মধ্যরাতের ঘটনা

বিধাননগর, কলকাতা

  
রজতাভবাবু তার বৌ ছেলেকে নিয়ে দার্জিলিংয়ের হোটেল আলেক্সে উঠেছেন। চেক ইন করার সময় কয়েকজন পর্যটক, যারা দার্জিলিং ট্যুর শেষ করে হোটেল ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তাদের আলোচনায় পৃথাদেবী বুঝতে পারলেন, হোটেলে নাকি ভূতের আনাগোনা আছে। সেই কথা শোনামাত্র পৃথাদেবী রজতাভবাবুর কাছে আবদার করলেন হোটেল পরিবর্তনের জন্য । ভূতে অবিশ্বাসী রজতাভবাবু বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে বললেন, "অন্যের শোনা কথায় বিশ্বাস করে লাভ নেই।"
         রজতাভবাবুদের রুমটা করিডরের একেবারে শেষ প্রান্তে। বেশ ছিমছাম সাজানো হোটেল, কিন্তু বেশ পুরোনো। বোঝা যায় বেশ কিছু বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে এই হোটেল। ম্যানেজারের থেকে শুনলেন, আলেক্স সাহেব এই হোটেল তৈরি করেছিলেন । তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর হাত বদল হয়ে মালিকানা এখন একজন বাঙালীর হাতে। পৃথাদেবীর মনে যে হোটেল ছেড়ে যাওয়া পর্যটকদের কথা প্রভাব বিস্তার করেছে, সেটা রজতাভবাবু খুব ভালোই অনুভব করলেন। সন্ধ্যাবেলা রজতাভবাবু হোটেলের ম্যানেজারকে জানিয়ে রাখলেন পরেরদিন ভোরবেলা যেন তাদের ঘুম থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয়, পরের দিন ওনারা সূর্যোদয় দেখতে টাইগার হিলে যাবেন। ম্যানেজার আশ্বস্ত করলেন, ভোরবেলা নিশ্চয়ই কেউ ডেকে দেবে।
          এই তিনতলার এদিকের রুমগুলো সব ফাঁকা, তাই করিডরটাও বড় নির্জন। হোটেলের ডাইনিং রুম থেকে রাতের খাবার খেয়ে করিডর দিয়ে হেঁটে ঘরে আসার সময় রজতাভবাবুর এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো, মনে পড়লো কলেজ থেকে শিক্ষামূলক ভ্রমণে যখন দার্জিলিং এসেছিলেন, তখন এরকমই কোনো হোটেলের করিডরে রাত্রে বন্ধু পলাশের সঙ্গে রাতে গল্প করার সময় একটা ছায়ামূর্তিকে হেঁটে যেতে দেখেছিলেন, যদিও সেই সময় থেকেই তিনি ভূতে বিশ্বাস করেন না বলে ঘটনাটা আজ পর্যন্ত কাউকে বলেন নি। 
           এদিকে পৃথাদেবীর তো মাথায় ঢুকে আছে ভূত, লক্ষ্য করলেন পুরো করিডর জুড়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। একটা গা ছমছমে অনুভূতি হতে লাগলো পৃথাদেবীর। করিডরের আলো অত্যন্ত কম, তার মধ্যে দরজার পর্দাগুলো হালকাভাবে উড়ছে। কিন্তু কাউকে কিছু বলতেও পারছেন না। 
           সারারাত না ঘুমোনো পৃথাদেবীর চোখটা সবে একটু লেগেছিল, হঠাৎ দরজার ঠক্ ঠক্  আওয়াজে পৃথাদেবীর ঘুম ভাঙতেই রজতাভবাবুকে ডেকে উনি ফিস ফিস করে বললেন -"ওগো শুনছো।" 
প্রায় মাঝরাত নাগাদ হঠাৎ দরজায় টোকা, সঙ্গে নাকিস্বরে গলার আওয়াজ -"উঁঠুঁন, টাঁইগাঁর হিঁল দেঁখতে যাঁবেন তোঁ। এঁরপঁর দেঁরী কঁরলে আঁর সাঁনরাঁইজ দেঁখতে পাঁবেন নাঁ।"    রজতাভবাবুও নিদ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় পরিষ্কার বুঝতে পারলেন না কথাগুলো, কারণ নির্জন করিডরে প্রতিফলিত হচ্ছে সে আওয়াজ। তাই অত রাত্রে দরজা খোলার রিস্ক নিলেন না। পৃথাদেবী বললেন, -"নিশি ডাকছে, ভূতের ডাক। আমি আর এই হোটেলে এক মুহূর্ত থাকবো না।" রজতাভবাবু ভূতে বিশ্বাস না করলেও তাঁরও ভয় লাগতে শুরু করলো। আরো দুʼএকবার দরজায় আওয়াজের পর আর কোনো সাড়াশব্দ পেলেন না। ছেলে যদিও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পৃথাদেবীর ভয়ার্ত মুখ দেখে রজতাভবাবু টাইগার হিলের পরিকল্পনা বাতিল করলেন। অত রাতেই বৌয়ের জেদে পরেরদিন সকালেই হোটেল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
            সকালে ঘুম থেকে উঠে রজতাভবাবু ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ জানালেন রাত্রে করিডোরে ভৌতিক আওয়াজ পেয়েছেন এবং ভোরবেলা কেন তাদেরকে ডাকা হয়নি, তাও জিজ্ঞেস করলেন। ম্যানেজার তৎক্ষণাৎ ভোলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, -"কিরে,তুই ডাকিস নি?" ভোলা প্রসেনজিৎ স্টাইলে দাঁত চেপে বললো, - "আমি পুরোনো দিনের বিখ্যাত অভিনেতা নবদ্বীপ হালদার স্টাইলে ওনাদের ডেকেছিলাম, কিন্তু ওনারা ওঠেন নি। আমি কি করতে পারি?"
              ম্যানেজার দেঁতো হাসি হেসে বললেন, -"কিছু মনে করবেন না, ভোলা আসলে খুব ভালো মিমিক্রি করে তো, তাই ঐভাবেই লোকজনের সঙ্গে কথা বলে।" পাশ থেকে রজতাভবাবুর বৌ রেগে বলে উঠলেন, -"আ, মরণ, হতভাগা, আর সময় পেলি না, রাত বিরেতে নবদ্বীপ হালদারের কথাই মনে পড়লো তোর।"

বৈশাখী ২০২৪