প্রতিশোধ

রাজপুর, কলকাতা

নৃসিংহ দত্ত রাতের খাওয়া শেষ করে ব্যলকনিতে এসে ইজি চেয়ারটায় বসলেন। এটা তার বহু দিনের অভ্যাস। বাড়িতে থাকলে রাত্রে খাওয়ার শেষে অন্তত এক ঘন্টা এখানে এই চেয়ারটায় তাঁর বসা চাইই চাই।
স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বালিগঞ্জ প্লেসের এই ছোট দোতলা বাড়িটাতে যখন উঠে আসেন তখন তার বয়েস চৌষট্টি। নিঃসন্তান নৃসিংহ দত্তের নিটক আত্মীয় বলতেও তেমন কেউ নেই। 
পেশায় লেখক নৃসিংহ নিজের কল্পনার জগতে বাঁচতেই পছন্দ করেন। মাঝে মধ্যে লেখার কাজে বা কোন সভা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যখন বাইরে কোথাও যেতে হয় তখন এই বাড়ি পাহারার দায়িত্বে থাকে নরেন। সে এই পাড়াতেই সাত আটটা বাড়ি পরে থাকে। এক সাহিত্য সম্মেলনে তার সাথে আলাপ নৃসিংহের। প্রথম আলাপে বেশ ভালোই লেগেছিল নরেনকে। তারপর ফোনে যোগাযোগ, সেখান থেকে বাড়িতে যাতায়াত। নরেন সদ্য এম.এ পাশ করেছে। তার ইচ্ছা সেও নৃসিংহ স্যারের মতন লেখক হবে। তাই নৃসিংহ দত্তর সাথে লেগে রয়েছে। তার ছোটখাট ফাই-ফরমাশ খেটে দেয় হাসিমুখে। 
এই যেমন কিছুদিন আগেই কয়েকটা রেয়ার বইয়ের হঠাৎ দরকার পড়লো নৃসিংহের। সকালেই নরেনকে জরুরী তলব। আজই এই চারটে বই আনা দরকার! একটা বড় লেখা মাঝপথে আটকে গিয়েছে। বইয়ের সাহায্য ছাড়া আর এগোনো যাচ্ছে না।
নরেন অঝোর বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে ছুটলো কলেজ স্ট্রিট। পুরানো বইয়ের দোকানগুলোয় ঘুরে ঘুরে ঠিক জোগার করে নিয়ে এলো সন্ধ্যাবেলা। তখন সর্দিতে তার নাক প্রায় বন্ধ হওয়ার অবস্থা। মাথায় কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে একনাগাড়ে। তাও হাসি মুখে দড়জায় বেল বাজিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। 
নৃসিংহ বোঝেন ব্যপারটা। তিনি বেশ মজাই পান। তাকে তেল দেওয়ার লোকের অভাব নেই। নিজের কলমের জোরেই আজ সেই জায়গা তিনি করে নিয়েছেন। কিন্তু নরেনের উপর এই ধরনের অত্যাচার করে তিনি আত্মতৃপ্তি পান একরকম।
সম্প্রতি প্রায় একই সাথে তিনটে বড় লেখা শেষ করেছেন নৃসিংহ। লেখার বিষয় একদম গোপন রেখেছেন। চমকে দেবেন সকলকে। তার লেখা পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকে পাঠককুল। প্রায়ই বিভিন্ন মাধ্যমে সবাই জানতে চায়, তিনি নতুন কি লিখছেন, কবে তার নতুন বই সামনে আসছে ইত্যাদি। কাজ শেষ, প্রকাশকদের সাথে কথা বলা শুধু বাকি আছে। তাই এখন মেজাজ বেশ ফুরফুরে। 
অন্ধকারে চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আপনমনে ফেসবুক স্ক্রল করছিলেন আর এবারের পূজো সংখ্যার একটা লেখার প্লট নিয়ে মগজে নাড়াচাড়া করছিলেন নৃসিংহ। তখনই অপরিচিত একজনের কাছ থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এলো একটা। প্রোফাইলে মানুষের বদলে একটা কুঁচকুঁচে কলো মথের ছবি। মুখে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করলেন নৃসিংহ। এমন বিদঘুটে ছবি কেউ দেয় প্রোফাইলে! 
