ফুল পসারিনী। সকাল হলেই গাঁদা গোলাপ জুঁই রজনীগন্ধার স্টিক মালা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বিক্রিবাটা মন্দ হয় না। রাস্তায় বেচতে বেচতে পৌঁছে যায় হাইরোডের পাশে ধাবাগুলোর কাছে। দামি দামি গাড়িগুলোর উইন্ডোর সামনে গলা ফুলিয়ে সুর তোলে- ফুলের মালা লা-গ-বে,,,ফুলের মালা। গোলাপের ইসটিক উপহার দিতে কিনবেন না-কি,,,? একদম তাজা ফু,,ল,,। ছ্যার ম্যাডামের লাগলে ব-ল-বে-ন,,,। ফুলের মালা ইসটিক,, ,, ,,। আজ ডালা এক্কেবারে খালি। সক্কাল সক্কাল সব বিক্রিবাটা হয়ে গেছে। আমিনা ফুল বিক্রির টাকাগুলো কাপড়ের খুঁটে বেঁধে বাড়ি ফেরে। ক্লান্ত শরীর। একটু জিরিয়ে নিতে ঘরের দাওয়ায় এসে বসে পড়ে। বুঝতে পারে বুকের পাশের যন্ত্রণাটা ধীরে ধীরে চাড়া দিচ্ছে। দাওয়ার দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসার চেষ্টা করে, পারে না। বুকে বিঁধে থাকা ছুরিটা আরো চেপে বসে। জানে সেটা টানাটানি করলে বুকের আরো গভীরে ঢুকে ভেতরটা একেবারে ফালাফালা করে দেবে। আমিনা চোখ বন্ধ করে । ছুরির ফলাটা স্পষ্ট দেখতে পায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছুরিটার ধার বেড়ে আরও চকচকে হয়েছে। প্রথম প্রথম ছুরির আঘাতটা সহ্য করতে পারলেও ইদানিং কেটে যাওয়া জায়গাটায় যখন তখন প্রবল রক্তক্ষরণ হয়, আমিনা বুকটা চেপে ধরে, চেপে ধরে মানে ভুলে যেতে চায়। ভুলে যাওয়া কি এত সহজ? তখন তো তার মাত্র দশ বছর বয়স। বুকের ফ্রকটা টেনে ছিঁড়ে সৎ বাপ মুখটা চেপে ধরে। সে তো অনেক চিৎকার করেছিল, চিৎকার করতে করতে একসময় নেতিয়ে পড়ে। তারপর থেকে প্রতিরাতেই চিৎকার করেছে, নেতিয়ে পড়েছে। সৎ বাপের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসে বছিরের কাছে। বছির! টগবগে জোয়ান। গায়ে গতরে ঘোড়ার জোর। আমিনা খুশি হয়েছিল। খুব খুশি। ভেবেছিল – এ ঘোড়ার গাড়ীতে করে তার জীবন বীত জায়েগা। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বুঝতে পারে এ ঘোড়া বিপথগামী। এর হাতে পায়ের খুরে ধারালো ছুরি বসানো। ছুরিটা তার বুকের দিকেই ঘোরানো। বুঝতে পারে এক খন্দ থেকে সে আরেক খন্দে এসে পড়েছে। বছির তার শরীরটাকেই বেচতে চায়। ঘাড়টা শক্ত করে উঠে বসে দেয়াল ধরে । বড় জল তেষ্টা পাচ্ছে। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। সেই সকাল থেকে বেরিয়ে এবার খিদের জ্বালায় পেটেও মোচড় দিচ্ছে। টের পায় শয়তানের নাম করতে না করতেই,,,বছির আসছে। বছির টলতে টলতে এসে চেঁচায় – টাকাগুলো দে হারামজাদী। হাতের পাঞ্জাটা বাগিয়ে ধরে আমিনার মুখের দিকে । বছিরের অন্য হাতটা এগিয়ে যায় আমিনার চুলের গোছার দিকে। আমিনার আজ শক্ত ঘাড়টা কেমন যেন আরো শক্ত হয়ে ওঠে। আমিনা ঘাড়টা সরিয়ে নেয় । বছির টাল সামলাতে পারে না। ওখানেই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। আর উঠতে পারে না। হাত বাড়ায় আমিনার দিকে, করুণ দৃষ্টিতে তাকায় ,তুলে দেওয়ার জন্য বলে। আমিনা অবাক হয়ে দেখে, প্রায় দিনই সে তো এভাবে পড়ে যায় । বছিরই ধাক্কা মেরে তাকে এভাবে ফেলে দেয়। আজ বছির! ছুরির অভিমুখ কি তবে ঘোরে! তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় আমিনা। গুনেগুনে দেখে আবার আঁচলে বাঁধা টাকা কটা। সকালের সেই ফুলের গন্ধ লেগে আছে টাকা কটার গায়ে। বুক ভরে শোঁকে সেই গন্ধ । এবার আঁচলটা কোমরে বেঁধে ঘরের ভেতরে ঢুকে আসে। আহা! এতক্ষণে বুকের যন্ত্রণাটা একটু কমে আসছে । এই প্রথম আমিনা বুঝতে পারে জগতে অস্ত্রের ধার নয়, অস্ত্র প্রয়োগের ধারই বেশি,শুধু প্রয়োগের কৌশলটা ঠিকঠাক জানতে হয়।।
2 Responses
ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ ।