ম্যামথের মোহিনী

সান ডিয়েগো, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র

প্রচুর ডাক্তার বদ্যি করা হলো কিন্তু সুরাহা কিছুই হলোনা। লুসির এখন পনেরো ছুঁই ছুঁই, চেহারা দিনকে দিন পাংশু হয়ে যাচ্ছে, আনমনা, ক্ষিধে নেই। মা বাবার একমাত্র সন্তান, থাকে ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তরে, ম্যামথ লেক অঞ্চলে। ভারী সুন্দর জায়গা, অনেকেই বলেন এটা নাকি আমেরিকার সুইজারল্যান্ড, সত্যিই তাই। বহু বহু যুগ আগে আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা বের হয়ে এই অঞ্চলটি তৈরী হয়, ম্যামথ মাউন্টেন তখন সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ছিলো। পরবর্তী কালে বিভিন্ন জ্বালামুখ আশপাশের পাহাড়গুলোর বরফগলা জলে পুষ্ট হয়ে অজস্র লেক তৈরী করে। ভৌগোলিক বিচিত্রতার জন্যই এই অঞ্চলটি বিখ্যাত। 

লুসির চোদ্দো বছর বয়সে ওর বাবা রিক ঠিক করলো শহর থেকে বহুদূরে নির্জন প্রকৃতির মাঝে গিয়ে থাকবে, ওর মা জর্জিন গৃহবধূ। রিক এর কাজ প্রধানতঃ বাড়ি থেকে, কোনো একটা বড়ো কোম্পানীর পারচেস অর্ডার কম্পিউটার সিস্টেম এ এন্ট্রি করাই ওর কাজ। কাজেই একটু ভালো নেটওয়ার্ক, একটা কম্পিউটার ও তার সঙ্গে টেবিল চেয়ার এবং প্রিন্টার হলেই ও যেকোনো জায়গা থেকেই কাজ চালিয়ে নিতে পারে। রিক ভীষণ প্রকৃতি প্রেমিক এবং বছরে অন্তত দু বার তো বড় বড় দুটো ট্রিপ মারবেই, আর সে জন্যই ওদের একটা ছোট্ট মিষ্টি আর ভি ও রয়েছে, মানে একটা চলন্ত বাড়ি। জর্জিনের হাতের ছোঁয়ায় সজ্জিত সেই ছোট্ট আর ভি যেকোনো ফাইভ স্টার হোটেলকেও হার মানাবে। টিভি, ফ্রিজ, কিচেন, এক চিলতে ডাইনিং টেবিল, বাথরুম, একটা কুইন বেড,আর একটা ফুল সাইজ বেড, সব পরিপাটি করে সাজানো। 

যখন বে এরিয়া থেকে তল্পি তল্পা গুটিয়ে ওরা এখানে বদলি হলো তখন মুভার্সরা ওদের সব জিনিস নিয়ে এলো আর ওরা তিনজন এই আর ভি চড়ে প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে, জায়গায় জায়গায় থামতে থামতে একটা সুন্দর লং ড্রাইভ উপভোগ করে নিলো। 

রিক বললো,
"আগামী তিন মাস কোথাও বেরোনো যাবেনা, বরফ পড়তে শুরু করবে, ন্যাশনাল পার্কগুলোও সব বন্ধ হয়ে যাবে, চলো একবার ইয়েসোমিতি পার্কটা ঘুরেই যাই।" 

যা ভাবা সেই কাজ, দু রাত ওখানে আর ভি গ্রাউন্ডে ক্যাম্প করে থেকে গেলো। কি অপূর্ব সব লেক আর কোল ঘেঁষে মস্ত মস্ত পাহাড়। লুসি তখন কি প্রাণবন্ত একটি মিষ্টি মেয়ে, দু দিনেই চারটে পাহাড়ে ট্রেক করে ফেললো, জর্জিন চ্যাঁচায়,
"ওরে অন্ধকার হয়ে আসছে, ওই রকম জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরিস না বাপু, বাতাস লাগবে!" 

জর্জিনের মা আবার আমেরিকান ইন্ডিয়ান, ওদের মধ্যে অনেক রকম কুসংস্কার আছে এশিয়ান ইন্ডিয়ানদের মতই। ভূত, প্রেত, পুনর্জন্ম এ সবেতেই বিশ্বাস করে ওরা। 

রিক আবার এসবের ঘোর বিরোধী, 

" তুমি এগুলো ওর মনে ঢুকিও না তো! লেট হার বি ফ্রী! শী ইস এ ড্যাডি'জ গার্ল!" 

জর্জি়ন তবু গজগজ করে, 

"নতুন জায়গা, অজগর বিজগর বন, কিছু হলে তখন আমাকে দোষ দিও না। ওনারা এরকম জায়গাতেই আসে পাশে থাকেন, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য কোরোনা। জানো আমার পিসতুতো দিদির কি হয়েছিলো?" 

"না শুনিয়ে কি তুমি থামবে? টেল মি!" 

রিক ক্যাম্প ফায়ার এ কাঠ গুঁজতে গুঁজতে বলে। 
ওদিকে বার্বিকিউ করবে বলে জর্জিনও পর্ক রিবটাতে ভালো করে মশলা ঘষছে। সাড়ে সাতটার মধ্যেই ডিনার করে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বে সবাই। কালই খাবারের খোঁজে পাশের তাঁবুতে একটা ভাল্লুক হানা দিয়েছিলো, পইপই করে বলে দেওয়া সত্ত্বেও ক্যাম্পিং করতে আসা মানুষেরা কিছুতেই ঢাকা দেওয়া ট্র্যাশ ক্যানে খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলবে না, এখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকা খাবারের খোঁজেই ভাল্লুকগুলো মাঝ রাতে হানা দেয়। বেশ ভয়ের ব্যাপার, যারা তাঁবুতে থাকে তাদের তো বেশ খানিকটা হেঁটে গিয়ে তবেই ক্যাম্প গ্রাউন্ডের বাথরুম ব্যবহার করতে হয়, জর্জিন‌দের না হয় আর ভি র মধ্যেই সব ব্যবস্থা! 

জর্জিন এক কাপ ব্ল্যাক কফি ধরিয়ে দেয় রিক কে, নিজেও এক কাপ নিয়ে চুমুক দেয়, বেশ স্ট্রং কফিটা, সারাদিনের হাইকিং এর ক্লান্তি এক নিমেষেই হাওয়া হয়ে যায়। ঝুপ করে জঙ্গলে অন্ধকার নেমে আসে, এবার মাংসটা আগুনে চাপিয়ে জর্জিন মৃদু কন্ঠে বলতে শুরু করে, ততক্ষণে অবশ্য লুসি আর ভি র ভেতরে ঢুকে পড়েছে, কানে আইপড গুঁজে বই পড়তে ব্যস্ত। 

" দিদি ব্রেন্ডা তখন এগারো বছরের, আমি ন বছরের। এই রকমই এক নির্জন জায়গা, সেটা উটা রাজ্যে নাবাহো ট্রাইবাল পার্ক, আমাদের মানে এদেশের ইন্ডিয়ানদের সেটা স্বাধীন রাজ্য, ওখানে আমাদের প্রশাসন, আমাদের বিচার ব্যবস্থা। আমরা প্রতি বছর একবার যেতাম পুরনো ঐতিহ্য সম্বন্ধে অবগত হতে। এর কাছেই রয়েছে মনুমেন্ট ভ্যালি, তোমার ওই জায়গায় ঢুকলেই মনে হবে কোনো অন্য পৃথিবীতে চলে এসেছো। আসে পাশে কেউ কোথাও নেই, শুধু বিশাল বিশাল পাহাড় ক্ষয়ে গিয়ে অদ্ভুত সব মূর্তির রূপ ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে, সন্ধ্যে বেলা একা বেরোলেই গা ছমছম করতো। 

