তুলির টান

গারুলিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা

পারমিতা রাহা হালদার (বিজয়া)	গারুলিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা
 
নীলের ছোট বেলার থেকেই পেইন্টিং এর নেশা। এখন প্রফেশনাল আর্টিস্ট হিসেবে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও।অবশ্য কিছু দিন ধরে ছবি  আঁকতেই নিজের ভাবনা আর তুলির টান মিলাতে পাচ্ছে না। তুলিতে টান দিতেই তুলি যেন ভাবনার অবাধ্য হয়ে অন্য রূপ নিচ্ছে। হাজার চেষ্টাতেও ভাবনা রূপায়িত  হচ্ছে না। অবাক হয় নীল তুলির এক টানেই নিজের ভাবনা যেখানে অনায়াসে সাদা কাগজ রঙিন করে তুলতে পারে এখন সন্তান সম তুলি কেন এতোটা অবাধ্য! ল্যান্ডস্কেপের স্কেচে নিজের অজান্তেই একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে।

বিরক্ত হয়ে নীল একদিন আঁকার সরঞ্জাম গাড়িতে নিয়ে অচেনা পথে চলতে লাগল। একটা জঙ্গলের সামনে আসতেই প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হলে গাড়িটা আর এগিয়ে নেওয়া গেল না। অন্ধকার নেমে এসেছে কোথায় আশ্রয় পাবে এই জঙ্গলে,আশ্রয়ের খোঁজে গাড়ি থেকে নেমে জঙ্গলের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলো। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর দূরে আগুন জ্বলছে দেখতে পেয়ে সেই দিকে এগালো। ওই তো কে যেন তাবুর মধ্যে আগুন পোহাচ্ছে । কাছে যেতেই লোকটা বললো বসুন বাবু ভিজে গেছেন ঠান্ডা লেগে যাবে একটু তাপ নিয়ে নিন সুস্থ বোধ করবেন। লোকটা কথা এমন ভাবে বলছিল মনে হচ্ছিল যেন আগের থেকেই জানতো নীল আসবে। 

অন্ধকার জঙ্গলে এতো বৃষ্টিতে আপনি একা কি করছেন? আপনার চাদরটাও বেশ ভিজে রয়েছে। কথাটা বলে নীল চারিপাশ তাকালো। সামনে একটা কুয়ো আর ঠিক উল্টো দিকে বড়ো একটা বাড়ি, দেখে বেশ পুরনো মনে হচ্ছে । যদিও মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশ চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার ঠিকমতো কিছুই দেখা যাচ্ছেনা । উপায় নেই এই আশ্রয়ে রাত কাটাতে হবে! ভদ্রলোকের উল্টো দিকে বসলো নীল, হাত দুটো আগুনের তাপ নিতে বাড়িয়ে দিল। বেশ কিছু সময় আগেই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে আগুনের তাপে নীলের ভেজা জামা শুকিয়ে গেছে কিন্তু লোকটার চাদর থেকে তখনও অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে দেখে নীল জিজ্ঞাসা করলো আপনার চাদর শুকাচ্ছে না কেন এখানো ভিজেই...! উত্তরে লোকটা হাসলেন।

আচ্ছা এই বাড়িতে কে থাকে আপনিও বা এই জঙ্গলে কেন?

বাবু, এই বাড়ি ডাক্তার কৃষ্ণপ্রসন্নর, খুব ভালো মানুষ। বিয়ের কয়েক বছর পরেও কোন সন্তান হলো না। কৃষ্ণপ্রসন্ন আর ওনার স্ত্রী অনাথালয় থেকে পুত্র দত্তক নিয়ে তাকেই সন্তান রূপে স্নেহ করতেন। এইটা ওনার আউট হাউস। দেশ বিদেশ ঘুরে অনেক অর্থ উপার্জন করলেও এখানে আসতেন এখানকার আশে পাশের গ্রামের দরিদ্র মানুষের সেবা করার জন্য। এই গরীব মানুষ গুলোর কাছে ভগবান ছিলেন।

