উইন্ড চাইম

আসানসোল, পশ্চিম বর্ধমান

সবাই মানা করেছিল। বাবা, মা, মিমি সব্বাই। তাও সুনেত্রা বাড়ি ছেড়ে পথেই নামল। অনীশের হাত সে কিছুতেই ছাড়তে পারবে না। চলে আসার সময়, সে কিচ্ছুটি সঙ্গে নেয়নি। শুধু, ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে নিয়েছিল তার দাদামণির স্মৃতি। একটা উইন্ড চাইম। তিন বছর আগে দার্জিলিং থেকে ফেরার পথে, বাস দুর্ঘটনায় দাদামণি না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিল। ব্যাগটা পাওয়া যায়। একটা প্যাকেটে লেখা ছিল ‘সুনি’। সেটাতে এই উইন্ড চাইমটা ছিল। সেই থেকে সুনেত্রা কখনো এটাকে কাছ ছাড়া করেনি। হাওয়ায় শিউরে উঠলেই সুন্দর জলতরঙ্গের সুর বেজে উঠত চাইমটায়। সুনেত্রার মনে হতো দাদা যেন পাশেই আছে। 

অনীশ ওর জন্য হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। প্রায় শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছালো সুনেত্রা। অনীশ ওকে প্রায় হাত ধরে হিঁচড়ে  গাড়িতে ওঠালো – এতক্ষণে নিশ্চিন্ত!
চোখ পাকালো সুনেত্রা – আসব না ভেবেছিলে নাকি? রেজিস্ট্রি হয়ে যাবার পরেও এতো ভয়?
-       সত্যি টেনশন হচ্ছিল। যদি... মোবাইলটা বাড়িতেই রেখে এসেছ তো?
-       হ্যাঁ। মা বলছিল – যোগাযোগও রাখবি না? কিন্তু তুমি জেদ করলে তাই,... শেষ মুহূর্তে, ওদের ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, জানো? – সুনেত্রা একটু আনমনা হয়ে গেল।
-       পরে নতুন ফোন কিনে দেব তোমায়। 
যাচ্ছি, যাচ্ছি, যাচ্ছি, যাচ্ছি....... বলতে বলতে ট্রেন দুর্গাপুর, আসানসোল পার হয়ে চলে যায়। জানলা দিয়ে দেখা গ্রামের ছবি, ঘরের ধরণ, বদলে যেতে থাকে। মাঠে নিড়ানি দিতে দিতে লাল-হলুদ ছোপ শাড়ি ঘাড় তুলে তাকায়। কোমরে ঘুন্সি বাঁধা তিনটে ছেলে ট্রেনের সাথে টা টা করতে করতে দৌড়ায়। সুনেত্রার মনের ভার কমে। সেও হাত নাড়ে। দিন যায়, রাত নামে। ঘুটঘুটে মাঝরাতে কানপুর সেন্ট্রালে গাড়ি একটু জিরোয়। ঘুম ঘুম চোখে সুনেত্রা অনীশের পিছু পিছু নেমে আসে। প্রায় জনহীন প্ল্যাটফর্মে এই প্রথম তার একটু অস্বস্তি হতে থাকে। কেমন যেন মনে হয় – ঠিক করলাম তো?
-       কষ্ট হচ্ছে? গাড়ি বলা আছে। ঘরে গিয়েই ঘুমিয়ে পড়ো, কেমন? 
অনীশের হাত সুনেত্রার কাঁধ ছোঁয়। আর অমনি সুনেত্রার ক্লান্তি, মন খারাপ, ভয় – সব হুউশ করে ডানা মেলে কোথায় যেন উড়ে চলে যায়। ব্যাকপ্যাকটা পিঠে নিয়ে চঞ্চল পায়ে অনীশের পিছু পিছু চলে।
একটা ছোট জিপ দাঁড়িয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে যে সেলাম করে দাঁড়াল, তাকে ড্রাইভার বলে ভুল হবার কোনো রাস্তা নেই। দামী ডেনিম আর সাদা টিশার্টে ঝলমলে এক যুবক। সুনেত্রা হাসিমুখে হাত তুলে নমস্কার করল। অনীশ হাসল – ড্রাইভারের পোষাক নির্বাচনটা ঠিক হয়নি রে প্রতীক। 