আজকাল যার তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট তিনি একসেপ্ট করেন না। খুব পরিচিত কেউ ছাড়া কারো সাথে যোগাযোগ রাখতে চান না। গত মাসেই নরেনের সাহায্যে অযাচিত গায়ে পড়া বন্ধুদের তিনি লিস্ট থেকে বাদ দিয়েছেন।
আনমনে আবার স্ক্রল করতে শুরু করলেন নৃসিংহ। ঐতিহাসিক স্থান সম্বন্ধে তার বিশেষ কৌতুহল আছে। কয়েকটা গ্রুপের সাথেও তিনি যুক্ত। নিয়মিত গ্রুপের পোস্টগুলো দেখেন। তার নতুন তিনটে লেখার মধ্যে দু’টোই ইতিহাস ধর্মী। অনেক রিসার্চ ও নানান জায়গায় তাকে ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে এই জন্য। গত দু’বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি লেখাগুলো দাঁড় করিয়েছেন। এবার পূজোর ফরমাইসি কয়েকটা লেখা শেষ করেই মাস খানেক ছুটি নেবেন। নির্জন কোন জায়গায় কাটিয়ে আসবেন একা একা। 
মোবাইলের ঘড়িটার দিকে তাকালেন নৃসিংহ। রাত দশটা পঞ্চান্ন। এবার শুতে হয়! সকালে রান্নার মেয়েটি চলে আসে সাতটার মধ্যে। কাজেই খুব ঠেকায় না পড়লে বেশি রাত অবধি তিনি জাগেন না। 
উঠি উঠি করছেন এমন সময়, হঠাৎ একটি পোস্টে চোখ পড়তেই তাঁর আঙুল স্থির হয়ে গেল মোবাইল স্ক্রিনের উপর! চোখের দৃষ্টি স্থির। পোস্টটি করেছে তাকে একটু আগেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো সেই কালো মথ। 
একটা ছবি এবং সেটা তারই কলেজ জীবনের। ছবিতে তিনি ছাড়াও রয়েছে তার দুই অন্তরঙ্গ বন্ধু। অখিল আর কুন্তল। কুন্তল নাম করা সার্জেন হয়েছে। এখনও তার সাথে যোগাযোগ আছে নৃসিংহের। অখিল মারা গেছে অনেকদিন। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর তো হবেই। বয়েসের ভারে মলিন হয়ে আসা সাদা-কালো ছবিটার থেকে অখিল যেন স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে নৃসিংহের দিকেই। ছবিটার সঠিক স্থান কাল আজ আর মনে নেই। 
এই ছবিটা কে পোস্ট করল? নাম রয়েছে তিমির রাহা। নামটা আসল না নকল তাও বোঝা যাচ্ছে না! এই নামে কাউকে নৃসিংহ চেনেন বলেও মনে করতে পারলেন না। তিনি তো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা গ্রহণ করেন নি। তবে তিমির রাহা তার বন্ধু হয়ে গেলই বা কি করে? একটা অস্বস্তি শুরু হল নৃসিংহের।
ভ্রু কুঁচকে তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন ছবিটা কবে কোথায় তোলা হয়েছিল। কিন্তু বহুক্ষণ চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না। কাল একবার কুন্তলকে ধরতে হবে ফোনে। ও হয়তো বলতে পারবে! 
