রাজবাড়ির ভূত

রাউরকেলা, ওড়িশা

কলেজে পড়াশোনা বন্ধ। এদিকে বাড়িতেও মন টিঁকছে না। তাই পায়রাডাঙ্গাবাসী আমি (সঞ্জীব) ও আমার দুই বন্ধু অনীল আর প্রলয় ঠিক করলাম শান্তিনিকেতন বেড়াতে যাবো। কিন্তু এখন তো যান চলাচল বন্ধ। তাছাড়া ট্রেন-বাসের দীর্ঘ জার্নি করে যেতে কারোরই মন চায় না। তাই ঠিক হ'ল, প্রাইভেট কার ভাড়া করেই যাবো।

সেই মত আজ সকাল ছ'টা নাগাদ প্রাইভেট কারে পায়রাডাঙ্গা থেকে শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। টিফিনবাক্সে সকলের জন্য লুচি আর তরকারি রাখা আছে। খিদে পেলেই ওটা দিয়ে সকালের জলখাবারের ব্যবস্থা করা হবে। আমাদের গাড়ি মোটামুটি পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ কিমি বেগে চলেছে। গাড়ির স্পিডোমিটারের কাঁটা তারই ইঙ্গিত করছে। ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে দিল্লি রোড হয়ে গ্রান্ড ট্রাংক রোডে পড়তে সকলেরই খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠল। সময় এখন সকাল সাড়ে আটটা। রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে জলখাবারটা সাবাড় করে প্রত্যেকে আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম। গাড়িতে আসতে-আসতে সবাই কিছু না কিছু বলে চলেছি। গাড়ির ড্রাইভার নগেনদার সাথেও অল্প-বিস্তর কথা হচ্ছে। ব্যতিক্রম শুধু প্রলয়। ওকে সে কথা জিজ্ঞেস করতে ও বলল, ওর বমির প্রবলেম আছে। তাই গাড়িতে চড়লে ও বেশি কথা বলে না। যাই হোক, গাড়ি গ্রান্ড ট্রাংক রোড থেকে আবার ন্যাশনাল হাইওয়েতে পড়ল। তারপর ইলামবাজার বাইপাস হয়ে বোলপুর শান্তিনিকেতন রোডে পড়ে এদিক-ওদিক চলে শেষ পর্যন্ত আমাদের গন্তব্য শান্তিনিকেতনে পৌঁছাতে পৌনে এগারোটা বেজে গেল।

শান্তিনিকেতনে একটা হোটেল ভাড়া নিয়েছি। মরসুম না হওয়ায় সস্তায় ভাড়া পেয়ে গেছি। একটু বিশ্রাম নিয়ে সবাই স্নান সেরে নিলাম। তারপর ডাল, নিরামিষ আর সর্ষে-ইলিশ দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে ঘন্টা দুয়েকের বিশ্রাম, বলা ভালো দিবানিদ্রা যাপন। দিবানিদ্রার পর দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ নগেনদার চারচাকাতে চেপে আমাদের শান্তিনিকেতন ভ্রমণ শুরু হ'ল। বিশ্বভারতী মিউজিয়াম, খোয়াইয়ের হাট, আরও ছোটখাটো কয়েকটা জায়গা ঘোরার পর আমরা সকলে মির্জাপুর রাজবাড়ি দর্শনে গেলাম। আসলে জমিদারবাড়ি। স্থানীয়রা রাজবাড়ি বলে থাকে। জমিদারবাড়িটা অতি প্রাচীন। প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন সিংহমশাইদের বাড়ি এটি। বাড়িটার সবটাই প্রায় জরাজীর্ণ, ভগ্নপ্রায় দশা। অন্যান্য ভগ্ন প্রাসাদের মতই। বাড়ির একটা জিনিস সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে। সেটা হ'ল, বাড়ির পাশের দিকের একটা অংশে অনেক উঁচুতে একটা নকল জানলার পাশে একটা নকল মূর্তি খোদাই করা আছে। জঙ্গলের মধ্যে রাতেরবেলায় যে কেউ দেখে ওটাকে ভূত ভেবে ভয় পেতে পারে। মির্জাপুর রাজবাড়ি দর্শনের পর হোটেলে ফিরে এলাম। সেদিনের মত ঘোরাঘুরি সমাপ্ত। রাতে হোটেলের এক পুরনো কর্মচারীর কাছে স্থানীয় রাইপুর রাজবাড়ি (জমিদারবাড়ি)- র অলৌকিক গল্প শুনলাম। প্রায় তিনশো বছরের পুরনো রাজবাড়িতে নাকি রাতেরবেলায় ভূতের আনাগোনা হয়। নানারকম অদ্ভুত শব্দও শোনা যেতে থাকে।

