আতঙ্ক

রাজগঞ্জ, পূর্ব বর্ধমান

রডোডেনড্রন গেস্ট হাউস থেকে হিমালয়ের বরফঢাকা শিখরগুলোকে দেখা যায়। সস্তার এই গেস্টহাউসে পর্যটকরা দু’চারদিন কাটিয়ে যায়। গেস্টহাউসের মালিক শ্যাম কাইত ব্যবসাপত্র দেখাশুনার জন্য পরিবার নিয়ে এই গেস্টহাউসেই থাকেন। কিন্তু শীতের হাওয়া যেই শুরু হয়, অমনি শ্যাম কাইত তাঁর বৌ, মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে গ্রামে চলে যায় তাঁর নিজের বাড়িতে। শীত বাড়তেই গোটা উপত্যকাটা আস্তে আস্তে বরফে ঢেকে যায়। ওই সময় গেস্টহাউসের দেখাশোনা করেন কেয়ারটেকার জয়রাম ঠাকুর আর তাঁর কুকুর লিও। শীতের সময় এতদিন একা একা পাহারাদিলেও এ বছর জয়রামের সঙ্গে অনিল আছে। জয়রামের উপর চাপ পড়ে যাচ্ছিল বলে অনিলকে এ বছরই কাজে রেখেছেন শ্যাম কাইত। এরমধ্যেই বরফ জমতে শুরু করেছে চারিদিকে। সামনের দিকে তাকালে একটার পর একটা সাদা ধবধবে পাহাড়াচূড়া মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। নিজদের কথা ছাড়া কোথাও কোন শব্দ নেই। অসীম-অনন্ত এক সর্বগ্রাসী নৈশব্দ যেন গিলে ফেলেছে সারা চরাচর।

জয়রামের সঙ্গী অনিল সাউ অল্পবয়সী যুবক, জাতে বিহারী, লম্বা ছিপছিপে চেহারা। শ্যাম কাইত উপত্যকায় শীতে কিভাবে থাকতে হয়, সে ব্যাপারে অনিলকে বোঝাচ্ছিল। অনিলকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। বোঝা যাচ্ছিল শ্যামের কোন কথাই অনিলের কানে ঢুকছিল না। 
পাহাড়ের ঢালে এসে শ্যাম কাইতের পরিবারকে বিদায় জানালেন ওরা। পাহাড়ের এই ঢাল বেয়ে সোজা নেমে গেলে পাদদেশে থোরাং গ্রাম, শীতকাল এখানেই থাকেন শ্যাম তাঁর পরিবার নিয়ে। উপর থেকে ছোট ছোট বিন্দুর মতো মনে হয় নিচের বাড়িগুলোকে।
শ্যাম কাইত বললেন, “তাহলে চলি এবার, শীতের শেষে আবার দেখা হবে। ততদিন সাবধানে থেকে, ভয় পেও না”।
“ ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন”। উত্তর দিল জয়রাম। 

আস্তে আস্তে নামতে শুরু করলেন শ্যামেরা। প্রথম বাঁকটা পেরোতেই ওদের আর দেখা গেল না। জয়রাম আর অনিল গেস্ট হাউসে ফিরে এল। এখন তিন মাস শুধু ওরা দু’জনে, এখানে আর কোন মানুষের দেখা পাওয়া যাবে না। জয়রামের অবশ্য এসব অভ্যাস আছে। পনের বছর ধরে এই কাজই করে আসছে ও। গেস্ট হাউসে পোঁছে শীতে এখানে কাটানোর অভিজ্ঞতার গল্পই করছিল অনিলের কাছে। জয়রামের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল অনিল। লিও বসেছিল ওদের পায়ের কাছে। সামনের খোলা জানলা দিয়ে পাহাড়টা অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। কথা শেষ করে উঠে পড়ল জয়রাম। অনিলকে বলল রাতের খাবার তৈরি করতে হবে। তুমি সবজীগুলো কাটো। আমি রান্নাটা দেখছি। 
রাত আটটা নাগাদ রান্না শেষ করে দু’জনে তাস খেলতে বসল। রাত দশটা পর্যন্ত তাস খেলে খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়ল। পরের কয়েকদিন একইভাবে কেটে গেল। এদিকে শীত বাড়ছে। পাহাড় চূড়ায় বরফ জমতে শুরু করেছে। সন্ধ্যাবেলা রান্নাবান্না করে দু’জনে তাস খেলে, গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দেয়। 