প্রতীক হাসল – তোর বউকে ইমপ্রেস করতে হবে না? 
তারপরেই সুনেত্রার দিকে ফিরে চোখ পাকাল – আমি প্রতীক। দেখ সুনেত্রা, তোমাকে বৌদি ফৌদি ডাকতে পারব না – তা আগেই বলে দিলাম। বরং চাও তো, এই হতভাগা না থাকাকালীন তোমার সঙ্গে প্রেম ট্রেম করতে পারি। বুঝেছ?
-       আরে, আমার ভালোমানুষ বউটাকে প্রথমেই ভড়কে দিস না। এখনই যদি স্টেশনে গিয়ে উল্টো ট্রেন ধরে, তাহলে....
-       তুমি ঘাবড়ে গেলে নাকি, সুনেততারা?
সুনেত্রার মনের মেঘ কেটে গিয়েছিল। তবে গম্ভীর হয়েই উত্তর দিল – প্রেম বুঝলাম, ট্রেম ব্যাপারটা বুঝিনি। তাই ভাবছি।
হাসতে হাসতেই শহর ছাড়িয়ে এক খোলামেলা মাঠ। জিপ থেকে নেমে প্রতীক টুপি খোলার ভঙ্গি করে – জাজমৌয়ের দুর্গে স্বাগতম।
সুনেত্রা স্পষ্টতঃই হকচকিয়ে যায় – এই মাঠে?
অনীশ হেসে ফেলে – প্রত্নতাত্বিক বিভাগে যার কাজ, তার স্থান তো সাইটের কাছেই হবে। তাই না? আমাদের অস্থায়ী অফিসের লাগোয়া দু-কামরার একটা ঘর আছে। আপাতত সেখানেই থাকা। নেহাৎ যদি খুব অসুবিধে হয়, তখন...
সুনেত্রার ক্লান্ত লাগছিল। সে আর কথা বাড়াল না।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে, অবশ্য সুনেত্রার ভালোই লাগল। এসক্যাভেশন সাইট সে আগে দেখেনি। অনীশ তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাচ্ছিল।
একটা আদিবাসী বুড়ি এসে সকালের ঠিকে কাজ করে দিয়ে যায়। সুনেত্রা তার ভাষা বোঝে না। তাই অনীশ থাকতে থাকতেই তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে হয়। তারপর দুজনের কিই বা রান্নাবান্না? সারাদিন মোটামুটি একাই কাটে। মাঝে মাঝে প্রতীক এসে একটু হইচই করে চলে যায়। একদিন কোথা থেকে তার জন্য কিছু ফুলের চারা এনে দিল। সুনেত্রা খুব খুশি হয়েছিল। ওর বাগানের শখ আছে। অনীশ অবশ্য সন্ধ্যার আগেই ফেরে। তারপরের সময়টা ভালোই কাটে। মাঝে মাঝে শহরে যায়। কোনোদিন রেস্তোরায় খাওয়া দাওয়া করে। কোনোদিন সিনেমা দেখে। রাতে ঘুমোবার সময় জানলায় রাখা উইন্ড চাইমটা দোলে। সুনেত্রা কেন জানি সেই সুরে বিষণ্ণতার গন্ধ পায়। সে এভাবে সংসার পেতেছে বলে, দাদামণি কি খুশি হতে পারেনি? তার মন খারাপ করে। সেদিন অনীশ সইয়ের জন্য কিছু কাগজপত্র এনেছিল। পিএফ, গ্র্যাচুইটি, আরো কিসবের নমিনি করবে বলে। আক্কেলবোধহীন লোকটা এমন সময় এসেছিল যখন সুনেত্রার রান্না মাঝপথে। অনীশের কাজ চিরকালই অমনি। হাওয়ায় উইন্ড চাইমটাও প্রবল সোরগোল তুলেছিল তখন। সুনেত্রার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। বকতে বকতে কোনোমতে সই করে দিয়ে দৌড়েছিল সুনেত্রা। ডালটা বোধহয় ধরেই গেল! তারপর রান্না করতে করতে অনীশের অপরাধী মুখটা ভেবে একচোট হাসলো নিজের মনেই। 