পরদিন ভোরবেলায় পূর্বপরিকল্পনা-মতই রাইপুর রাজবাড়ি দর্শনে গেলাম। ঝোপেঝাড়ে ঢাকা পেল্লায় প্রাসাদ। শান্তিনিকেতনের এককালীন জমিদার সিনহা পরিবারের প্রতিপত্তির চিহ্ন। ঘরদোর কিছুই আর আস্ত নেই। ভগ্ন প্রাসাদের ভেতরে ঢুকতে দিনেরবেলাতেও কেমন ভয়-ভয় করে। তাও সাহসে ভর করে ভেতরে গেলাম। ভেতরের দেওয়াল কেমন যেন স্যাঁতসেতে নোনা ধরা। লক্ষ্য করলাম, উপরের তলায় উঠবার সিঁড়ি মাঝখান থেকে ধসে পড়েছে। সুতরাং উপরে ওঠার চেষ্টা বৃথা। প্রশস্ত উঠোনের মাঝে সুবিশাল এক কুয়ো। নোংরায় মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। বোধ করি, ভেতরেও আর জল নেই, বা থাকলেও ব্যবহারের অনুপযুক্ত। জমিদারবাড়ির পুরো গঠনটাই এখন জঙ্গলাকীর্ণ। দিনেরবেলাতেও কেমন একটা গা ছমছমে ভাব। এ বাড়িকে নিয়ে যে গুজব রটবে, এটাই স্বাভাবিক।ফিরেই আসছিলাম। 

হঠাৎ প্রলয় আনমনে বলে উঠল, "এ বাড়িতে যে এক রাত কাটাতে পারবে, তাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।"

ওর কথা শুনে অবাক হলাম। 
অনীল তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলে উঠল, "কে দেবে দশ হাজার টাকা?! তুই নাকি?!"
আমি হাসতে লাগলাম।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রলয় বলল, "আরে না। এখানে আসতে-আসতে একটা পোস্টারে চোখ চলে গেছিল। সেইটাতেই লেখা ছিল, এই বাড়িতে একরাত কাটাতে পারলে নগদ দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। প্রমাণ হিসেবে বাড়ির বিভিন্ন অংশের সাথে একটি করে মোট পাঁচটি সেল্ফি তুলে আনতে হবে। এগুলোর মধ্যে একটা অবশ্যই সন্ধ্যাকালে ও একটা ভোরে তোলা হতে হবে। কোনও রকম এডিটিং চলবে না। ধরা পড়লে পুরস্কার বাতিল হবে। একটা নম্বরও দেওয়া ছিল। নোট করে নিয়েছি।" 

আমরা ওর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে অবাক হলাম। ওর নোট করা নম্বরে ফোন করে ব্যাপারটা সম্বন্ধে কনফার্ম হলাম। সত্যিই এমন একটা ঘোষণা করা হয়েছে। টাকা দেবেন সিনহা পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের সদস্যা মিসেস সুলগ্না সিনহা। তারই পরিকল্পনা এটি। সুলগ্নাদেবী কথাটা স্বীকার করলেন। তারা বিশ্বাস করেন, এ বাড়ির আনাচে-কানাচে তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মারা বসবাস করে। তারা দিনে ডিস্টার্ব না করলেও রাতে বসতবাড়িতে কাউকে টিঁকতে দেয় না। অনেক ব্যক্তি চ্যালেঞ্জ নিয়ে এ বাড়িতে রাত কাটাতে এসে ব্যর্থ হয়েছে। কেউ-কেউ মরতে-মরতে বেঁচে গেছে। আর, তখন থেকেই ব্যাপারটাকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য এই পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়। 
আমরা তার কাছে জানতে চাইলাম, একজনের পরিবর্তে একসাথে একাধিক ব্যক্তি রাত কাটালে তার কোন আপত্তি আছে কিনা। তিনি জানালেন, তাতে কোন আপত্তি নেই। শুধু প্রমাণ দেখাতে পারলেই হ'ল। 