ইজি চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন নৃসিংহ। চোখ থেকে চশমাটা খুলে সামনের দিকে তাকালেন। তার চোখ চলে গেল রাস্তার দিকে। শুনশান পিচের রাস্তাটা সোজা চলে গিয়ে ডাইনে বাঁক নিয়ে বড় রাস্তায় পড়েছে। বাড়ির উল্টোদিকের লাইট পোস্টটার দিকে নজর চলে গেল তার। একজন মানুষ পোস্টটার নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে মনে হল! কালো চাদরে শরীর ও মাথা ঢাকা। ঝাপসা হয়ে আসা চশমার কাঁচটা পরিষ্কার করে আবার তাকালেন তিনি। নাহ্! কেউ না। তার মনের ভুল! মাথাটা দপ দপ করছে। এক কাপ কফি হলে ভাল হত। 
শোয়ার ঘরে এসে মোবাইলটা টেবিলের উপর রাখলেন নৃসিংহ। সামনে ঢেকে রাখা জলের গ্লাসটা এক নিঃশ্বাসে গালায় খালি করে দিলেন। ঘরের ডিম লাইটটা জ্বালিয়ে দিতেই হালকা হলদেটে আলো ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। বালিশে মাথা রাখতেই ছাদের সিলিংয়ে চোখ গেল। একটা মথ সেখানে এসে বসেছে। বেশ বড় কালো মথ।
নৃসিংহ কোথায় যেন পড়েছেন, মথ ঘরে প্রবেশ করলে সেই বাড়ির কারোর সাথে খারাপ কিছু হতে চলেছে বোঝায়। যদিও তিনি এটাকে কুসংস্কার বলেই মনে করেন। কিন্তু আজ যেন ঠিক মনে করতে পারছেন না! এই বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। কাজেই….
অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও ঘুম এলো না নৃসিংহের। তিনি আবার বিছানা থেকে নেমে চেয়ারটায় বসলেন। রাতে শোওয়ার আগে তিনি রোজ মোবাইলটা বন্ধ করে দেন। আজ ভুলে গেছেন। ফেসবুকটা আবার খুললেন। কিছুক্ষণ নাড়াচাড়ার পর আবার সেই ছবিটা দেখতে পেলেন। এবার ছবির নিচে কমেন্ট রয়েছে। তিমির রাহাই লিখেছে,—কি রে নিশি, কেমন আছিস?
নৃসিংহের মনে পড়লো তার কলেজের কাছের বন্ধুরা তার নামটা ছোট করে তাকে নিশি বলে ডাকতো।
তিনি কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে লিখলেন,—আপনি কে? আপনাকে আমি চিনতে পারছি না।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর এলো, যেন তার প্রত্যুত্তরের জন্যই অপেক্ষা করে বসেছিল তিমির রাহা।
—চিনবি, একটু মনে কর!
—না! মনে করতে পারছি না।
—সে কি পুরোনো বন্ধুকে ভুলে গেলে চলবে কেন?
মনে মনে চঞ্চল হয়ে উঠছেন নৃসিংহ। তিমির রাহা! আরও একবার মনের গভীরে ডুব দিলেন তিনি। না এই নামে কাউকেই তিনি মনে করতে পারছেন না।
—সঠিক পরিচয় বলুন না হলে আনফ্রেন্ড করে ব্লক করতে বাধ্য হব।
—পারবি না নিশি। এই ছবিটা মনে পড়ে তোর?
—নাহ্! মনে করতে পারছি না। যথেষ্ট বিরক্ত মুখে জবাব দিলেন নৃসিংহ।
—দাঁড়া আর একটা দিচ্ছি।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। দেওয়ালের মথটা নিজের খেয়ালে উড়তে উড়তে এখন টেবিলে এক কোণে এসে বসেছে। সেদিকে দৃষ্টি রেখে নৃসিংহ একটা খবরের কাগজ তুলে ভাঁজ করতে লাগলেন। এক ঝটকায় মেরে ফেলবেন ওটাকে।
আবার একটা ছবি ভেসে উঠল মোবাইলের স্ক্রিনে। খাটে শোয়ানো একটা মৃতদেহ। আশে পাশে কয়েকজন মানুষ ঘিরে রয়েছে সেটাকে। মৃতদেহটা চিনতে পারলেন তিনি। অখিল!