ডাঃ কৃষ্ণপ্রসন্ন এখন আসেন না এখানে? নীলের প্রশ্ন শুনে লোকটি বলেন পঁচিশ বছর আগে ডাক্তারবাবুর পালিত ছেলে সম্পত্তির লোভে ওনাকে ছুঁড়ে মেরে হত্যা করে এই কুয়োতে ফেলে দেয়। 

অন্ধকার পরিবেশে লোকটার কথায় নীলের গা ছমছম করছিল। লোকটি তখনও কথা বলে যাচ্ছে, আপনার হাতের সরঞ্জাম দেখে মনে হচ্ছে আপনি চিত্রশিল্পী। যেকোনো ছবিই আঁকতে পারেন নিশ্চয়ই? 

হ্যাঁ পারি, আমার নাম নীল আমি চিত্রশিল্পী । যেকোনো ছবি শুধু বিবরণ শুনেই আঁকতে পারি। 

বেশ তাহলে একটা ঘটনা আপনাকে বলি বাবু । কৃষ্ণপ্রসন্ন একবার এই আউট হাউসে আসলে এক ঝড় বৃষ্টির রাতে দরজায় কেউ জোরে জোরে ধাক্কা দেয়। কৃষ্ণপ্রসন্ন গ্রামের কারোর বিপদের আশঙ্কা বুঝতে পেরে ছুটে এসে দরজা খোলে। একজন ভদ্রলোক দরজায় দাঁড়িয়ে, ডাক্তারবাবু কে দেখে পা জড়িয়ে ধরে বলেন আপনি আমার স্ত্রী আর সন্তান কে বাঁচান। আমি অনেক দূর থেকে এসেছি আশা নিয়ে। 

কিন্তু আপনার স্ত্রী সন্তানের কি হয়েছে?
আমার স্ত্রী গর্ভবতী প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে। ঝড় বৃষ্টির রাত আশে পাশে কোন হসপিটাল নেই তাই আপনার কাছে ছুটে এসেছি। আপনি আমাকে দয়াকরে ফেরাবেন না। 

একটু অপেক্ষা করুন আমি তৈরি হয়েই আসছি বলে ডাক্তার বাবু নিজের ডাক্তারি সরঞ্জাম নিয়ে ঐ ভদ্রলোকের সাথে বেরিয়ে পড়লেন। ভদ্রলোক বাইকে চাপিয়ে নিয়ে 
গেলেন, অনেকটা পথ যাওয়ার পর ভদ্রলোকের বাড়িতে পৌছালেন। দেখলেন ভদ্রলোকের স্ত্রী অবচেতন অবস্থায় একাই পড়ে আছে। পরীক্ষা করে বললেন অপারেশন করা ছাড়া উপায় নেই। 

আপনার উপর আমার ভরসা আছে আপনি যেটা ভালো হয় করুন ডাক্তারবাবু। নিরুপায় হয়ে ডাক্তারবাবু রাজি হলেন বাড়িতেই অপারেশন করতে। ভদ্রলোককে সাহায্য করতে বলে তিনি অপারেশন শুরু করলেন আর ডাক্তারবাবুর কথামতো ভদ্রলোক সাহায্য করতে থাকলেন।একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হলো। স্ত্রী আর সন্তানের প্রাণ রক্ষায় ভদ্রলোক ভীষণ খুশি। ডাক্তারবাবু জানালেন আশা করি দুপুরের মধ্যেই আপনার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরবে। 

আপনার এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না ডাক্তারবাবু! আপনাকে যথাযথ প্রাপ্য দেওয়ার মতো টাকা আমার কাছে এই মুহূর্তে নেই। তবু স্মৃতি হিসেবে আমি আপনাকে কিছু দিতে চাই। এইটা আপনি আপনার কাছে রাখবেন এই বলে ভদ্রলোক কিছু দিলেন ডাক্তারবাবুর হাতে। রাতের অন্ধকারে ডাক্তারবাবু বুঝতে পারলেন না উপহার আসলে কি। ভদ্রলোকই 
ডাক্তারবাবু কে বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। ডাক্তারবাবু বললেন আপনার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরলে আমাকে একবার জানাবেন আমি দুশ্চিন্তায় থাকবো। 