আমাদের মধ্যে আমিই যা একটু ভীতু। বাকি দু'জন অত্যন্ত সাহসী। তাই আমরা ঠিক করলাম, তিন বন্ধুই একসাথে সন্ধ্যার সময়ে রাজবাড়িতে আসবো। পুরো রাত কাটিয়ে ভোরে ফিরে যাবো। নগেনদা-ই তার গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়ে যাবে; পরে আবার নিতে আসবে।

সারাদিন এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরির পর ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টা নাগাদ রাজবাড়িতে এসে হাজির হলাম। বাড়ির চারপাশের জঙ্গল এতই ঘন যে, একদম কাছে না গেলে ভিতরে আদৌ কোন প্রাসাদ আছে কি-নেই বোঝাই যায় না। উল্টে জঙ্গলগুলোকেই এক-একটা দৈত্য-দানব বলে ভ্রম হয়। আমাদের সাথে আলোর জন্য পর্যাপ্ত মোমবাতি ও টর্চ, তিনজনের জন্য পর্যাপ্ত পানীয় জল, রাতের খাবার, শোয়া-বসার জন্য প্লাস্টিকের মাদুর, মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য ওডোমস ও ধুপ, সাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য লাঠি, কার্বলিক এসিড ইত্যাদি রয়েছে। অনীল বুদ্ধি করে তার পকেটে তাস নিয়ে এসেছে। তাস দেখে আমাদের দু'জনের মনও খুশীতে চনমনে হয়ে উঠল। যাক, রাতে তাস খেলে অনেকটা সময় কাটানো যাবে। বোর হতে হবে না। তবে তিনজনে কী তাস খেলবো?! তাই ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও নগেনদাকে আমাদের সাথে রেখে দেওয়া হ'ল। সে থাকলে খাবার ও জলে একটু টানাটানি পড়বে বটে; তবে তাতে কী? একটা দিন না হয় কষ্ট করে চালিয়ে নেওয়া যাবে। নগেনদার থেকে যাওয়ার অবশ্য আরেকটা কারণও আছে। আমাদের সাথে থেকে গেলে নগদ দশ হাজার টাকার ভাগ সেও পাবে।
নগেনদা তার গাড়ি থেকে সব জিনিস নামিয়ে দিয়ে প্রথমে গাড়িটাকে ভালো করে লক করল। তারপর আমাদের পিছনে-পিছনে আসতে লাগল। আমরা বাড়িতে ঢোকার আগেই তার ভগ্নপ্রায় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একটা সেল্ফি তুলে নিলাম। তারপর অতি সাবধানে টর্চ ফেলে-ফেলে ও মাটিতে লাঠি ঠুকেঠুকে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে ফাঁকা জায়গা কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবু ছোট ঘাসের মধ্যে সাপ-খোপ আছে কি-না পরীক্ষা করার পর নিশ্চিন্ত হয়ে সেখানেই প্লাস্টিকের মাদুর বিছিয়ে বসলাম। মাদুরের চারপাশে সাপ তাড়ানোর জন্য কার্বলিক এসিড স্প্রে করা হ'ল।  নগেনদা বেশ কয়েকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে মাটির উপর সেঁটে দিল। এরপর অনীল পকেট থেকে তাস বার করলে চারজনে মিলে টুয়েন্টি নাইন খেলতে বসলাম।

খেলতে-খেলতেই একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। কে যেন আমার মাথার পিছনে টোকা দিচ্ছে! প্রথমে ভাবলাম, আমাদের মধ্যেই কেউ বুঝি তামাশা করছে। কিন্তু না, তামাশা কোথায়?! বাকিরাও খেলার ভিতর এতই মশগুল হয়ে আছে যে, আমার সাথে তামাশা করার প্রশ্নই আসে না। খেয়াল করে দেখছি, যখনই আমার দান আসছে, মাথার পিছনে কে যেন একটা করে টোকা মারছে! এটা কি ভূতের কাজ?! হয়তো হতেও পারে। ওদের তিনজনকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করলাম। ওরা কিন্তু আমার চিন্তাটাকে আমলই দিল না। উল্টে আমাকে ভীতু বলে খেপাতে লাগল। ফলে আমি দমে গেলাম। 