আবার ম্যাসেজ ভেসে এল, —এবার মনে পড়ে?
—কে আপনি? গলার সে জোর আর নেই নৃসিংহের। অনেকটা অনুনয়ের সুরে তিনি আবার বললেন,—আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ হেঁয়ালী করবেন না। আমি বয়স্ক মানুষ।
—অখিলকে মনে পড়ে না লেখক?
—কেন পড়বে না! ছবি দেখে তো চিনেছি তাকে। তার সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক? 
—আত্মার সম্পর্ক লেখক! আমিই অখিল।
—আপনি অখিল! কথাটা লিখে পরপর তিনটে স্মাইলি দিলেন নৃসিংহ। পঁয়ত্রিশ বছর আগে মরে যাওয়া অখিল এতদিন পর খুঁজে খুঁজে তার ফেসবুকের পাতায় এসে ধরা দিয়েছে। সত্যিই হাস্যকর!
—এতদিন পর মরা বন্ধুর বেনামী ফ্রেন্ড রেকোয়েস্ট পাব আমি ভাবতেই পারিনি। সত্যি আমি আপ্লুত। আবার স্মাইলি দিলেন নৃসিংহ।
ওপাশের তিমির অনেকক্ষণ চুপ করে রয়েছে। নৃসিংহ বুঝতে পারলেন সে খেই হারিয়ে ফেলেছে। বোধহয় রণে ভঙ্গ দেবে এবার।
—কিন্তু কিছু ব্যাপার যে থেকেই যাচ্ছে লেখক! আবার কমেন্ট ভেসে এলো।
—কি ব্যাপার অখিলবাবু? মজা করে লিখলেন নৃসিংহ।
—আমার লেখাগুলো।
—লেখা? সতর্ক হলেন নৃসিংহ। মথটা তার হাতের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। আর একটু কাছে এলেই…. হাতের পাকানো কাগজটা নিয়ে তৈরী হলেন তিনি।
—হ্যাঁ লেখা। সেই লেখাগুলো; যেগুলো দিয়ে শুরু করে আজ তুই এত বড় একজন লেখক হয়ে বসেছিস।
—কিসের লেখা? অবাক হলেন নৃসিংহ।
—অখিল সামন্তের দীর্ঘ রিসার্চের ফসল, যা তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলাম। তুই এক রাতে আমার সে সাজানো বাগান দখল করে নিলি নিশি?
ঢোঁক গিললেন নৃসিংহ। আবার খুব জল তেষ্টা পাচ্ছে। আঙুলগুলো যেন ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে। কোন রকমে লিখলেন,—এসবের মানে কি?
—লোকাল ট্রেনের দড়জা থেকে আমাকে যখন তুই ধাক্কা দিলি, আমিও ভেবেছিলাম, এসবের মানে কি? কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
উঠতে গিয়ে পা দু’টো একটু টলে গেল নৃসিংহের। তিনি আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঘাড়ে একটা যন্ত্রনা। গলার কাছটায় কি যেন দলা পাকিয়ে উঠতে চাইছে। ক্লান্তিতে চোখের পাতা বুজে আসছে।
—কোন প্রমান আছে? কোনমতে লিখলেন নৃসিংহ।
—আমার হাতে লেখা পান্ডুলিপিগুলো যে রয়ে গিয়েছে তোর ঘরে। ওগুলো কপি করার পর প্রথমেই নষ্ট করে দেওয়া উচিত ছিল তোর।
আর কোন উত্তর দিলেন না নৃসিংহ। লোকটা যেই হোক সে জানে সব কিছু। অখিলের লেখা, তাকে কায়দা করে নিজের বাড়িতে এনে পান্ডুলিপিগুলো হাত করা। তারপর নেশা করিয়ে ট্রেন থেকে আলতো ধাক্কা। কে এই লোক? নৃসিংহ নিজের মনের মধ্যে হাতড়াতে লাগলেন। এত নিঁখুত ছিল তার পরিকল্পনা! কারোর তো জানার কথা নয়। সবাই এটাকে দুর্ঘটনা বলে মেনে নিয়েছিল। তাহলে কে এই তিমির রাহা?