**********
বিয়ের পর প্রায় ছমাস কেটে গেছে। সংসারে সুনেত্রার মন বসে যাচ্ছে। ইদানিং তারা সন্ধ্যার পরে এসক্যাভেশন সাইটে ঘুরতে যায়। চাঁদের আলোয় কেল্লা, মাঠ আর গাছপালা মিলে এক অপার্থিব জগত সৃষ্টি করে। কখনো প্রতীকও ওদের সঙ্গ দেয়। সেদিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল সুনেত্রার। চাইমটা পাগলের মতো বাজছে। হাত বাড়িয়ে অনীশকে পেল না। তাকিয়ে দেখল বাথরুমে আলো জ্বলছে। প্রচণ্ড ঘুমে মাথা ভারি হয়ে আছে। তবু কোনোমতে উঠল। চাইমটা বন্ধ করা দরকার। খুলে রাখবে? জানলার কাছে দাঁড়িয়ে চাইমটা হাতে ধরতে না ধরতেই ভীষণ শব্দে তার ঘুম উড়ে গেল। ফ্যানটা ধড়াম করে বালিশের ওপর পড়েছে। দুদিন ধরেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হচ্ছিল। মিস্ত্রির খোঁজ করছিল অনীশ। সুনেত্রা তীব্র আতঙ্কে সেদিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে তার মাথাটা  ওইখানে থাকার কথা। আওয়াজে অনীশ দৌড়ে এসেছে। সুনেত্রা ছুটে গিয়ে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে তখন থরথর করে কাঁপছে।
-       ঘুমোচ্ছিলে না?
 ভাগ্যিস উঠেছিলে এখন। নয়তো কি হতো, বলো দেখি.....
অনীশ দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে এবার।
পরদিন দুপুরবেলায় প্রতীক এল। আগের দিন হেড অফিসে গিয়েছিল। ফেরার সময়, সুনেত্রাদের জন্য মৌরলা মাছ নিয়ে এসেছে। 
-       হ্যাংলা কোথাকার? রাতে খেয়ে যেও। - হাসছিল সুনেত্রা।
-       সে তুমি না বললেও এসে যেতাম। - কফির কাপে প্রতীক একটা আরামের চুমুক দেয়।
-       জানো কাল রাতে কি হয়েছে? খুব বাঁচা বেঁচে গেছি। রাতে ফ্যানটা.....
সব শুনে চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ে প্রতীক - চলো তো দেখি। নতুন ফ্যান আমি নিজের হাতে লাগিয়ে দিয়ে গেছি।
-       অনীশ বলছিল, পাখা ঝোলার নাটটা আলগা হয়ে গিয়েছিল।
-       সে কি? এমন তো হবার কথা নয়!
সুনেত্রা অতো মাথা ঘামাতে রাজি নয়। বলল – ছাড়ো ওসব কথা। দিব্বি বেঁচে আছি, দেখতেই তো পাচ্ছ। 
-       তা যে আছ, সেটা আমার চোদ্দপুরুষের ভাগ্য। নাহলে...
প্রতীকের গলা বুজে আসে। এই আন্তরিক আবেগের সামনে সুনেত্রা একটু অপ্রভিত হয়ে পড়ে। প্রতীক নিজেকে সামলে নেয়।
-       তবে ম্যাডাম, একটা কথা বলি। চাঁদের আলোয় এসক্যাভেশনের গর্তগুলোর কাছে না ঘুরলেই নয়? আলগা মাটি, বিপদ হতে কতক্ষণ?
-       না, আসলে...