সকাল সকাল উঠা জয়রামের অভ্যেস। অনিল একটু দেরি করে উঠে। একদিন ভোরবেলায় অনিলকে ডেকে তুলল জয়রাম। সকালের পরিবেশ দেখে অবাক হয়ে গেল অনিল। চলমান এক সাদা মেঘের স্তর চারপাশ ঢেকে ফেলেছে। নিঃশব্দে, ধীরগতিতে এগিয়ে আসছে সেই মেঘের স্তর ক্রমশই ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে। ভয় পেয়ে গেল অনিল। শীতটা কিভাবে গেস্ট হাউসে কাটাবে ভেবে পাচ্ছিল না ও। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল তুষারপাত। টানা পাঁচদিন ধরে তুষারপাত চলল। পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল সেই তুষার। শুরু হয়ে গেল বন্দিজীবন। চারপাশের পৃথিবী থেকে বিছিন্ন হয়ে গেল রডোডেনড্রন গেস্ট হাউস। 





বাইরে বেরোন যাচ্ছিল না অগত্যা ঘরেই সময় কাটানোর জন্য নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিল ওরা দু’জনে। ঘর পরিষ্কারের দায়িত্ব নিল অনিল। জ্বালানি কাঠও অনিল কাটত। জয়রাম রান্না করত আর ঘর গরম রাখার জন্য আগুন জ্বালিয়ে রাখত। যেহেতু দু’জনেই শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিল তাই কখনও ওদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয়নি। 

জয়রাম ভালো শিকারি ছিল। এই সময় মাঝে মাঝে ও শিকারে বেড়ত। শিকার করার জন্য ওর  কাঠের তৈরি একটা অস্ত্র ছিল। ভাড়ি কাঠের তৈরি মুখটা ছুঁচাল করে কাটা ওই অস্ত্রটা নিখুঁত নিশানায় ছুড়তে পারত জয়রাম। আর পাখি শিকার করার জন্য একটা এয়ার গানও ছিল। যেদিন শিকার হত সেদিন রাতে বেশ সুস্বাদু ভোজন হতো ওদের দুজনের। জিভটাও একটু অন্যরকমের স্বাদ পেত। 
একদিন খুব ভোর বেলায় শিকার বেরিয়ে গেল জয়রাম। অনিল সেদিন একটু বেলা করেই উঠল। উঠে দেখল বেলা বারোটা বেজে গেছে। অল্প কিছু খাওয়াদাওয়া করে লিওর সাথে কিছুক্ষণ খেলা করল অনিল। একা একা সময় আর কাটতে চাইছিল না। শিকারে গেলে জয়রামের ফিরতে প্রায় বিকেল হয়ে যায়। তাই সারাদিনটা প্রায় একাই কাটাতে হয় অনিলকে। 

শ্যাম কাইতরা চলে যাওয়ার পর এক মাস কেটে গেছে। উপত্যাকাটা প্রায় জনশূন্য। এক এক সময় হাঁপিয়ে উঠে অনিল। পুরো শীতটা এখানে কাটাতে হবে ভেবে আতকে উঠে ও। আজ একবার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বেরতে। মাসখানেকের বন্দীজীবনকে বিদাই জানিয়ে বেরিয়ে পরল অনিল। কিন্তু যাবেই বা কোথায়? যেদিকে তাকায় শুধু বরফ আর বরফ। ইতঃস্তত খানিকক্ষণ ঘুরল অনিল। বিষন্ন হয়ে গেল মনটা। মনে মনে ভাবছিল জয়রাম এদিকটায় এলে দেখা হয়ে যেত ওদের। সূর্য ক্রমশ ডুবছে। শুকনো ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করে বরফের উপর দিয়ে। শীতে গা-টা শিরশির করে উঠল অনিলের। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল দিনের আলো কমে আসছে। জয়রামের নাম ধরে বেশ কয়েকবার চেঁচিয়ে ডাকল অনিল। আশেপাশের পাহাড় চূড়াগুলোয় ধাক্কা খেতে খেতে প্রতিধ্বনিত হতে হতে সেই শব্দ ক্রমশঃ মিলিয়ে গেল। কোন উত্তর পেল না অনিল। অগত্যা রডোডেনড্রন গেস্ট হাউস দিকে হাঁটতে শুরু করল ও। 