—বাজে কথা রাখুন। আপনি গল্প লিখুন, নাম করবেন। শেষবারের মতন জ্বলে উঠলেন নৃসিংহ।
—বাজে কথা নয় বন্ধু, বাজে কথা নয়। তোর লেখার ঘরেই তার প্রমান আছে আজও। একটু খুঁজলেই পাবি।
মথটা আরো কাছে এসে বসেছে। হাতের কাগজটা মাথার উপর তুলে ধরলেন নৃসিংহ। বুকটা ব্যথায় চিনচিন করে উঠলো। দৃষ্টি নিবদ্ধ কালো মথটার উপর। এক… দুই… তিন… শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে খবরের কাগজটা নামিয়ে আনলেন নিচে। 
শেষ মুহূর্তে মথটা উড়ে গেল উপরের দিকে। বেসামাল হয়ে চেয়ার সমেত উপুর হয়ে পড়লেন নৃসিংহ। বুকে অসহ্য একটা ব্যথা। মুখটা কুঁকড়ে গেল যন্ত্রনায়। টেবিল থেকে তার লেখার খাতা আর শখের কলমটাও নিচে পড়েছে। হাত বাড়িয়ে কলমটা তুলে খাতার শেষ পাতাটা খুললেন তিনি। কিছু লেখার চেষ্টা করলেন। চোখের সামনে আঁধার নেমে এলো। কয়েকবার কেঁপে উঠে লেখক নৃসিংহ দত্তর কলম থেমে গেল চিরতরে।
সকালে মালতী কাজে এসে বেশ কয়েকবার কলিং বেল বাজিয়েও সাড়া না পেয়ে ফোন করে নরেনকে। সদ্য ঘুম ভেঙে আনমনে বিছানায় শুয়ে ছিল নরেন। শরীরে কেমন একটা জ্বর জ্বর ভাব। খবরটা পেয়েই সে তাড়াতাড়ি ছুটে এলো। তার কাছে একটা ডুপ্লিকেট চাবি থাকে সবসময়। নৃসিংহই দিয়েছিলেন বিশ্বাস করে একসময়। আজ সেটা কাজে লেগে গেল।
শোবার ঘরে মেঝেতে উপুর হয়ে শুয়ে রয়েছে নৃসিংহ দত্তর নিথর দেহ। পাশে মোবাইল আর লেখার খাতাটা। আঙুলে তখনও ধরা রয়েছে তার প্রিয় কার্টিয়ার কলমটি। বসার চেয়ারটা ছিটকে বেশ কিছুটা দূরে চলে গিয়েছে। আলগোছে মোবাইল আর লেখার খাতাটা তুলে নিল নরেন। মালতী একপাশে দাঁড়িয়ে মুখে রুমাল চাপা দিয়ে ডুঁকরে উঠল। মালতীকে সেখানে রেখে নরেন ঢুকল নৃসিংহের লেখার ঘরে। জানলাটা খুলে দিতেই সকালের মিঠে রোদ এসে ছড়িয়ে পড়ল সদ্য অনাথ হওয়া লেখার টেবিলটার উপর। সম্প্রতি এই ঘর পরিষ্কারের দায়িত্ব পড়েছিল নরেনের উপর। গত দু’সপ্তাহ অক্লান্ত পরিশ্রম করে পাঁচটা বইয়ের আলমারি থকে প্রতিটা বই বের করে ধুলো ঝেড়েছে সে। নৃসিংহের লেখার টেবিল, ফাইলের ড্রয়ার সব ঝেড়ে-মুছে ঝকঝকে করেছে। এই ঘরে আর হয়ত আসাই হবে না কোনদিন। একটা দীর্ঘশ্বাস তার বুক ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল। চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিল নরেন করুণ চোখে, তারপর আস্তে আস্তে গিয়ে তিন নম্বর আলমারির শেষ ড্রয়ারটা খুলে ফেলল। এখানেই রয়েছে নৃসিংহর সদ্য শেষ হওয়া লেখার তিনটে পান্ডুলিপি। সেগুলো হাতে তুলে নিল নরেন। এবার ঘরের কোণায় জমা করে রাখা জঞ্জালের স্তুপটার দিকে এগিয়ে গেল সে। কাগজের স্তুপের তলায় একটা নির্দিষ্ট স্থান থেকে টেনে বের করল একটা ডাইরি, দু-তিনটে সাদা-কালো ছবি এবং আরও দু’টো ধূসর মলিন পান্ডুলিপি।
কয়েকদিন আগে এক অলস দুপুরে নিজের মনে আলমারির বইগুলো বের করে পরিষ্কার কাপড়ে মুছে রাখছিল নরেন। তখনই হঠাৎ হাতে আসে নৃসিংহের লেখা একটা ডাইরি। লোভ সামলাতে না পেরে সেটা বাড়ি নিয়ে যায় সে। সেটা পড়েই জানতে পারে অখিল সামন্তের কথা। দৈনন্দিন বিভিন্ন ঘটনার সাথে নৃসিংহ দত্ত তার কৃতকর্মের কথাও লিখে ফেলেছিলেন ডায়রিতে। হয়ত কোন দুর্বল মুহূর্তে একাজ তিনি করেছিলেন, কারণ ডায়রি পড়ে বোঝা যায় তিনি একটু আত্মগ্লানিতে ভুগছিলেন সে সময়। পরে এই ডায়রির কথা তিনি নিজেও হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন। অনাদরে সেটা আলমারির একটা কোণায় পড়েছিল। ছবিগুলোও সে পায় সেই ডায়রির পাতার ভাজেই।
পুরনো কয়েকটা ট্রাঙ্কও ছিল এই ঘরে। একদিন সেগুলো ঘাঁটতে গিয়ে অখিল সামন্তের লেখা পান্ডুলিপিও পেয়ে যায় নরেন। যে মানুষটাকে সে এত শ্রদ্ধা করত তার প্রতি ঘৃণায় ভরে ওঠে নরেনের মন। তার আদর্শ পুরুষের এই কদর্য অতীত তাকে পীড়া দিতে থাকে দিনরাত। দু’দিন সে ভাল করে খেতে ঘুমাতে পর্যন্ত পারে না। পান্ডুলিপি আর ডায়রিটা ঘর পরিষ্কার করে বের হওয়া বাজে বাতিল কাগজের স্তুপের তলায় রেখে দেয় সে। 
নরেন ভেবেছিল ঘটনাটা ভুলে যাবে। নৃসিংহ বুড়ো মানুষ, আর কদিনই বা বাঁচবেন। থাক না! তাঁর অগণিত পাঠক-পাঠিকার মনে বিদ্বেষ ছড়িয়ে কি লাভ! প্রথম জীবনে যার লেখার সাহায্যেই তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করুন না কেন, এত বছর ধরে সেই জায়গাটা তো নিজ গুণেই তিনি ধরে রাখতে পেরেছেন। তার কি কোন দাম নেই?