সেই বছর সামারে আমরা আরও একটু ভেতর দিকে একটা হোটেলে উঠলাম, উদ্দেশ্য "ভ্যালি অফ গডস্" দেখতে যাবো। হোটেল থেকে হাঁটা পথ, দুপুরে লাঞ্চ সেরেই আমরা হাঁটা দিলাম, যখন সেখানটায় পৌঁছলাম, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো, বিশাল এক উপত্যকা, তার চার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অপূর্ব সব মূর্তি, জলবায়ুগত কারণে পাথর ক্ষয়ে গিয়ে সেগুলি তৈরী হয়েছে, কোনোটা যেন এক সুন্দরী মহিলা বাথটবে চান করছেন, কোনোটা সাত জন নাবিকের প্রোফাইল, কোথাও মা ও সন্তান ইত্যাদি । চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা এমন নিখুঁত সে সব মূর্তি। বলা হয় মধ্য রাতে ভগবান নেমে আসেন ওই উপত্যকায়। ঘুরতে ঘুরতে আমাদের একটু দেরী হয়ে গেলো, সূর্যের অস্তরাগে রেঙে উঠলো গোটা পাহাড়, এমন সময় নামতে গিয়ে দিদির পায়ে একটা মসৃণ পাথর গড়িয়ে এসে পড়লো, দিদি পা দিয়ে ওতে একবার ঠ্যালা মারলো, তারপর কি ভেবে সেটা প্যান্টের পকেটে পুরে নিলো। 

হোটেল রুমে রাতে বাথরুম যেতে হলে ঘরের ভেতরের করিডোর দিয়ে একটু এগিয়ে পিসীদের বেডরুমের পাশ দিয়ে যেতে হয়, পাশের ঘরে মা বাবা, এঘরে আমি দিদির সঙ্গে। দিদির ভয়ার্ত চীৎকারে ঘুম ভেঙে উঠে বসি, পিসেমশাই ছুটে আসেন, দিদি কাঁদতে কাঁদতে যা বলে তা হলো, ও পিসীদের ঘরটা সবে পেরিয়েছে, আলো জ্বালাতে যাবে, হঠাৎ বাথরুম থেকেই সাঁ করে একটা ফর্সা মেয়ে সাদা গাউন পরা, মুখটা প্রায় চুলে ঢাকা শুধু চোখ দুটো অসম্ভব জ্বলজ্বল করছে, হাওয়ায়  ভাসতে ভাসতে দিদির কাছে এসে অসম্ভব ভাঙ্গা, ঘড়ঘড়ে আর খোনা গলায় বলে,

আমার বল টা তুই নিয়েছিস কেন? দে় শিগগীরই.... 

দিদির আর্তনাদে পিসেমশাই বেরিয়ে আসেন, ওমনি মেয়েটা বাথরুমের ওপরে শার্শি দিয়ে যেন উড়েই বেরিয়ে যায়, দিদি এই অবধি বলে অজ্ঞান হয়ে যায়।" 

" উফ্, তুমি পারোও বটে গল্প বানাতে," 

হো হো করে হাসতে হাসতে রিক বলে।
এই সময় লুসিও বেরিয়ে আসে, বার্বিকিউ এর গন্ধে তার খিদে পেয়ে গেছে। 
গল্প অসম্পূর্ণ রেখে ডিনার লাগিয়ে দেয় জর্জিন। 

রাতে তিনজনই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক  শুনতে শুনতে নরম কম্বলের ওমে ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়। 

পরদিন ওরা নতুন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, ফেরার সময় ইয়েসোমিতির অন্য দিকটা দিয়ে বেরোয়, সেটা আবার "ওল্ড টাউন বোডি" র গা ঘেঁসে চলে গেছে। ওরা গাড়ি নিয়ে ওল্ড টাউনটা এক চক্কর বাইরে থেকে ঘুরে নিলো, ঠিক হলো পরে আসবে, গোল্ডরাশের সময় এই খানে কিছু খনি থেকে সোনা পাওয়া যেতো বলেই গোটা একটি শহর গড়ে উঠেছিল এখানেই, আজ সবটাই ধ্বংসস্তূপ, সরকার সেটিকে সুন্দর ভাবে সংরক্ষণ করছেন। এখানে এসে হঠাৎ কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলো লুসি। তারপর বললো,
"বাথরুম যাবো।" 