কথার মাঝখানেই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে প্রতীক।
-       এতো রোম্যান্টিক না হলেও চলবে। সেদিন অনীশকে বলেছিলাম, তা সে বলল, তোমার জেদাজেদিতেই ও...। তলায় কিছু ধারালো যন্ত্রপাতিও থাকে। পড়লে বাঁচবে কিনা, আর বাঁচলেও কিভাবে বাঁচবে সেটা ভেবে দেখ।
-       কিন্তু আমার তো ভার্টিগো...
ওর কথার মাঝখানেই, গটগটিয়ে উঠে বেরিয়ে যায় প্রতীক, আর যাকে বলে বিস্ময়াহত হয়ে বসে থাকে সুনেত্রা।  ওর বিপদ হতে পারে ভেবেই এতো রাগ? আর কি যেন বলে গেল ছেলেটা? সুনেত্রা জোর করেছে? যাচ্চলে! বরং সেই তো অন্ধকার আর উচ্চতায় ভয় পায়। নেহাৎ অনীশ ঠাট্টা করে, আর জ্যোৎস্নারাতে ঘোরাটা নাকি ওর নেশা – তাই সে বাধ্য হয়ে সঙ্গ দেয়। তাহলে এমন উল্টো কথা বলার মানে কি?
অনীশকে একবার জিজ্ঞেস করবে দেখবে? সারাদিন সুনেত্রার কেমন একটা অস্বস্তি নিয়ে কাটল। বিকেলে অনীশ এলেও ওকে কথাটা কেন জানি জিজ্ঞাসা করতে পারল না। তার মনে পড়ল – একদিন ও যেতে চায়নি বলে অনীশ খুব বিরক্ত হয়েছিল। এই ফ্যানের ঘটনার পর থেকে এমনিতেই ও একটু রেগে আছে। সুনেত্রা ভেবেছিল, ওর জন্য চিন্তায়। সত্যিই কি তাই? বাবার কথাটা কানে বাজে – তুমি ওকে কতটুকু চেন?
অনীশের মুখের দিকে তাকিয়ে সেটাই বোঝার চেষ্টা করে সুনেত্রা। তবে প্রতীক এসে পড়ায়, হইচই, হাসি-গল্পে সব ভার উড়েও যায়। রাতে অনীশের প্রবল আদরে চিন্তার শেষ বাষ্পটুকুও থাকে না। কিন্তু পরদিন আবার একা হতেই তার মাথায় চিন্তারা ভিড় করে আসে। কিছুতেই হিসেব মিলছে না। 
এক - অনীশ প্রতীককে কেন বলল....
দুই - ফ্যান! কিছুদিন আগে অনীশ সব ফ্যান আলো পরিষ্কার করছিল। সেদিনই ওগুলো আরো একবার টাইট করে দিয়েছিল‎। টাইট না আলগা? হঠাৎ এই প্রশ্নটা মাথায় আসতে তার শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে যায়। সেদিন বাথরুমে আলো জ্বলছিল। কিন্তু অনীশ অন্য ঘর থেকে এসেছিল। অন্ধকার ঘরে বসেছিল? কেন? সেদিন অত ঘুম পাচ্ছিল কেন? চাইমটা না বাজলে....
কি যেন বলেছিল অনীশ? “ঘুমোচ্ছিলে না?”
গলাটায় কেমন একটা বিরক্তির আভাস তখনও কানে লেগেছিল। তখন নিজের আতঙ্কে কথাটা খেয়াল হয়নি। কিন্তু এখন... 
অনীশ ওকে অনেক পরে জড়িয়ে ধরেছিল। সেটা কি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া? নেহাৎ চাইমটা.....
আরে! ওটা আরেকদিনও এইভাবে বেজেছিল না? সেই যেদিন, অনীশ ওকে দিয়ে পিএফ ইত্যাদির নমিনিতে সই করিয়ে নেয়? হয়তো ছেলেমানুষি। তবু সুনেত্রা এই সমাপতনটা মিলিয়ে দেখে নিতে চাইল। আজ অনীশদের কর্তাব্যক্তিরা আসবেন। তাই সে দুপুরে খেতে আসবে না। সুবর্ণ সুযোগ! 
