেউ। আমার ঘাড় বেয়ে চুঁইয়ে পড়ে বিষাদনদীর জল। হাঁটতে হাঁটতে যে সাঁকোর কাছে দাঁড়াই তাকে পেরোলেই সব শিকল খসে যেত নিমেষে কিন্তু এখনও সাধ হয় ললিতমোহন আমায় ছুঁয়ে যাবে, সোনামেয়ে বলে থুতনি নেড়ে সৎ ছোঁয়া রাখবে কোনো আদ্যান্ত ভণ্ড। দূর থেকে শব্দ শুনি, নদী ডাকছে। বিষাদের গায়ে গায়ে স্বপ্নের ছিঁড়ে যাওয়া ডানারা অন্তর্জলী যাত্রায় তাবু ফেলেছে। উল্টো পথে রঙিন ফুলের চাষ। শুকিয়ে ওঠা পায়ের কাদা শক্ত খোলসের মতো। দাঁতন হাতে ধেইনৃত্য জুড়ে দেয় অতীত। ছোটোখোকা বলে অ, আ, শেখেনি সে কথা কওয়া। আমি তো খোকা নই জগদম্বা! নারী, পূর্ণ নারী। শুকনো হাওয়ার ভিতর খটখট করে মাঠের হাড়পাঁজর বেজে ওঠে। ধানকাটা শেষ হল কবে? এমন হাড় জিরেজিরে কঙ্কাল চেহারা আমি দেখতে চাই না মোটে। মাঠ হাসে, বাতাস হাসে, জগদম্বা দশমুখে হাসে। পূর্ণ! পূর্ণ হলে স্হির হয় চরাচর। সত্যদর্শন শিউলি হয়ে ঝরতে থাকে জটাজুটোর ভিতর। আর অপূর্ণের কেবল দাপাদাপি। নাকি কান্নায় জড়িয়ে যায় চোখ। তখন কে কার? তুমি কার? সত্য অসত্যই বা কার? প্রেত নাচে তাথৈ তাথৈ। আমি নাচি তবে আরো বেশি? ফিরতে চাইলেই কি ফেরা যায়? ভিতর পর্যন্ত তবে দেখাল কে জগদম্বা? যে দেখাল সে কী চায়? এমন স্বজন বান্ধবহীন কেবল মাংসপিণ্ড হয়ে জেগে থাকব? নদীর পাড়ে ধুনি জ্বলে, পোড়া গন্ধকের গন্ধ, বাতাস ভারী হয়ে চেপে বসে। তবে ঘুরে ফিরে আবার এখানেই ফিরেছি! আকাশের গায়ে ফুটে উঠেছে স্বপ্নবিন্দু, হা কৃপাসিন্ধু এত বিরাগ আমার প্রতি! আমি কি আত্মজ নই! হাসেন মহেশ্বর। আগুনের ভিতর শুদ্ধিব্রত উদযাপন করে কিশোরী। সাদা থান জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক বৃদ্ধা, বুকে তার স্বপ্নের মধুকর ডিঙা। আদর স্বরে বলে, পুড়লেই খাঁটি সোনা। এমনিতেই সব পায় যে তার ষোলোআনাই বৃথা। দুহাতে কান চেপে ধরি, শুনব না আর শুনব না। এসব ভ্রম, সান্ত্বনা। পরম যত্নে চোখের পিচুটি মুছে দেয় কাল, মুখে রাখে পদ্মমধু। আমি চোখ মেলি আগুনের ভিতর থেকে। বিষাদনদী রাত্রির মতো নিঃসঙ্গ। বোবাকান্নায় ডুবে যায়। আমি বটবৃক্ষ হবার আশায় ঝুরি নামিয়ে অপেক্ষা করি। হাসিমুখে দেখি মানুষের চোখ। মুখোশের ভিতর দাঁত, নখ, তীব্র ঈর্ষা, অহঙ্কারের পাশে কে ও! কে বয়ে চলেছে? এত নোনাজল কোথায় রাখে? মনের ভিতর মন। আহা শিশুটির গায়ে হাত রাখি, মুখ মুছিয়ে কোলে আনি। বুকের ওমে জুড়িয়ে দিতে চাই লবণ হৃদ। জালের মতো বিছিয়ে থাকা সম্পর্ক শরশয্যায় কাতর। জন্মের দাগ মুছে যায় আমিত্বের সুতীব্র ঝাঁজে। ম্লানমুখে হেঁটে চলে যায় নাড়ির টান, প্রেমের টান, নির্ভরতার টান। বৃষ্টি নামে জগৎ জুড়ে। দূরে সরে থাকতে পারি না কোনোমতেই। ঢেউ ভাঙতে থাকে, জ্বলতে থাকি অপমানের মোলায়েম আদরে, উপেক্ষার পুষ্ট ফলের সুঘ্রাণে মৌতাত আসে। জগদম্বা আর আমি মিলেমিশে যাই। বিষাদ নদীতে বাঁধ দিই। চারিদিকে যত্নে লাগাই ক্ষমাবৃক্ষের ফল। অর্থ, প্রতিপত্তির বিকারের ভিতর, কৃতঘ্নতার গাম্ভীর্যে আহত আমির ছায়াকে তুলে আনি। সাঁকোর পাড়ে চুপ করে দাঁড়াই। সব মানুষেই জগদম্বার দর্শন পাই। ক্ষমাবৃক্ষের ফল থেকে নতুন চারাগাছ জন্মায়, আকাশ ছোঁয়ার বাসনায় পাখা মেলে ঊর্দ্ধে। মূর্তির বাইরের খোলস ভাঙতেই কত বিষাদ নদী আমার মোহনায় ঠাঁই নেয়।