"গাড়িতেই যা না!"
জর্জি়ন একটু অবাক হয়েই বললো। 

লুসি একটু জোর দিয়েই বললো,
" আই নীড সাম ফ্রেশ এয়ার।" 

ভিজিটর সেন্টারের পাশেই বাথরুম, ফিরে এলো লুসি, কিন্তু কেমন অন্যরকম মুখ চোখ, অতলে তলিয়ে আছে। তারপর পুরো রাস্তা গুমগাম, সেই থেকেই শুরু। একটু একটু করে পাল্টাতে থাকে লুসি। 

জর্জি়নই প্রথম লক্ষ্য করে লুসির পরিবর্তনটা, ভাবে নতুন জায়গা তাই হয়তো মন খারাপ। কিন্তু মায়ের মন তো, কি যেন "কু" গায়। সন্ধ্যে হলেই লুসি একটু চঞ্চল হয়ে যায়, ড্রেসিং টেবিল এ বসে চড়া মেকাপ করে, পার্টিতে যাবার মত ড্রেস পরে, দরজা বন্ধ করে গুনগুন করে গান গায়। মা ভাবে মেয়ে একা থাকে তাই ইমাজিনারি ফ্রেন্ড বানিয়েছে হয়তো! ডিনার করতে আসে দু চোখে ধ্যাবড়া কাজল লাগিয়ে। 

"আর একটা রুটি দি তোকে?" 

মার প্রশ্নের উত্তরে কেমন ঘাড়টা টিয়া পাখীর মত অদ্ভূত ভাবে বেঁকিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, বুকের ভেতর শিরশির করে জর্জিনের, এ কে? লুসি তো এরকম করে তাকায় না! 

রিক কে কিছু বলা যায়না, হেসেই উড়িয়ে দেবে, তাই মাস তিনেক পর জর্জিনই ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়, উনি খাওয়া দাওয়া আর এক্সারসাইজ ঠিক মতো করতে বলেন, আর বেশী অস্বাভাবিকতা দেখলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলেন, ডিপ্রেশন হলে মুশকিল। 

এরপর মেয়েকে চোখে চোখে রাখে 
জর্জিন। স্কুল থেকে কোনো রিপোর্ট আসেনা, সারাদিন মেয়ে ঠিক থাকে শুধু একটু ঝিমুনি ভাব আর সন্ধ্যে হলেই চনমনে, অন্যরকম। অবস্থাটা চরম পর্যায়ে পৌঁছলো লুসির পনেরো বছরের মাথায়। সন্ধ্যেবেলা একটু বাজার হাট করতে গেছিলো জর্জিন, বাড়ি এসে দেখে মেয়ের ঘরের দরজা বন্ধ, হাল্কা নীল আলো জ্বলছে, ও দরজা আলতো চাপ দিতেই যা দেখলো তাতে অজ্ঞান হয়ে যাবার উপক্রম, কিন্তু সে শক্ত মেয়ে আর এই ধরণের অভিজ্ঞতা তার আগেও হয়েছে,ছোটবেলায়। 

ঘরের ভেতর একটি লেসের স্কার্ট আর স্লিভলেস টপ, ঝোলা দুল, উগ্র মেকাপ এ লুসি, পেছন থেকেই দেখতে পাচ্ছে জর্জিন যে লুসি ওর ড্রেসারের আয়নার সামনেই সাজছে, কিন্তু অবাক কান্ড, আয়নায় তার প্রতিবিম্ব নেই, পড়ে যেতে যেতে 
দরজার লক টা ধরে সামলে যায় জর্জিন, আর তাতেই যে খুট করে আওয়াজ হয় সেটাতে লুসি খুব ধীরে ধীরে দরজার দিকে ঘোরে, তারপর এক পা এক পা করে জর্জিনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, সভয়ে জর্জিন লক্ষ্য করে স্কার্টের নীচে সাদা সুডৌল পা, কিন্তু পায়ের পাতা দুটো পেছন দিকে, সামনে গোড়ালি। মনে সমস্ত শক্তি জড়ো করে গলায় ক্রস টা চেপে ধরে চীৎকার করে জর্জিন, 

"কে তুমি, কেন এসেছো আমার মেয়ের কাছে? বেরিয়ে যাও!" 