দুদিন কেটে গেল ঐ ভদ্রলোক খবর দিতে এলোনা। ডাক্তারবাবু ভাবলেন একটা অপারেশন এতোটা ঝুঁকি নিয়ে করলাম খবর না পাওয়া পর্যন্ত মনের ভিতর টা খচখচ করছে। কথাটা ভেবেই ডাক্তারবাবু নিজেই গেলেন ভদ্রলোকের বাড়িতে। ভদ্রলোকের স্ত্রী দরজা খুললেন, ডাক্তারবাবু ভদ্রলোকের কথা জিজ্ঞাসা করে বললেন উনি আছেন কিনা। ভদ্রলোকের স্ত্রী অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিলেন তার স্বামী ছয় মাস আগেই যুদ্ধে মারা গেছেন। ডাক্তারবাবু চমকে উঠলেন, কি বলছেন!! উনি সেদিন আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। আমি যখন আপনার অপারেশন করি তখন উনি আমাকে সাহায্য করেছেন। হঠাৎ ডাক্তারবাবুর মনে পড়ল উপহারের কথা ব্যস্ততায় সেটা আর দেখা হয়নি পকেটে রয়ে গেছে । উনি পকেট থেকে সেটা বার করে দেখাতে যে দেখলেন ওটা একটা মেডেল। এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতার জন্য তাকে মেডেলটি দিয়ে সন্মান জানান হয়েছে। ভদ্রলোকের স্ত্রী ভীষণ অবাক হয়ে বললেন এই মেডেল টা ওনার ভীষণ প্রিয় আপনি পেলেন কিভাবে। ডাক্তারবাবু ভদ্রলোকের স্ত্রী কে সমস্ত ঘটনা বলে ফিরে এলেন। কিন্তু ভাবলেন এও কিভাবে সম্ভব। একজন মৃত সৈনিক তার পরিবার কে বাঁচাবার জন্য মৃত্যুলোক থেকে ফিরে এসেছেন। সেইদিন থেকে ডাক্তারবাবু চেয়েছিলেন এই বীর সৈন্যের ছবিতে মেডেল টা নিজের হাতে পরিয়ে স্মৃতি আঁকড়ে রাখতে। কিন্তু তার কিছুদিনের মধ্যেই তার ছেলে তাকে খুন করে। ইচ্ছাটা পূরণ হয়না ডাক্তারবাবুর। কিন্তু আপনি তো বিবরণ শুনেই আঁকতে পারেন বললেন। আপনি ছবিটা এঁকে দিলে উপকৃত হব। ডাক্তারবাবু ইচ্ছা পূরণ হবে। 

নীল এক মুহূর্তে রাজি হয়ে গেল ছবি আঁকতে। সামনে বসা লোকটি বিবরণ দিচ্ছে আর নীল শুনে ছবিটা আঁকছে। ছবিটা কমপ্লিট হলে লোকটা ভীষণ খুশি হলো। ছবি আঁকা কমপ্লিট করে নীল লোকটার হাতে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো আপনি ডাক্তারবাবুর কে হন, আর এই সৈন্যটিকে আপনি দেখেন নি তাহলে এতো সুন্দর বিবরণ কিভাবে দিলেন। 

প্রশ্ন শুনে লোকটি বলল আমিই ডক্টর কৃষ্ণপ্রসন্ন । আমাকেই এই কুয়োতে আমার ছেলে ফেলে দেয় তখন থেকে আমি এখানেই থাকি। মেডেল টা ছবিতে পরিয়ে দিল সামনের লোকটা। 

এতক্ষণে ভোরের আলো ফুটে গেছে। আবছা আলোয় নীল হতভম্ব হয়ে দেখছে তার উল্টো দিকে একটা কঙ্কাল গায়ে চুপচুপে ভিজা চাদর লেপ্টে বসে আছে যার মুখটা অন্ধকারে দেখতে পাইনি এতক্ষণ। সামনের বাড়িটা ল্যান্ডস্কেপে ফুটে ওঠা সেই স্কেচ যেটা তার অবাধ্য তুলি এঁকে চলেছিল.....!!

বৈশাখী ২০২৪