দরজা জানলা বন্ধ করে তন্ন তন্ন করে খোঁজে সুনেত্রা। অনেক খুঁজে  টাওয়েল জড়ানো ছোট বাক্সটা পেল। কিন্তু তালা দেওয়া! চাবিটা অনীশের কাছে। ওর বাইকের চাবির সঙ্গে একটা ছোট চাবি থাকে। সুনেত্রা জানতে চাওয়ায় বলেছিল, সুনেত্রার চাইমের মতো এটা তার লাকি চার্ম। আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি সুনেত্রা। মেনে নিয়েছিল। এখন বুঝতে পারছে। সুনেত্রার কান্না পাচ্ছিল। হঠাৎই চাইমটা একবার টুং করে বেজেই থেমে গেল। একটু পরে আর একবার। এভাবে কি চাইম বাজে নাকি? আচমকা একটা কথা ওর মনে হলো। চাইমটাতে ঘন্টার সঙ্গে কয়েকটা আঁকাবাঁকা পিতলের কাঠি আছে না? চাবির মতোই তো দেখতে? 
কয়েকবার চেষ্টার পরে একটা  দিয়ে তালাটা খুলে গেল। সুনেত্রা চেক করছে। এটা পিএফ, এটা মেডিক্যাল ইনসিয়োরেন্স, এটা.... 
লাইফ ইনসিয়োরেন্স? ওর নামে? বেশ মোটা টাকার। কয়েকটা কিস্তি দেওয়া হয়েছে। নমিনি অনীশ মজুমদার! কই, এটার কথা তো ও কিছু জানত না! সেদিন এটাতেও তাহলে ও সই করেছে? নিস্তব্ধ বসে থাকল অনেকক্ষণ। তারপরে দ্রুত হাতে সব গুছিয়ে তোলে আগের মতো করে। ওকে পালাতে হবে। হবেই। কিন্তু কিভাবে? এখান থেকে কারো সাহায্য ছাড়া অনীশের চোখ এড়িয়ে বেরোনো সম্ভব নয়। প্রবল আতঙ্কে সে আবিষ্কার করল, আজ অবধি এক প্রতীক ছাড়া কারো সাথেই সে একলা কথা বলার সুযোগ পায়নি। কিন্তু প্রতীক তো ওর প্রাণের বন্ধু! ভাবতে ভাবতেই বেল বাজে। ক্লান্ত, ভীত পায়ে, সে দরজা খুলে দিল। 
-       সব দরজা জানলা বন্ধ করে কি করছ?
অনীশের চোখে কি সন্দেহ? সুনেত্রা জোর করে হাসি টেনে আনে। 
-       বড্ডো মাথা ধরেছিল। চোখে আলো লেগে ঘুম হচ্ছিল না তাই ...
অনীশ আর কিছু বলল না। সুনেত্রা চা নিয়ে এল।
-       আজ কিছু স্ন্যাকস বানাওনি?
-       বললাম না, খুব মাথা ব্যথা করছে।
-       হুম। বুঝেছি। চলো চা খেয়ে একটু হেঁটে আসি। মাথাব্যথা ছেড়ে যাবে।
-       আজ না। আজ তো চাঁদের আলোও নেই।
-       অন্ধকারে হাওয়া অনেক বেশি আরাম দেবে। ট্রাস্ট মি।
-       আমার ইচ্ছে করছে না।
-       এটা তুমি রোজই বলো। আচ্ছা আজ শেষবারের মতো চলো। আর কোনোদিন বলব না। প্রমিস। তুমি তৈরি হও। আমি স্নানটা সেরে আসি।
“শেষবারের মতো”... “শেষবারের মতো”.... শব্দটা কানের মধ্যে বাজতে থাকে। চাইমটার আওয়াজে কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে। চোখ টান করে দেখল সুনেত্রা। একটুও হাওয়া নেই। চাইমটা নড়ছে না। আওয়াজটা কি ওর মাথার মধ্যে?
অন্ধের মতো অনীশের ফোনটা নিল। বন্যায় কুটো আঁকড়ে ধরার মতো প্রতীককে ফোন করে বলল – প্লিজ এসো। খুব বিপদ। - বলেই কেটে দিল। 
অনীশ দু’মিনিটেই বেরিয়ে এল – এখনো তৈরি হওনি?
-       হচ্ছি। - সুনেত্রা ধীরে ধীরে কাপড় পরে।