তাসের খেলাটা বেশ জমে উঠেছে। দেখতে-দেখতে কখন দশটা বেজে গেছে - খেয়ালই নেই। এক সময়ে প্রলয় চেঁচিয়ে উঠে বলল,
"কটা বাজে খেয়াল আছে কারও?! খাওয়া-দাওয়ার দরকার নেই না-কি?!" তার কথা শুনে প্রত্যেকে অবাক হলাম। তাই তো, খেলায় মশগুল থাকায় খাওয়ার কথা কারোরই মাথায় ছিল না! আর দেরী না করে প্রথমে মাদুরের উপর কয়েকটা পুরনো খবরের কাগজ পেতে দিলাম। তারপর ব্যাগ থেকে তড়িঘড়ি রাতের খাবার, কাগজের থালা, জলের বোতল বার করে তার উপর রাখলাম। খাওয়াটা ভালোই হ'ল। এই সময়ে কোনরকম উপদ্রব সহ্য করতে হ'ল না। অশরীরীরা বোধ করি ততটাও অভদ্র নয় যে, খাওয়ার সময়ে ডিস্টার্ব করবে।

খাওয়া-দাওয়ার পার্ট চুকে যাওয়ার পর সবাই মিলে একসঙ্গে পরপর দু'টি সেল্ফি তুলে নিলাম। আর দু'টো সেল্ফি তোলা বাকি রইল। ঠিক হ'ল, এলার্ম দিয়ে রাত তিনটের সময়ে উঠে একটা আর ভোরবেলায় ফেরার আগে একটা সেল্ফি তুলে সবাই বাড়ি ফিরে আসবো। পরে এক সময়ে সেইসব সেল্ফি মিসেস সুলগ্না সিনহার মোবাইলে সেন্ড করে দিলেই আমাদের কাজ শেষ, আর সাথে দশ হাজার টাকা পুরস্কার প্রাপ্তি। ওঃ, কথাটা ভাবতেই গা কেমন যেন শিহরিত হচ্ছে! ওমা! গা শিহরিত হচ্ছে - এ পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল। কিন্তু গায়ে এমন কাঁপুনি ধরাচ্ছে কে?! এখন তো জৈষ্ঠ্য মাস, বাইরে যথেষ্ট গরম। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না! তবে?! এই কাঁপুনির মানে কী?! এবারে শুধু আমিই নই, আমার সাথে-সাথে বাকি তিনজনেও ঠকঠক করে কেঁপে চলেছে! আমি বললাম, "এবার বুঝতে পারছিস তো, আগের বার আমার চিন্তাটা অমূলক ছিল না!" সবাই এক বাক্যে আমার কথাটাকে মেনে নিল। তবে শরীরের কাঁপুনিটা দীর্ঘস্থায়ী হ'ল না। মিনিট খানেক কেঁপে সবাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলাম। নীল বলে উঠল, "ধুর, ভূত-টূত কিছু নয়। আসলে জোরে হাওয়া বওয়ার ফলে গায়ে কাঁপুনি ধরেছিল।"
আমি তার কথার প্রতিবাদ করে বললাম, "তা হলে তো গাছের পাতা নড়ত! সেটা হ'ল কোথায়?!" এবারে তিনজনকেই কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত মনে হ'ল। তবে চুপচাপ বসে থেকে লাভ নেই। যা হবে, দেখা যাবে - ভাব করে চারজনেই শুয়ে পড়লাম।

রাত তখন ক'টা বাজে, কে জানে! হঠাৎ একটা তীব্র আর্তনাদের শব্দে সবার ঘুম ভেঙে গেল। কেমন যেন গোঁঙানীর মত শব্দটা। কে করল এটা?! কোথা থেকেই বা করল?! ভাবতে-ভাবতেই আবার ভেসে এল শব্দটা। এবার আরও স্পষ্ট। শব্দের উৎস লক্ষ্য করে টর্চ হাতে নিয়ে সবাই বাড়ির দক্ষিণ দিকে ছুটে গেলাম। গিয়ে কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। তবে পরিত্যক্ত কুয়োটার দিকে সবার নজর গেল। ওটার নিচ থেকেই কি তবে শব্দটা আসছিল?! যাই হোক, সবাই মিলে কুয়োর সামনে দাঁড়িয়ে একটা সেল্ফি তুলে নিলাম। আর মাত্র একটা সেল্ফি নেওয়া বাকি। সেটা ভোরে তুলতে হবে।