কাল রাতে নরেন শুয়ে পড়েছিল একটু তাড়াতাড়ি। দক্ষিণের খোলা জানলা দিয়ে আসা মৃদু ঠান্ডা বাতাসে চোখ জুড়িয়ে এসেছিল একটু পরেই। রাত করে মোবাইল ঘাঁটার বদ অভ্যাস তার কোনকালেই নেই। 
হঠাৎ ঘুমটা তার ভেঙে যায় শরীরে একটা নরম স্পর্শ পেয়ে। বাইরের অন্ধকার থেকে একটা কালো মথ কখন যেন এসে বসেছে তার হাতের উপর। হাতটা নাড়া দিতেই মথটা উড়ে গিয়ে বসে তার মোবাইলটার উপর। 
অসময়ে ঘুমের চটকা ভেঙে যাওয়াতে চোখ খুলেই শুয়ে ছিল নরেন। স্থির হয়ে বসে থাকা মথটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সে। মথটাও যেন তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে মনে হল নরেনের।
তারপরই সব কেমন গন্ডগোল হয়ে গেল নরেনের। শরীরটা কেমন অবশ হয়ে এল। তার হাত যেন আর তার অধীনে নেই। মোবাইলটার দিকে হাত বাড়ালো সে। মথটা উড়ে গিয়ে বসল জানলার গরাদে। মোবাইলটা অন করে একটা ফেসবুক এ্যাকাউন্ট খুলে ফেলল সে। নাম দিল তিমির রাহা। যার অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘অন্ধকার পথ’। প্রোফাইলে দিল মথের ছবি। মুখ তুলে জানলার দিকে তাকাতেই মথটা হঠাৎ জানলা দিয়ে উড়ে বাইরের অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
নৃসিংহের ফেসবুক পাসওয়ার্ড জানা থাকায় তাঁর এ্যাকাউন্টে ঢুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করতে অসুবিধাই হয় নি নরেনের। তারপর শুরু হল নৃসিংহের সাথে লুকোচুরি খেলা। 
নরেনের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। অন্য কেউ যেন টাইপ করে চলেছে মোবাইলে। কেটে গেল অনেকটা সময়। অনভ্যাসের ফলে আঙুলগুলো তখন তার টনটন করছে। কিন্তু তার মন অদ্ভুত রকম শান্ত। যেন সে কারও উপর প্রতিশোধ নিতে পেরে তৃপ্ত। ক্লান্ত নরেন ঘুমিয়ে পড়েছিল একসময়। 
নৃসিংহের লেখার চেয়ারটায় এসে বসল নরেন। তিনি জীবিত থাকতে এই চেয়ারে সে কোনদিন বসার সাহস পায়নি। আজ অবস্থাটা ভিন্ন। মাথাটা ঝিমঝিম করছে নরেনের। কাল রাতের ঘটনা এখনও তার কাছে পরিষ্কার নয়। ছেঁড়া ছেঁড়া দু’একটা দৃশ্য ভেসে উঠছে, আবার মনের গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে পরক্ষণেই। কার প্রতিশোধ স্পৃহা কাল রাতে সে চরিতার্থ করল?
কাঁধের ব্যাকপ্যাকটায় অখিল সামন্তের পান্ডুলিপি আর নৃসিংহ দত্তের ডায়রিটা ভরে নিল নরেন। তার স্বপ্ন ছিল লেখক হওয়ার। নৃসিংহ দত্তর মতন একজন লেখক। তাঁরই সদ্য শেষ করা তিনটি উপন্যাসের পান্ডুলিপি এখন তার হাতে।
নিজেকে ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো নরেন। একদিন যে পথে লেখক নৃসিংহ দত্ত হেঁটে গেছেন, আজ সেও সেই পথ ধরেই ওঠা শুরু করবে। লোক জানাজানি হওয়ার আগেই এই পান্ডুলিপি সরিয়ে ফলতে হবে। সামনে অনেক কাজ। মুছে দিতে হবে সমস্ত অতীত। 
খোলা জানলা দিয়ে আসা সকালের সিগ্ধ বাতাস ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়। শূন্যতাকে আরও শূন্য করে ঘরের ভিতরে খুঁজে চলেছে যেন কাউকে। নরেন দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ব্যাগটা পিঠে নিতে নিতে। সে খেয়াল করল না দেওয়ালে এখন দুটো মথ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।

বৈশাখী ২০২৪