সূর্য পাহাড়চূড়ার আড়ালে চলে গেছে। ধুসর ছায়াচ্ছন্ন একটা স্তর চারাপাশটাকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে ফেলছে। অনিলের প্রচন্ড ভয় করছিল। এই নৈশঃব্দ, এই প্রচন্ড ঠাণ্ডা, এই নিঃসঙ্গতা যেন ক্রমেই আচ্ছন্ন করে ফেলছিল ওকে। মনে হচ্ছিল ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে শরীরের রক্ত, হাত-পা গুলো অসাড় হয়ে আসছে। স্থানু হয়ে যাচ্ছে ও। ভয়ে প্রাণপণে দৌড়তে লাগল অনিল। দূর থেকে গেস্ট হাউসটাকে দেখতে পেল ও। কিন্তু বাড়ির ভেতর থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে না তো! তাহলে কি জয়রাম বাড়ি ফেরে নি। গেস্ট হাউসে পৌঁছাতেই লিও লাফিয়ে এসে অনিলকে স্বাগত জানাল। কিন্তু জয়রামের কোন চিহ্ন নেই। 

এবার জয়রামের জন্য চিন্তা হচ্ছিল অনিলের। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আগুন জ্বালিয়ে খাবারটা গরম করল অনিল। তারপর কিছুটা খাবার খেয়ে বাকিটা জয়রামের জন্য রেখে দিল। রাত নেমে এল। পাহাড়চূড়ার সাদা বরফের উপর চাঁদের আলো পড়ে একটা অপার্থিব, মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি হল তারপর চাঁদও লুকিয়ে পড়ল পাহাড়চূড়ার পিছনে। জয়রাম ফিরল না। 

অনিল ভেবে পেল না কি করবে। তাহলে কি জয়রাম কোন দুর্ঘটনার কবলে পড়ল? অসুস্থ হয়ে পড়ল কোথাও? এই তীব্র হার কাঁপানো শীতে, বরফের উপর সারারাত পড়ে থাকলে কি হবে? চেঁচালেও কেউ শুনতে পাবে না। ফলে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। মাইলের পর মাইল জনশূন্য। শুধু ধূ ধূ করছে বরফ। এই অবস্থায় পাহাড়ের প্রতিটি ধাপ বিপজ্জনক। একার পক্ষে কোন হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খোঁজা সম্ভব নয়। আর কাকেই বা অনিল সঙ্গে নেবে সমগ্র এলাকা ফাঁকা। তাছাড়া ও নতুন এসেছে, এলাকাটাও ওর অপরিচিতি। সব জায়গা ও চেনে না। তবু অনিল ঠিক করল রাত দশটা পর্যন্ত ও অপেক্ষা করবে। যদি তার মধ্যে জয়রাম না আসে, তাহলে লিও’কে সঙ্গে নিয়ে ও জয়রামকে খুঁজতে বেরোবে। তাতে যা হয় হবে। 

ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলল। রাত দশটা বাজল। জয়রাম এল না। অগত্যা বেরিয়ে পড়ল অনিল। কোনদিকে যাবে জানা নেই। ডানদিক ধরে এগোতে লাগল অনিল। হাতে একটা লাঠি। প্রায় চার ঘন্টা হেঁটে একটা পাহাড়ের চূড়ায় পোঁছল ওরা। এখানেই শিকার করতে প্রায়ই আসে জয়রাম। চারিদিকে খোঁজ করেও জয়রামে দেখা পেল না। রাত প্রায় চারটে বাজে। এতোটা পথ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ওরা। সেখানেই সূর্য ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ধীরে ধীরে আকাশটা পরিষ্কার  হতে শুরু করল। আচমকা পাহাড়চূড়ার পেছন থেকে লাফিয়ে উঠে পড়ল সূর্যটা। আবার জয়রামকে খুঁজতে শুরু করল অনিল। লিও ও বরফ শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে চলল। 