লুসির চোখ দুটোর রং পাল্টায়, সবুজ, নীল তারপর সম্পূর্ণ সাদা হয়ে যায়, এমন কি মণিটাও। জর্জিন ধপ করে পড়ে যায়। পরে রিক বাড়ি এসে মেয়ে, বউ দুজনকেই অজ্ঞান অবস্থায় আবিষ্কার করে। 

জর্জিন জানে রিক কে এসব বলে লাভ নেই, উড়িয়ে দেবে। সকালে লুসিও সব ভুলে গেছে, যেন কিছুই হয়নি। তবে শরীর আরও দুর্বল, সান্ধ্য সাজগোজ আরও উগ্র।   ওদের প্রতিবেশীর ছেলে ব্র্যান্ডন সবে কলেজে ঢুকেছে,অ্যান্থ্রোপলজি নিয়ে পড়ছে।  স্কুল থেকে আসার পথে ওকে দেখেই লুসি কেমন যেন হয়ে গেলো। 
"হাই, আমাদের বাড়ি কবে আসবে?" 

"সাম ডে, এই তো সবে এলাম আমরা।"
ব্র্যান্ডন বলে। 

সন্ধ্যেবেলা আরও ছটফটানি বাড়ে মেয়েটার। কিন্তু জর্জিন আর ওকে একা রাখেনা। সারাক্ষণ ছায়ার মত লেগে থাকে। এছাড়া সবসময় ওর ঘরে একটা সিনামন ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে রেখে দেয়, ঘরের এক কোণে লুকিয়ে একটা ক্রস ও। এরমধ্যে জর্জিন ওদের ট্রাইবের যিনি এই সমস্ত আত্মা নিয়ে কাজ করেন সেই অ|ন্টি এলু কে ফোন করে সব বিস্তারিত জানায়। ওনার বয়স এখন পঁচাত্তর, খুব একটা কোথাও যান 

না, কিন্তু লুসির কথা জেনে উনি একবার ওকে দেখতে চাইলেন। উনি থাকেন অ্যারিজোনার মরুভূমির মাঝে, শোনা যায় আত্মাদের সঙ্গে সোজাসুজি যোগাযোগ আছে ওনার । 

রিক কে বলা হয়েছে যে উনি কিছুদিন তাদের বাড়ি থাকবেন, স্নো ফল দেখবেন, খ্রীস্টমাস টা একসঙ্গে কাটানো যাবে। এবার ঠিক যেদিন উনি বাড়িতে পা রাখলেন, লুসি ছটফট করতে শুরু করলো। আর এলু আন্টির মুখের রেখাগুলো আরো দৃঢ় হলো। এমনিতেই ওনার সারা মুখে উল্কি, আর কানে গলায় অদ্ভুত হাড়ের গয়না, একটা হাতের কব্জিতে কোনো একটা পাথরের মালা তিন পাক জড়ানো, দেখলেই মনে একটা ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়। উনি এসে নানা প্রশ্ন করলেন জর্জিনকে, কবে থেকে এই রকম আচরণ শুরু হয়েছে লুসির, এখানে প্রথম আসার সময় রাস্তায় তারা কোথায় কোথায় গেছিল ইত্যাদি। 

অনেক ভেবে চিনতে জর্জিনের হঠাৎ মনে হলো এখানে আসার পথে মেয়েটা একমাত্র একা গেছিলো সেই "বোডি টাউনে", বাথরুমে, শুনেই ভুরুটা কুঁচকে গেল আন্টির। 

"জায়গাটা সম্বন্ধে একটু বলো আমাকে।" 

ডাকা হোলো ব্র্যান্ডন কে, সে গুগল  খুলে ফেললো। একটা ঘরে জর্জিন, আন্টি আর ব্র্যান্ডন, যা জানলো,পড়লো তাতে তিনজনের চোখ বিস্ফারিত!