চাইমটাকে সঙ্গে নিয়ে নিল। যেন বলতে চাইল - শেষ মুহূর্তে সঙ্গে থেকো। কিন্তু প্রতীক তো এলো না! হতাশায় ওর মন ভরে ওঠে। আর উপায় নেই তাহলে? 
বেড়াতে বেরিয়ে, অনীশ ওর হাত ধরে টিলাটার ওপরে উঠতে থাকে। সুনেত্রা শেষবারের মতো বলে – আজ থাক প্লিজ।
-       বলেছি তো, আজকের পর আর কোনোদিন বলবো না!
ওপরটায় উঠে পড়েছে ওরা। সুনেত্রার হাত থেকে চাইমটা পড়ে গেল। 
-       একটু দেখবে, কোথায় পড়ল? 
নিজেও নিচু হয়ে খুঁজতে থাকে। সে যেন মরিয়া হয়ে সময় কিনতে চাইছে। অনীশ খোঁজার চেষ্টাও করল না। তবে একটু এগিয়ে গেল সুনেত্রার দিকে। 
-       আরে, তোরা ওখানে কি করছিস? ও জায়গাটা আজকেই খোঁড়া হয়েছে।
প্রতীক এসে পড়েছে! সুনেত্রার বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে। অনীশ রীতিমতো চমকে যায়। 
-       তুই? এখন এখানে?
বলতে বলতে দু পা এগিয়ে যেতেই অনীশের পা হড়কাল। চাইমটাতেই পা আটকাল বোধহয়। কারণ ওটা একবার বেজে উঠেই থেমে গেল। একটা হাওয়ার ঘুর্ণি পাক খেয়ে উঠল। ঝুরো মাটিতে টাল সামলাতে পারল না ও। হাওয়ার ধাক্কায় নীচে গড়িয়ে পড়ল। এখানে গর্তটা বেশ গভীর। অনীশের আর্তনাদ ছাপিয়ে চাইমটা বেজে উঠল আরো একবার!
প্রতীক ততক্ষণে ওপরে উঠে এসেছে। সুনেত্রা থরথর করে কাঁপছিল। ‎‎কোনোমতে বলল – অনীশ পড়ে গেছে! 
প্রতীক দ্রুত ফোন করছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলো, লোকজন এসে পড়ে। খাই থেকে অনীশের দেহ তোলা হয়। ওর ঘাড় মটকে গিয়েছিল।
দুয়েক দিন পর সুনেত্রার সঙ্গে প্রতীকের কথা হচ্ছিল।
-       সেদিন, তুমি বলছিলে তোমার ভার্টিগো আছে। তখন ভাবিনি। পরে একটা সন্দেহ হয়েছিল। তারপর, তোমার ফোন পেয়েই দৌড়ে এসেছি। তখন তোমরা অনেকটা এগিয়ে গেছ। টিলার ওপরে অনীশকে দেখে মনে হচ্ছিল, তোমাকে ধাক্কা দিতে যাচ্ছে। পুরোটা বলবে এখন?
সুনেত্রা বলতে শুরু করল। 
প্রতীক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল – অনীশকে আমি বন্ধু ভাবতাম। আমাকেও বোধহয় আর বিশ্বাস করা যায় না। তাই তো?
চাইমে পুরোনো জলতরঙ্গের সুর বেজে উঠল। আনন্দের সুর। সুনেত্রা প্রতীকের দিকে চেয়ে হাসল। সে হাসিতে বিশ্বাস আর নির্ভরতা মাখামাখি – বাড়িতে একটা ফোন করতে পারি?
প্রতীক ফোনটা এগিয়ে দিল। 

4 Responses

  1. Mita ghish says:

    নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়লাম গো!!!বাসরে!!!

  2. Pradip Kumar Biswas says:

    রহস্যের মোড়কে জড়ানো একটি সুন্দর গল্প যেখানে উইন্ড চয়মটা সত্যিই দারুণ ।

  3. Mousumi Mukhopadhyay says:

    খুব সুন্দর লেখা। ভালো লাগল।

বৈশাখী ২০২৪