জেনারেশন গ্যাপ

বেলেঘাটা মেন রোড, কলকাতা

১৯৬৯ সাল
আশ্বিনমাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া, সকালবেলা কল্যাণপুর গ্রামের দক্ষিণদিকে বাগান ঘেরা একটি বড়ো বাড়ীর সামনে একটি টাঙ্গা এসে দাঁড়ালো। সুপুরুষ এক ভদ্রলোক সেই গাড়ী থেকে স্ত্রী এবং দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে নেমে এলেন।

বাড়ীর দীর্ঘদিনের ভৃত্য সুবল আগন্তুকদের দেখতে পেয়েই দৌড়ে এসে বলল, পেন্নাম হই ছোটকত্তা, মা-ঠাকরুন, আসতে কোন কষ্ট হয়নি তো! কত্তামশাই আপনাদের জন্যেই বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছেন, এখনও কাছারীতে যান নি।

ঘোমটার আড়াল থেকে স্নেহপূর্ণ কণ্ঠ ভেসে এলো, ভালো আছো তো বাবা সুবল, বাড়ীর সবাই ভালো তো! 

এজ্ঞে আপনাদের ছিচরণের আশীর্বাদ, এবারে আপনাদের মোটঘাটগুলো দ্যান দিকি, ভেতরে রেখে আসি!

দিদিকে বলো বটঠাকুরকে প্রণাম করেই আমরা আসছি। 
মালপত্র নিয়ে সুবল বাড়ীর ভেতরে চলে গেল। 

প্রশস্ত ঘরে পুরু জাজিমপাতা একটা সেগুনকাঠের চৌকির ওপরে তাকিয়ায় আধশোয়া হয়ে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক কাগজপত্র দেখছিলেন, বাঁ হাতে রূপোয় বাঁধানো গড়গড়ার নল। পায়ের শব্দে মুখ তুলে হাসিমুখে বললেন, আরে আশু, এদ্দিন বাদে দাদার কথা মনে.....আঃ, আবার প্রণাম......ভালো থাকো.......থাক বৌমা, অখন্ড সৌভাগ্যবতী হও......আরে, তোরা আবার.....এদ্দিনে বুড়ো জ্যাঠামশাইকে মনে পড়লো! ওরে ও কেষ্টা, এঁদেরকে তোদের কর্তামার কাছে নিয়ে যা! যাও বৌমা, তোমরা ভেতরে যাও! বোস আশু, অনেকটা পথ এসেছো, একটু জিরিয়ে হাতেমুখে জল দাও!
সসম্ভ্রমে চৌকিতে বসে নীচু গলায় দাদার সাথে বাক্যালাপ করতে করতেই 'আশু' সতৃষ্ণ নয়নে গড়গড়াটির দিকে তাকাচ্ছিলেন। ‘দাদা’ মুচকি হেসে বললেন, আশু, তুমি জিরোও, আমি একটা কাজ সেরে আসি!

‘দাদা’র যাওয়া মাত্রই ‘আশু’ গড়গড়ার নলটি টেনে নিয়ে মহানন্দে ধূমপান করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে সুবল এসে সে দৃশ্য দেখে ক্ষুব্ধস্বরে বলল, কত্তামশাই যে গড়গড়া পাল্টে দিতে বললেন, আপনি ওই এঁটো নলেই..... 
তুই থাম, দাদার এঁটো তো মহাপ্রসাদ!
 
বিরাট পালঙ্কের ওপর বসে এক প্রৌঢ়া সুপুরী কাটছিলেন। কেমন আছো দিদি, শোনা মাত্রই তিনি স্নেহভরা গলায়, ওমা ছোটবৌ, কদ্দিন বাদে.....থাক থাক, সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হোক......আরে থাক, জ্যাঠাইমাকে অত্তো পেন্নাম ঠুকতে হবে না....যা দেখি, হাতমুখ ধুয়ে জলটল খা, ও টেঁপির মা......ছোটবৌ, এই নে, বলে পানের বাটা এগিয়ে দিলেন!
'ছোটবৌ'টি বললেন, যাই বলো দিদি, তোমার হাতে সাজা পানের স্বাদ আর কোত্থাও পেলুম না! 
তাও ভালো, প্রৌঢ়া বললেন, এই পানের জন্য যদি আমার কথা মনে পড়ে! 
দুই বাঙ্গালী নারীর অনাবিল হাসি শরতের নরম রোদ্দুরে মিলিয়ে গেল!

২০১৯ সাল
দূরে মাইকে শোনা যাচ্ছে, আমাদের মহাষ্টমীর........ 

কলকাতার একটা আবাসনের ভেতরে এক অল্পবয়সী স্মার্ট দম্পতি বাইক থেকে নেমে এলো। লিফটে করে আটতলায় উঠে নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজাতেই এক ভদ্রলোক দরজা খুলে দিয়ে বললেন, এতো দেরী করে এলি, সঞ্জনা সেই কখন থেকে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে ওয়েট করছে! আয় রুমেলা, ভেতরে আয়, আয় রাজু!
তোমার ল্যাদাড়ু ভাইটিকে তো জানো, রুমেলা ঝঙ্কার দিল, সকালবেলা চায়ের ঠেকে একঘন্টা গ্যাঁজাবে! তাও তো আমি তাড়া মারতে......মনাদি কোথায়!
‘সঞ্জনা’র গলা পাওয়া গেল, চলে আয় রুমি, আমি কিচেনে! 

ভদ্রলোক ভাইয়ের দিকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নে। 
লাইটার জ্বেলে ‘রাজু’ প্রথমে দাদার তারপর নিজের সিগারেটটা ধরিয়ে সোফায় আরাম করে বসে বলল, তোর অফিসের প্রবলেমটা মিটলো?

কিচেনে রুমেলাও তার 'মনাদি'র ঠোঁটের জ্বলন্ত সিগারেট থেকে নিজেরটা ধরিয়ে নিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, যাই বলো মনাদি, সাদা পাঞ্জাবীতে দাদাকে কিন্তু ব্যাপক হ্যান্ডসাম লাগছে! কলেজে তো দাদা আমাদের ক্র্যাশ ছিল!
তা ক্র্যাশই যখন ছিল তখন এগোলেই পারতিস, ‘সঞ্জনা’ মুচকি হেসে বলল!
আহা, আমরা যেন তোমাদের অ্যাফেয়ারের কথা জানতাম না, এগোলে তুমি আমাকে আস্ত রাখতে!

দুই বঙ্গললনার অনাবিল হাসি আবারও শরতের নরম রোদ্দুরে মিলিয়ে গেল! 

বৈশাখী ২০২৪