মেঘে ঢাকা সূর্য

চাঁদপুর, বাংলাদেশ

ছেঁড়া একপাটি জুতা পায়ে খোঁড়াচ্ছিল মাজু।
ভালো নাম মারজুক আবদুল্লাহ। ছোটবেলায় এ নাম ছোট হয়ে মাজু হয়ে গেছে। ভাই-বোনের মধ্যেও সে মেজো। কিন্তু বড় ভাইয়ের ভূমিকা পালনে ক্লান্ত। দিনমজুর সুরুজ মিয়ার এই ছেলেটাই নয় সদস্যের টানপোড়নের সংসারে ঘানি টানতে তাকে সঙ্গ দিচ্ছে। আর গুলো সব অকর্মার ঢেঁকি।গোগ্রাসে অন্ন ধ্বংস করে যাচ্ছে।
মাজু পড়াশুনার সূত্রে কুমিল্লায় থাকে। পৃথিবীর এই ক্লান্তি লগ্নে সব থেমে গেলেও,মাজুর ক্লান্ত হওয়া চলবে না।বছরখানেক 'করোনা' মহামারীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও,পিতাকে একটু স্বস্তি দিতে ভার্সিটি থেকে দূরে মফস্বলের এক টিনশেড বাসায় সে থাকে। সংকীর্ণতা বিদীর্ণ করেছে জুতা!টিউশন থেকেই ফিরছিল সে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে দেড় বছরের পট্টি দেওয়া জুতাটা শেকড়ে আটকাল। সে কিছু না ভেবেই দিছে টান, ঘ্যাত করে ছিঁড়ে গেল।

টিউশনও নেই আজকাল। অতি সচেতন ও সক্ষম পিতা-মাতাই আজকাল গৃহশিক্ষক রাখছেন। টিউশন এখন দুইটায় এসে ঠেকেছে। এই ই ভরসা।
যা পায় মেস ভাড়া, খাওয়া শেষে হাজার দুই টাকা সুরুজ মিয়ার মুখে হাসি ফোটায়। সব দিন যেখানে কাজ না থাকে সেখানে এ টাকায় মাসের খোরাকটা পেয়ে চোখ চকচক করে ওঠে!

মাজুর আজ কদিন ধরে ঠান্ডা-জ্বর ভাব। যা ইচ্ছা করে চেপে রাখতে হয়। কে জানে টের পেয়ে কে কখন বলে,বাপু আর না। বিদেয় হও।
এর উপর সবচেয়ে প্রিয় বোন সেঁজুতির মৃত্যু আজও মনে রক্ত ঝরায়। প্রিয়জন হারানোর শোক আমৃত্যু থেকে যায়। চিকিৎসাহীনতায় ছোট ফোঁড়া থেকে ক্যান্সারে রূপ নিল। সেঁজুতির মৃত্যুর আগে আনার খাওয়াটা আজও ভাবায়!
ভাবতে ভাবতেই আচমকা ভূত দেখার মত কেঁপে ওঠে সে। বিশাল মেঘাচ্ছন্ন আকাশে সূর্য উঁকি দিয়েছে। একবিংশ বছরের জীবনে এই প্রথম লজ্জা আর মুগ্ধতা একই সাথে!

ভাইয়া,ও ভাইয়া।
জ্বী,বলুন।
ভাইয়া আমাকে ঐ ঘুড়িটা পেড়ে দিবেন, প্লিজ,প্লিজ।
জীবনে বহুবার এই ডাক শুনেছে সে। তবে এবার হৃদস্পন্দনে ধাক্কার মত অনুভূত হলো।
কিছু না ভেবেই,জুতা রেখে ঘুড়িটা পেড়ে দিল।
চিকচিকে পানির মাঝে, এই বাতাস বিলাস দিনে কোনো ষোড়শী ঘুড়িও উড়ায়? ভাবতেই দেখে পাশে আরো গুলা চারেক বাচ্চা বয়সী ছেলে-মেয়ে।যা এতক্ষণ খেয়ালই করেনি সে।
ভাইয়া,এই ভাইয়া।
জ্বী!
আমি নিরুপমা।
জ্বী!

জ্বী,জ্বী করছেন কেন?
 হ্যাঁ, এমনি।(মুগ্ধতাকে সংযত করে)
ওহ,আমরা আসলে ঈদে দাদা বাড়ি বেড়াতে এসেছি।
ও,ও..
আমি মারজুক।
আচ্ছা,বুঝেছি! এখন আমাকে একটা কৃষ্ণচূড়ার ঢাল পেড়ে দেন।
কিছু,কৃষ্ণচূড়া গুচ্ছ হাতে দিয়ে, দূর থেকে দাঁড়িয়ে আমি নির্বিকার। 
কৃষ্ণচূড়া চুলে গুঁজে, ছিপছিপে এ বালিকার সুখের লাটাই হাতে হাসির ফোয়ারায় আমি বিস্মিত!
এত সুন্দর করেও কেউ হাসতে পারে!
জানা নেই,আর এই রূপসীর দেখা মিলবে কি না,তবে হয়ত আবারো এখানে এসে খুঁজব তাকে।
কিন্তু,এই মুক্তা ঝরা হাসি, এলোকেশ যেন মেঘ বিদীর্ণ করা সূর্যের আলোক রশ্মি!

কয়েক মুহূর্তে জন্য,পৃথিবীর সব জরা-জীর্ণর মুক্ততায় হৃৎপিন্ড ভরে শ্বাস নিয়েছে! সাথে রঙের মিল থাকা কৃষ্ণচূড়া সেঁজুতির আনারের বেদনা ভেদ করেছে!
বাতাসও লোমকূপে শিহরণ জাগিয়ে বলে দিচ্ছে,জীবন আসলেই সুন্দর! 
নয়তো,জীবনানন্দ দাশ পৃথিবীর বুকে কীট হয়ে হলেও থেকে যেতে চাইতেন না!

বৈশাখী ২০২৪