সে তরী বাইবে বলে…

বাটানগর; দঃ ২৪ পরগণা


দ্বিধা এমন এক কিনার, যেখান থেকে ফিরে আসতে চেয়েও আদৌ ফেরা হয়ে ওঠে না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঝুপ করে  সন্ধে হয়ে আসে, কুয়াশায় ঢেকে দেয় সবকিছু, দৃষ্টির অগম্যে পাথরের চোখে ঘুলিয়ে ওঠে স্বচ্ছতা, এক বদ্ধক্ষ্যাপা পরত কে পরত খুঁজে মরে স্ফটিকজল…খিদের সামান্তরিকের পরিপন্থী জেগে থাকে ভ্যান গখের তারকাখচিত রাত্রি…এ সময় খুব মনে পড়ে সঞ্চয়ে থাকা কোন বৃষ্টিপালন, সদ্য ভূমিষ্ঠ চারাটিকে অতিরিক্ত জল থেকে বাঁচাতে গিয়ে ভিজে গেছি শুনে বলে উঠলে, ছাদে শুকোতে দেওয়া শাড়ি তুলে আনতে গিয়ে তুমিও ঝুপ্পুস! একসঙ্গে না ভেজার অতৃপ্তি কি এভাবে মিটে আসে? সময়ের দীর্ঘ ঝিলে প্রলিপ্ত বাষ্প, আয়তন পার হতে হতে তৃপ্তির মলাটের কোণে জমে ওঠে বাস্তবিক উদাসীনতার মায়া। সঙ্কেত নির্ভুল বুঝেও আমি মহেঞ্জোদারোর রাখালদাস হয়ে উঠতে পারিনি। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ওইটুকু সাদা মেনে নিয়ে সময় বয়ে গেছে নিজের মতো। এই সময় হঠাৎ বলে উঠলে, “ইস্, আজও ছাতা নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। ভিজে সর্দি বাধাবে, গা গরম, আমাকে জ্বালাবে সারারাত, প্যারাসিটামল দাও, গরম তেল মালিশ কর পায়ের তলায়…,” স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়, এই জ্বলন মোটেও অপছন্দের নয়। একটা নিঃশর্ত রাত্রির প্রযত্নেও সম্পর্কের আঠা কত গাঢ় হয়ে থাকে! এই আবর্তে নিজেকে রাখার ধৃষ্টতাই হল না কখনও।
দ্বিধা এমন এক অনিশ্চয়তার বিনীত মাধুর্য, যে দোলাচলে মুছে আসে বিভেদরেখাও…মাথুর, রসকলি, ‘মরণ রে তুঁহু মম’…চল, কদিনের জন্য সমুদ্র থেকে ঘুরে আসি। এমন প্রস্তাব পেলে মেয়ের ক্লাস টেস্টের কথা বলবে, আরও কত বাহানা, মনে পড়ে যাবে আচমকা প্ল্যানের কথা, রাতের বাসে গোপালপুর অন সি…হোটেলে কোন রুম নেই, কেয়ারটেকারের চিলেকোঠার ঘরেই দুদিনের সাম্রাজ্য, প্রত্যেকটি রোমকূপে লবণাক্ত ভালোবাসা গেঁথে নিয়ে ফেরা, অসংখ্য প্রজাপতি উড়তে থাকে, ওদের পাখনায় পাখনায় ধাক্কা লেগে যায়, রেণু খসে পড়ে, জমিয়ে রাখা ছোট্ট কাগজের মোড়কে, বহুদিন পর খুলে দেখি উদ্বায়ী স্বপ্ন হুশ। দ্বিধায় শুরু হওয়া শব্দপ্রক্ষেপে কে যেন হাওয়া বুলিয়ে যায়, এলোমেলো করে দিয়ে যায় যেখানে যা থাকার, যা না থাকারও। স্মৃতির আশ্চর্য এক সংক্রমণ প্রবণতা আছে। একলা তুমি বন্দিনী হয়ে থাকতে চাও স্মৃতির খুপরিটায়। মাঝেমাঝে মনে হয় জীবনরেখাটা এমন না হয়ে যদি কিঞ্চিৎ অন্যরকম হত? এই ‘যদি’র কাছেই সব সমর্পণ, আনতি, আশ্রয়, উদ্ধার, বিকল্প ও বিভূতি। কখনো ‘যদি’কে বাঁকিয়ে নিই, কখনো এপাশে সরাই, কখনো ওপাশে, আকাঙ্খার পাত্রটিতে টুপটাপ ঝরে পড়া মুহূর্ত জমিয়ে তোলার এই অভ্যাসের কাছে নিঃশর্ত সমর্পণের আদলে প্রত্যেকে একা, বেহেড একা। এই একাকীত্ব উদযাপন চলতে থাকে আগুন পর্যন্ত।
যখন এই শব্দ সামিয়ানা টাঙিয়েছি, তখন তারাদের নিয়ে সন্ধেপ্রদীপ জ্বালছে আকাশ। সেই ক্ষীণ রশ্মির কাছে বাছবিচার থাকছে না। লুকোনো দেরাজ যা কখনো খোলাই হল না, হবেও না হয়ত, তার বন্ধ পাল্লার ওপাশে থাকা স্মৃতি এতটুকু টসকায়নি! নিজেকে দাঁড়িপাল্লার একদিকে রেখে, আরেকদিকে যত ভার চাপিয়ে চলি, সেই অপ্রাপনীয়ের কাছে অনুভব মমি হয়ে আছে, শুধু অস্তিত্ব বজায় রেখেছে মগ্ন শালুকের দীঘি, তার জলপৃষ্ঠে হাওয়ার আলপনা…কারখানার সাইরেনে ক্ষুধার্তকে  ডেকে নিয়ে চুল্লিতে ফেলে দেওয়ার হাতছানি। সবকিছু যে নিয়মমাফিক চলছে, এর শুরু অনাদি অনন্তে। মেনে নিতে নিতে স্নায়ুজুড়ে শৈথিল্য আসে, দ্বিধার ছাপ রইল না, নিছক প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় মিশে গেল একসময়। স্বজনদের প্রত্যেকেই কিছু না কিছু চাইল আজীবন। কখনো দিতে পেরেছি, কখনো পারিনি। শুধু সেবার মাঝরাতে হঠাৎ শুরু হওয়া বুকের ব্যথাটা অজ্ঞান করে দেওয়ার আগে পর্যন্ত বিশুদ্ধ তীব্রতম এক অসহন দিয়েছিল, হয়ত কিছু নেওয়ারও ছিল ওর। নিল না তো...ওরও কি দ্বিধা ছিল কোনো!

বৈশাখী ২০২৪