সিপাহীগঞ্জের গ্রন্থাগার

দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান

  
সন্ধ্যার আড্ডায় সবাই বেশ চিন্তায় পড়লেন, চিন্তার কারণ চারিদিকের অসামাজিক কার্যকলাপ। চুরি ছিনতাই এখন যেন নিত্যদিনের ঘটনা এই সিপাহীগঞ্জ গ্রামে।  তার উপর মদ গাঁজায় আসক্তি দিনে দিনে শেষ করে তুলেছে যুব সম্প্রদায়কে। চারজন বৃদ্ধ সেই অতীতের সোনালী দিনগুলোর কথা ভেবে হতাশায় ভুগছেন, তাদের গ্রামের ইতিহাস প্রায় সবার জানা,বহু স্মৃতি আছে এই গ্রাম জুড়ে,এই গ্রামের নামে আছে ইতিহাস,সালটা ১৮৫৭ সাড়া দেশ জুড়ে সিপাহী বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে, ঠিক সেই সময় এক সিপাহী লুকিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল এই গ্রামে,তারপর অবশ্য তার প্রাণ রক্ষা হয় নি,এই গ্রামের মাটিতে শহীদ হতে হয় তাকে। তখন থেকেই এই গ্রামের নাম হয় সিপাহীগঞ্জ। এই গ্রামের জমিদার দ্বিজেন রায় চৌধুরী খুব ভাল মানুষ ছিলেন, তার ছেলে বিকাশ রায় চৌধুরীও ছিলেন শিক্ষিত মানুষ, তিনি নিজের উদ্যোগে এই গ্রামে একটা গ্রন্থাগার স্থাপন করেছিলেন, একটা সময় ছিল সন্ধ্যায় এই গ্রন্থাগারে বসার জায়গা পাওয়া যেত না, আজ সেই সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র চারজনে। জমিদার বাড়ির শেষ বংশধর শিশির রায় চৌধুরী তাদের মধ্যে একজন। বাকীরা হলেন গ্রামের বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক অতুল চ্যাটার্জী,সদ্য অবসর প্রাপ্ত পোস্ট অফিসের ম্যানেজার অনিল চট্টোপাধ্যায় এবং গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান সুনীল দত্ত। সুনীল বাবু প্রায় হতাশ হয়ে গ্রামের অবনতির কথাটা সবাইকে বললেন, বাকিদের কাছ থেকে পরামর্শ চাইলেন,কী করে শান্তি ফিরিয়ে আনা যায়, তার আর সেই গায়ের জোর নেই, যে কটা ভালো লোক আছেন তারা বিরক্ত হয়ে শহরে পাড়ি দেয়ার কথা ভাবছেন, পুলিশকে অনেক বার তিনি অভিযোগ জানিয়েছেন কোনো লাভ হয়নি। অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা চলতে থাকল, কিন্তু কোনো উপায় তারা সেইদিন বের করতে পারলেন না। সবাই সেই দিনের মতো বাড়ী ফিরে গেলেন। শিশিরবাবু সারারাত ধরে ভাবলেন, ছোটোবেলা থেকে দেখে এসেছেন তার বাপ ঠাকুরদা গ্রামের বিপদে কিভাবে সবার পাশে দাড়িয়েছেন,তাই তিনি সারা রাত চিন্তা করে একটা ফন্দি আঁটলেন।
পরেরদিন সন্ধ্যেয় সবাই আবার একসাথে আড্ডায় যোগ দিলেন,শিশিরবাবু তাদের একটা উপায় বললেন,সেটা হল গ্রন্থাগার। সবাই অবাক হয়ে তাকে  জিজ্ঞেস করলো এই পুরোনো বইয়ে ভর্তি, যেখানে কেউ একবার ভুল করেও আসে না এই চত্বরে, এই গ্রন্থাগার কি করে গ্রামের পরিবেশ ঠিক করবে?, শিশির বাবু তাদের একটা উপায় বললেন সেটা শুনে সবাই রাজি হলেন। 
পরের দিন থেকে চারজন মিলে লেগে পড়লেন। প্রথমে সবার অজান্তে গ্রন্থাগারের একটা ইন্সুরেন্স করা হলো, প্রায় দু হাজার বই তার জন্য শিশিরবাবু মোটা অংকের টাকা খরচ করলেন কিন্তু  সেটা গ্রামের বাকী লোকজন জানতে পারল না, তারপর এক সপ্তাহ পর তারা গ্রামে একটা গুজব রটে গেল সেটা হলো জমিদার বাড়িতে গুপ্তধন আছে, আর সেই গুপ্তধনের নকশা লেখা আছে সেই গ্রন্থাগারের কোন এক বইয়ের পাতায়, তারপর শুরু হলো লোকজনের যাতায়াত,ছেলে ছোকরার দল চুরি ডাকাতি ছেড়ে মনোনিবেশ করলো সেই দিকে, গুপ্তধনের নেশায় মদ গাঁজার প্রতি আসক্তি কমে এলো।তারপর সপ্তাহ দুয়েক কেটে গেল গ্রামের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাড়ালো সেই গ্রন্থাগার, আলোচনার সঙ্গে গুজব আরো বেশি রটে গেল। তারপর  প্রায় মাস খানেক পর একদিন সেটাই ঘটলো যেটা শিশিরবাবুরা চেয়েছিলেন, কারা যেন চুরি করে নিয়ে গেল গ্রন্থাগারের সব বই, সিপাহীগঞ্জ শান্ত হল,যে যুব সমাজ এতদিন ব্যস্ত ছিল অসামাজিক কার্যকলাপে তারা এখন গুপ্তধনের সন্ধানে বই পড়তে ব্যাস্ত যদি নকশার খোঁজ পাওয়া যায়, দু হাজার বই পড়তে বছর কেটে যাবে, শিশিরবাবু বিশ্বাস করেন সব বই পড়ার পর তারা সত্যিই একদিন গুপ্তধনের সন্ধান করতে পারবে। এক বছরের মধ্যে গ্রন্থাগার নতুন করে সেজে উঠল নতুন বইয়ের গন্ধে,এখন সন্ধ্যাবেলায় গ্রন্থাগার ভর্তি থাকে মানুষের ভিড়ে, সিপাহীগঞ্জের মানুষ এখন বেশ নিরাপদ।

বৈশাখী ২০২৪