চারিদিকে সতর্ক নজর রাখছিল অনিল। মাঝে মাঝেই উচ্চঃস্বরে জয়রামের নাম ধরে হাঁক দিচ্ছিল। একবার মনে হল পিছন দিক থেকে জয়রামের যেন সাড়া দিল। তড়িঘড়ি দৌড়ে গেল সেদিকে কিন্তু কিছু চোখে পড়ল না। খুঁজতে খুঁজতে দিনের আলো ফুরিয়ে গিয়ে সন্ধ্যা নেমে এল। বরফের মধ্যে একটা বড় গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে লিওকে নিয়ে কম্বলমুড়ি দিয়ে পড়ে রইল অনিল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাত পা জমে যাচ্ছিল। একটুও ঘুম হল না। সকাল হতেই আবার উঠে পড়ল ওরা। লোহার গরাদের মত ভারি মনে হচ্ছিল পা দু’টো। বুকের ভিতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা। আশে পাশে কোন আওয়াজ শুনলেই বুকটা ধক্‌ করে উঠছিল অনিলের। 

আচমকা নিজেকে অসাড় মনে হচ্ছিল অনিলের। একটা মৃত্যুভয় পেয়ে বসেছিল ওকে। এই জনমানবহীন অঞ্চলে কেউ তাকে বাঁচাতে আসবে না ভেবে আরও কুঁকড়ে গেল অনিল। নির্মম মৃত্যুর চিন্তায় জয়রামকে খোঁজার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল ও। এবার গেস্ট হাউসে ফিরতে পারলে  বাঁচে। লিওর একটা পা ঠাণ্ডায় অকেজো হয়ে গেছে। অবশেষে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দুজনে মিলে বিকেল পাঁচটা নাগাদ ফিরে এল গেস্ট হাউসে। 

ক্লান্তিতে শরীর আর বইছিল না। বাড়িতে ফিরে শুয়ে পড়ল অনিল। খুব তাড়াতাড়ি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। উঠল যখন, তখন রাত প্রায় বারোটা। ঠিক সেই সময় বাইরে কে যেন ডাকল, “অনিল”। 

চমকে উথে বসল অনিল, কে ডাকল? কান খাড়া করে রইল অনিল। 

আবার ভেসে এল সেই তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর, “অনিল”। ওই তো জয়রাম ফিরে এসেছে। লাফিয়ে উঠে দরজা খুলে দিল অনিল। চিৎকার করে বলল, “জয়রাম, জয়রাম”। কোন উত্তর নেই । বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল। শীতল বাতাস ছুরির মত স্পর্শ করছিল শরীরে। অনিলের মনে হচ্ছিল ওর মৃত্যু অবধারিত। এই পরিবেশে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।  

ভয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি এঁটে দিল অনিল। তারপর ধপ্‌ করে চেয়ারে বসে পড়ল ও। এখন আর তার মনে কোন সন্দেহ নেই যে ঠিক মৃত্যু মুহুর্তেই জয়রামের আত্মা আকুল আহ্বান জানিয়েছে অনিলকে। এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত ও যে চারদিন চার রাত ধরে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছে জয়রাম। মৃত্যু এসেই মুক্তি দিতেই জয়রামের আত্মা ঘুমন্ত অনিলকে ডেকেছে। কিন্তু কেন? শেষ বিদায় জানাতে? না কি এই ক্ষোভ জানাতে যে অনিল ভালো করে খোঁজেনি তাকে? গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল অনিলের। ও যেন অনুভব করতে পারছে যে দেওয়ালের ঠিক ওপাশেই, দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে জয়রামের প্রেতাত্মা। আতঙ্কে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল তার। দৌড়ে পালাতে পারলে সবচেয়ে ভাল হত, কিন্তু দরজা খোলারই সাহস নেই ওর। ও জানে, যতদিন না জয়রামের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হচ্ছে এবং অন্ত্যেষ্টি হচ্ছে, ততদিন তার অতৃপ্ত আত্মা এই গেস্ট হাউসের চারিদিকে ঘুরবে। ঘরের মধ্যে টিমটিম করে একটা মাত্র মোমবাতি জ্বলছে। তার মধ্যেই অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল অনিল। কানটা খাড়া করে রইল যদি সেই ডাক আবার শোন যায়। এক দুঃসহ পরিস্থিতি। সমতল থেকে অনেক উপরে, জনমানবহীন তুষার সমুদ্রে একা ও জীবিত মনুষ। এভাবে থাকা যায়? পালিয়ে যাওয়াই একমাত্র বাঁচার রাস্তা। কিন্তু পালাতে সে পারবে না। সে জানে জয়রামের প্রেতাত্মা তার পথ আগলে দাঁড়াবে। 