আবার সবাই ঘুম দিয়েছি। অনেকটা সময় নির্বিঘ্নে কাটল। হঠাৎ মাথার পিছন থেকে একটা কর্কশ শব্দে সবারই পিলে চমকে গেল। ধড়ফড় করে উঠে বসে আমরা পিছনের দিকে তাকিয়ে প্রায় ভূতের মুখোমুখি হলাম। গাছের কোটর থেকে একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ যেন আমাদের দিকেই চেয়ে আছে! নগেনদা দেখে ভিরমি যান, আর কি! আমার অবস্থাও তথৈবচ। হঠাৎ প্রলয় হেসে উঠে বলল, "ধুর, ওটা একটা পেঁচা।" নিজেদের নির্বুদ্ধিতায় নিজেরাই তখন আফসোস করছি। যাই হোক, ঘুম আর হবে না বুঝতে পারছি। ঘড়িতে এখন রাত চারটে পাঁচ বাজে। ভোর হতে আর মাত্র দেড় ঘন্টা মতন বাকি আছে। অনীল প্রস্তাব দিল, "আর ঘুম হবেও না। তার চেয়ে বরং বসে তাস খেলা যাক।" সবাই তার প্রস্তাব একবাক্যে মেনে নিলাম। নগেনদা বলল, "এবার তবে ব্রিজ খেলা যাক।" কিন্তু ও খেলাটা আমাদের তিনজনের কারোরই আসে না বলে টুয়েন্টি নাইনই আবার শুরু হ'ল। এরপর আমাদের আর কোনও উপদ্রবের সম্মুখীন হতে হয় নি। খেলতে-খেলতেই ভোর হয়ে গেল। 

ভোরের আলো ফুটতেই সকলের মন খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এবারে শেষ সেল্ফিটা তুলে নিতে পারলেই আমাদের রাজবাড়ি অভিযান সফল; সাথে আর্থিক লাভ। আমাদের মধ্যে অনীলের মোবাইল সবচেয়ে ভালো বলে এতক্ষণ ও-ই সবক'টা সেল্ফি তুলেছিল। কিন্তু এবার মোবাইল বার করে ও বুঝল, চার্জ খতম হয়ে গেছে! এবার কী করা?! একে-একে সবার মোবাইল পকেট থেকে বের হ'ল। কিন্তু একি! সবার মোবাইলের চার্জ খতম হয়ে গেল কীভাবে?! অথচ হোটেল থেকে বেরোনোর সময়ে প্রত্যেকের মোবাইলে এইট্টি পার্সেন্টের বেশি চার্জ ছিল, স্পষ্ট মনে আছে। এর মধ্যে কাউকে ফোন করাও হয় নি, বা কেউ ফোন করেও নি। তবে?! একমাত্র নগেনদার মোবাইলে চার্জ আছে। তবে ওটা পাতি, তাই সেল্ফি নেওয়া যায় না।

আর কী করা! অগত্যা একটা সেল্ফি কম তুলেই ক্ষুণ্ণ মনে ফিরে আসতে হ'ল। সুলগ্না সিনহাকে চারটে সেল্ফি দেখিয়ে চার্জ শেষ হওয়ার কথাটা বলতে হবে। তাতে কাজ হলে ভালো, নয়তো তিনি মেনে না নিলে শর্ত অনুযায়ী আমাদের কিছুই করার নেই। হোটেল রুমে এসে অনীলের মোবাইল চার্জে বসানো হ'ল। একটু চার্জ হতে অনীল মোবাইল চালু করে 'ক্যামেরা' ফোল্ডারটা খুলল। আগেকার সবক'টা ফোটো-ই আছে সেখানে। কিন্তু একি! রাজবাড়িতে তোলা সেই চারটে সেল্ফি গেল কোথায়?! সারা মোবাইল ঘেঁটেও তাদের কোন অস্তিত্ব পাওয়া গেল না! আমরা সবাই ওকে দোষারোপ করতে শুরু করলাম। মনে করলাম, হয়তো ও-ই সেল্ফি তোলার পর ঠিকমত সেভ করতে ভুলে গিয়ে থাকবে। সব পরিশ্রম জলে গেল!

তবে এটাও ঠিক যে, আমাদের সবক'টা মোবাইলের চার্জ একসাথে ফুরিয়ে যাওয়া, আমার মাথার পিছনে টোকা দেওয়া, হাওয়া না থাকা স্বত্বেও সকলের শরীর কেঁপে যাওয়া, রাজবাড়ির কুয়োর দিক থেকে আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসা - এর সবক'টা ঘটনা-ই কাকতালীয় বা লৌকিক ছিল বলে উড়িয়ে দেওয়া বোধহয় উচিত নয়। আপনারা কী বলেন?

বৈশাখী ২০২৪