এই বোডি কে বলা হয় "ঘোস্ট টাউন", ভূতেরা বাস করে বলে নয়, এটি মৃত শহর বলে, কিন্তু এর ইতিহাস অত্যন্ত রোমহর্ষক। সোনার খনির বাড়বাড়ন্ত বলে এখানে যেমন একটি উন্নত শহর গড়ে উঠেছিলো তেমনি রাতারাতি বেশ কিছু গ্যাং বা দুষ্কৃতীর ঘাঁটি ও ছিলো এটা। ধনসম্পদ এলেই সেখানে জুয়া, নেশা ও আদিম বৃত্তির উপদ্রব ঘটবেই। অভিজাত পল্লীর পাশেই ছিলো শুঁড়ী খানা ও গণিকালয়, সন্ধ্যে হলেই পুরুষেরা জুড়ি গাড়ি নিয়ে হাজির হতেন, মদ্যপানের পর পছন্দ মতো নারী বেছে নিয়ে আদিম লীলায় মেতে উঠতেন। কিন্তু প্রায়শঃই এই নারী নিয়ে বিবাদেই বিভিন্ন গ্যাংয়ের মধ্যে লড়াই লেগেই থাকত, প্রতিদিনই একটা না একটা লাশ পাওয়া যেতো ওই অঞ্চলে। ভোরবেলা চা খেতে এসে নাগরিকরা আলোচনা করতো,
"আজ ব্রেকফাস্ট এ কি মেনু?"
অর্থাৎ, আজ কজন খুন হলো? দিনে দিনে এই অঞ্চল কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলো। 

সবটা জেনে আন্টি‌ নিশ্চিত যে বোডির কোনো অভিশপ্ত মোহিনী লুসির দেহে, এবার সুযোগের অপেক্ষা। সেই রাতেই তিনি লুসির ঘরে প্ল্যান মাফিক ব্র্যান্ডন কে পাঠালেন টোপ হিসেবে, একটু ঝুঁকি নিয়েই। রিক ডিনারের জন্য স্যালাড কাটছে, ব্র্যান্ডন আজ এখানে খাবে। আন্টি হাতে একটা কাঠের বড় ক্রস আর মন্ত্রপূত কিছু পাথরের গুঁড়ো নিয়ে দরজার ফুটোয় চোখ রেখে ঘরের আবছা আলোয় দেখেন তাঁর সন্দেহই সত্যি, বহুযুগ পর অশরীরী আত্মা তার শিকার পেয়ে গেছে ... লুসি উন্মত্ত, ঘড় ঘড় আওয়াজ করছে, ব্র্যান্ডন কে এক হাতে জাপটে ধরেছে আর ব্র্যান্ডনের পেছন দিকের অন্য হাতটা ওয়াইন গ্লাস নিতে এগোচ্ছে, এগোচ্ছে তো এগোচ্ছেই .... সেই হাত মানুষের নয় ... অশরীরী আত্মার, অস্বাভাবিক লম্বা ও নীল শিরায় ভরা! একমূহুর্তও দেরী না করে আন্টি ক্রস নিয়ে মন্ত্র বলতে বলতে ও গুঁড়ো ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে গেলেন, মেয়ে তখন ঘাড়টা সামনে ঝুঁকিয়ে এলিয়ে পড়লো। ওর কাছে গিয়ে ক্রসটা কপালের মাঝে স্পর্শ করিয়ে দিতেই লুসির দেহ প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেলো। 

সারারাত এলু আন্টি কোনো হতভাগিনী পিশাচিনীর অতৃপ্ত আত্মার সদগতির জন্য মন্ত্র পড়ে চললেন, ব্র্যান্ডন দুর্বল, মূর্ছিতা লুসির হাত ধরে বসে রইলো।

অন্য ঘরে রিক বাকরুদ্ধ, জর্জিন আলতো করে স্বামীর পিঠে হাত রাখে।

1 Response

  1. Mousumi Mukhopadhyay says:

    বাঃ! ক্ল‍্যাসিক‍্যাল ভৌতিক গল্প। পুরোনো ছোঁয়া লাগা। খুব ভালো লাগল।

বৈশাখী ২০২৪