দেরি

পূর্ব বর্ধমান

  
ময়ূখকে ছেড়ে দিলেও, বিবাহিতার চিহ্নগুলো ভীষণভাবে জড়িয়ে রেখেছিল নিজের সঙ্গে। ময়ূখের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সদ্য ত্যাগ করেছে সেগুলো। আয়নার সামনে কয়েকদিন পর আজ নিজেকে দেখছিল হিমিকা। কেমন যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা অবয়বে। ময়ূখ যে দূরে থেকেও এতখানি জুড়ে ছিল, আগে অনুভব করেনি হিমিকা। 
তিথি, দুটো মাত্র অক্ষর। অথচ কি যে তার তীব্র দহন জ্বালা, সে শুধু হিমিকাই জানে। নামটুকুতেই কয়েক ছটাক রক্ত  ছলাৎ করে ওঠে হিমিকার বুকে। এই নামটাই ওর সাজানো জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছে। ময়ূখকে নিয়ে অধিকারের টানাপোড়েনে যায়নি। সবটুকু ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল বাবার কাছে। শুধু আইনি মুক্তিটুকু দেয়নি ময়ূখকে।
সেইজন্যই বোধহয় ওদের বিয়েটা হয়ে ওঠেনি। তিথিকে নিজের বাড়িতে এনে তোলাও হয়নি ময়ূখের। কিন্তু তাতে কি! বিয়ে না করেও তো স্বামীর-বাবার সব দায়িত্ব পালন করে গেছে ময়ূখ। এতদিনে কখনও তো আসেনি হিমিকার সঙ্গে দেখা করতে। আজ যে কেন এসেছে সে ভালো করেই আন্দাজ করতে পারছে হিমিকা। ওদের বিয়েই যখন হয়নি, তখন তিথির আগের পক্ষের সন্তান তো আর ময়ূখের সম্পত্তির ভাগীদার নয়। সবকিছুতে অধিকার শুধু হিমিকার। তাই আজ ছেলের জন্য ময়ূখের সম্পত্তির অংশ ভিক্ষা করতে এসেছে হিমিকার কাছে। মনে মনে একটা পরিতৃপ্তি অনুভব করে হিমিকা। হেরে গিয়েও জিতে যাওয়ার একটা চাপা আনন্দ।

-কি গো, কী অত ভাবছ তখন থেকে! কে গো ঐ মেয়েটা? অনেকদূর থেকে এসেছে মনে হল, বসার ঘরে বসতে বলি ওকে?

বীণাদি বহুবছর হল এই বাড়িতে আছে। বাবা মারা যাওয়ার পর হিমিকার সর্বক্ষণের একমাত্র সঙ্গী। হিমিকার জীবনের ঘটনাও সব জানে। তবু এখন কি বলবে বীণাদিকে? বলবে যে ঐ মেয়েটা ওর সতীন হয়! 

-বসাও গিয়ে, আমি আসছি। 

অল্প কথায় বীণাদির প্রশ্নকে এড়িয়ে যায় হিমিকা।

তিথিকে আগে একবারই দেখেছিল, নীহারদার সঙ্গে। অনেক বছর পর আজ আবার তিথিকে দেখল। হালকা সবুজ শাড়িতে, বিষাদের প্রতিমূর্তি। নিজেকে তিথির সাথে তুলনা করবে না ভেবেও আলগোছে নিজেকে একবার দেখে নেয় হিমিকা। 

-কি দরকারে এসেছ বলো?

আপনি বলাটাই বোধহয় সৌজন্য ছিল। কিন্তু ময়ূখের আইনত স্ত্রীর অধিকারে আর তিথিকে হেয় করার জন্যই তুমি সম্বোধন করে হিমিকা।

চুপ করে থাকে তিথি, কি যেন ভাবছে।

-যা বলার চটপট বলো। 

একটু রূঢ় ভাবেই বলে হিমিকা। একটু একটু করে যেন সে ধৈর্য্য হারাচ্ছিল ।

-বলেই ফেলো কি বলতে এতদূর এসেছ। ময়ূখের পর এবার নজর পড়েছে ওর সম্পত্তির ওপর। আর তাই এসেছ....

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে হিমিকার দিকে এগিয়ে দেয়।

মুখ আঁটা একটা সাদা খাম।

-খামটা আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার দায়িত্ব ছিল।

ময়ূখের লেখা চিঠি।


হিম, 

     নীহার আমার ছোটবেলার বন্ধু ছিল। ওর মৃত্যুশয্যায় কথা দিয়েছিলাম, ওর বৌ-ছেলেকে দেখব। সেই দায়িত্বটুকুই পালন করেছি মাত্র। হয়ত তোমাকে বলতাম, সুযোগটুকুও দাওনি আমাকে। আমার প্রতি তোমার সামান্য বিশ্বাসটুকুও যেখানে নেই, সেখানে নিজের সততা প্রমাণ করতে যেতে আমারও বিবেকে বেঁধেছিল। মাঝখান থেকে আমাদের সংসারটাই হল না। চলে যাওয়ার আগে মনে হল, কথাগুলো তোমাকে বলে যাই। অবশ্য তুমি যখন সব জানবে, আমি তখন অনেক দূরে। ভালো থেকো।

            ---- তোমার ময়ূখ


কী জানি কতক্ষণ চিঠিটাতে ডুবে ছিল হিমিকা। চোখ তুলে দেখে তিথি চলে গেছে। ছুটে বাইরের বারান্দায় যায় হিমিকা। ওই তো ধীর পায়ে চলে যাচ্ছে তিথি। ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারে না হিমিকা। কান্নায় গলাটা বন্ধ হয়ে আসছে।

-আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে! খাবে চলো। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেল।

বীণাদি কেন, কাউকে বোঝাতে পারবে না হিমিকা, সত্যিই অনেক দেরি হয়ে গেছে....

বৈশাখী ২০২৪