আবার সেই ডাক, “অনিল”! তীক্ষ্ণ চিৎকারটা যেন ছুরির ফলার মত বিঁধল তার কানে। এত স্পষ্ট ডাক যে আতঙ্কে দু’হাতে কান ঢেকে ফেলল ও। সেই ডাকে জেগে উঠল কুকুরটাও। একলাফে দরজার কাছে দিয়ে পাল্লার নিচটা শুঁকতে শুঁকতে প্রচণ্ড চিৎকার করে ডাকতে লাগল ও। ভয়ে লিওর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে, লেজটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। ওর পিছনে দাঁড়িয়ে জোরে চেঁচিয়ে উঠল অনিল, “ঢুকবে না। এই ঘর তোমার নয়। তুমি আর জীবিত নেই, মরে গেছ। এই পৃথিবী আর তোমার নয়। নিজের জায়গায় চলে যাও জয়রাম”। 
বারবার দরজার উপর তীব্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল লিও। যেন অদৃশ্য কোন শত্রুর সন্ধান পেয়েছে ও। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আস্তে আস্তে নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল লিও। কিন্তু মাঝেমাঝেই উঠে গিয়ে অস্থিরভাবে দরজার সামনে ঘুরছিল। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর চাপা গর্জন করে উঠছিল লিও। অনিলের তখন আতঙ্কে দিশেহারা অবস্থা। দেরাজ খুলে একবোতল হুইস্কি বের করে ঢকঢক করে খানিকটা খেয়ে নিল ও। শরীরটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। বুকে বলও ফিরে এল খানিকটা। দেহের শক্তিও ফিরে আসছিল উষ্ণ পানীয়ের প্রভাবে। 

পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে হুইস্কির পুরো স্টক শেষ করে ফেলল অনিল। কিন্তু সমস্যা তাতে মিটল না। হুইস্কির প্রভাবে যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ অর্ধ-অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকে সে। প্রভাবটা কমলেই ভয় এবং আতঙ্ক দ্বিগুণ বেগে ফিরে আসে। নিজের অস্তিত্বটাই যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলেছে অনিল। এই নির্জনতায়, এই ভয়াবহ নিঃসঙ্গতায় ওইরকম প্রবল আতঙ্কের মধ্যে বাঁচা যায়? মাথাটাই তাঁর কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, কেমন যেন এক দুঃস্বপ্নের পৃথিবীতে বাস করছে ও। মাঝে মাঝেই অনিল দরজার গায়ে কান রেখে বসে থাকে-কখন ভেসে আসবে ওই ডাক। 

একদিন রাতে মরিয়া হয়ে গেল ও। যথারীতি সেই রক্ত জল করা ডাক- “অনিল”। লাফিয়ে গিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল অনিল। বেরোতেই মুখে ঝোড়ো বাতাসের হিম ঝাপটা। ঠাণ্ডায় অস্থিমজ্জা পর্যন্ত কেঁপে উঠল অনিলের। আবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। কিন্তু প্রবল উত্তেজনায় অনিল খেয়ালও করল না কখন লিও ছুটে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। কাঁপতে কাঁপতে ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ভিতরে ঢুকে আগুনের কাছে গিয়ে একটা জ্বালানি কাঠ দিতেই চমকে উঠল অনিল। কে যেন দেওয়ালের গায়ে আঁচড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে তার চাঁপা গোঙানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ফিরে এল সেই আতঙ্ক, চেঁচিয়ে উঠল ও, “দূর হয়ে যাও জয়রাম। দরজা খুলব না আমি”। 
নিঃসীম বেদনায় কে যেন চিৎকার করে উঠল। আর সেই চিৎকারে নিজের যাবতীয় বোধ-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলল অনিল। আবার বলে উঠল, “চলে যাও এখান থেকে”। ঘরের মধ্যে একটা লুকোনোর জায়গা খুঁজতে লাগল ও। বাইরে তখন ঘন ঘন গোঙনির শব্দটা শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গোটা গেস্ট হাউসটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে কেউ কাঁদছে। দেওয়ালের গায়ে গা ঘষটানোর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আর দেরি না করে ঘরের যত আসবাবপত্র নিয়ে দরজার সামনে ব্যারিকেড তৈরি করল অনিল। বাইরে তখন গোঙানির আওয়াজটা আরো কাতর শোনাচ্ছে। অনিলের আর কথা বলার ক্ষমতা নেই। বসে বসে হাঁপাতে লাগল ও। চোখে এক অস্বাভাবিক দৃষ্টি। 

একটা চোরা আতঙ্ক গ্রাস করেছে অনিলকে। বাইরে এখন আর গোঙানির শব্দটা শোনা যাচ্ছে না। তবে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কেউ ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে। বাইরে থেকে নানা রকমের আওয়াজ ভেসে আসছে অনিলের কানে। কখনো তীক্ষ্ণ চিৎকার, কখনো কাতর আবেদন, কখনো ফিসফিসিয়ে বন্ধুত্বের ডাক। কথা সেই একটাই, “অনিল”। দু’হাতে কান চেপে বসে থাকে অনিল। মাঝে মাঝে পাগলের মত চিৎকার করে ওঠে, নিজের মনেই বিড়বিড় করে। ক্রমশ স্মৃতি যেন ঝাপসা হয়ে আসছে ওর। আগের কথা তেমনভাবে আর মনে পড়ে না। অত ক্লান্তিতে অবশেষে একদিন ঘুমিয়ে পড়ল ও। নিশ্ছিদ্র, আচ্ছন্ন করা ঘুম। পরের দিন যখন জেগে উঠল, তখন মন এবং স্মৃতি দুটোই শূন্য হয়ে গেছে...।

শীত পেরিয়ে গেল। উপত্যাকা এখন আবার প্রাণবন্ত। শ্যাম কাইতের পরিবার আবার গ্রাম থেকে উপড়ে উঠে এল। শ্যাম ও তাঁর স্ত্রী দু’জনের অবাক হচ্ছিল এই ভেবে যে শীত পেরিয়ে যাবার পরও জয়রাম আর অনিল একবার ওদের গ্রামের বাড়ি গেল না। অথচ এর আগে জয়রাম তাঁদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হত। গল্প করত কিভাবে গেস্ট হাউসে শীতকালটা কাটিয়েছে ও। ব্যাপারটা কি? গেস্ট হাউসের সামনে এসে ওরা সবাই চমকে উঠল। বাড়িটার দরজা-জানলা বন্ধ। বাইরে কি একটা প্রাণীর কঙ্কাল পড়ে রয়েছে। শ্যাম কাইত ভালোভাবে পরীক্ষা করল কঙ্কালটা। তারপর বলল, “মনে হচ্ছে লিও মারা গেছে। এটা ওরই কঙ্কাল”।

শ্যাম কাইত জয়রামের নাম ধরে ডাকল কয়েকবার। কোন সাড়া শব্দ পেল না। আচমকা ঘরের ভিতর থেকে জান্তব চিৎকার ভেসে এল। আবার ডাকল শ্যাম এবারে অনিলের নাম ধরে। এবারও সেই চিৎকার। আর অপক্ষা না করে শ্যাম দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে শুরু করল তা সত্বেও কেউ দরজা খুলছে না দেখে দরজাটা ভেঙ্গে ফেলল। দরজার সামনের আসবাবপত্র গুলো সরিয়ে ফেলতেই দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুতদর্শন মানুষ। তার লম্বা চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। দাঁড়ি ছুঁয়েছে বুক। গায়ের জামাকাপড় ছিন্নভিন্ন। চোখ দুটো শিকারি পাখির মতন চকচক করছে। 
প্রথমে শ্যামই তাকে চিনতে পারল, “হে ভগবান, এ তো অনিল”।
গ্রামে নিয়ে গিয়ে অনিলকে ডাক্তার দেখানো হল। শ্যামের আশঙ্কা সত্যি করে ডাক্তার বলল, “অনিল উন্মাদ হয়ে গেছে”।
জয়রামকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। ওর কি হয়েছিল তাও জানা গেল না। অনিলের ঠাঁই হল অ্যাসাইলামে। 

বৈশাখী ২০২৪