অঙ্গজ

 
অনেক আগের কথা। যখন আমি ছোটটি ছিলাম তখনের কথা। যে সময় শিউলি ফুটলে আকাশ নীল হত, সেই ফুলের গন্ধ জমে জমে ক্ষীরের মত কাশ ফুল ফুটত, সেই সময়ের কথা। 
 
পুজো আসছে। সন্ধ্যে নামলেই রাক্ষস খোক্কসের দল অনেকটা ভয় নিয়ে নেমে পড়ত আমার মনের মধ্যে। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত এলে শীত ধরত খুব। মা লাল হলুদের ঢেউ তোলা সোয়েটার পরিয়ে দিয়ে বুকের কাছে আমার মুখ টেনে নিয়ে বলত,
 
সাবধান। এই বাড়ি আর উঠোন ছেড়ে কোথাও একা একা বেরোবে না। দীঘিতে আছে মেছো, আর গাছে আছে গেছো। বুঝেছ?
 
না বুঝে উপায় নেই। মাকে বলতাম হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতে। সেই নরম দুটো হাত, দশ হাত হয়ে আমাকে অজানা মেছো-গেছোর বিপদ থেকে আড়াল করত। টের পেতাম পুজো আসছে। বছরের এই সময় আমার মায়ের দশ হাত, দশ দিক, ছয়টা ঋতু, বারো মাস, শুক্ল আর কৃষ্ণ পক্ষ সবাই আমাকে রাজ্যের ভূত-পেত্নী, ব্রহ্মদত্যি, রাক্ষস-খোক্কস থেকে রক্ষা করত। 
 
তবে কী দিনের বেলা, আমার সাহস যেত বেড়ে। এমনই এক দুপুরে ঘরের দরজা খুলে নেমেছি উঠোনে। এর পর মাটির ঘরের পিছনে যে শিউলি গাছটা আছে, তার নীচে এসে দাঁড়িয়েছি। দেখি তখনও অনেক শিউলি মাটিতে ঝরে পড়ে রয়েছে। তবে সাদা নয়। তাদের পাপড়ি হলুদ হয়ে এসেছে। আর হবেই বা না কেন? সারা রাত চাঁদের আলোয়, তারা ধোয়া জলে ওরা নীলচে সাদা হয়ে থাকে। আর দিনে অত বড় সূর্যের হলদে আগুনে পুড়তে হয়। আমার মনে হত, শিউলি আছে বলে মা আছে। আছে এই যত চাঁদ, তারা, সূর্য। আমি আছি। আমার এই গ্রাম আছে। সব যা আছে, এই শিউলি ফুলের গন্ধে গন্ধে তৈরি হয়েছে।
 
একটা, দুটো, তিনটে করে ফুল কুড়োই। হঠাৎ দেখি একটা ফুল তখনও ধপধপে সাদা। সিঁদুরের মত রাঙা তার বোঁটাখানি। ঝুঁকে পড়ে দু আঙুলে ধরতে যাব অমনি ফুল সরে গেল। কী হল? এমনতর মজা শুধু গাছের পাতায় ঠোক্কর খাওয়া বাতাসের ঝাঁকই করতে পারে। কিন্তু হাওয়া তো চুপ। আবার ধরতে যাই। নাহ ! এবার ফুল আরও এগিয়ে যায়। এই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা চলতেই থাকল। অনেক সময় নিয়ে। কখন যে বাড়ির উঠোন পার করে রমনা দীঘিকে বেড় দিয়ে বটের থানের কাছে এসে পড়েছি, মালুম হয়নি। এবার বেশ ভয় ভয় করতে লাগলো। শিউলি ফুল থাক গে। চাইনা আমার।
 
রানা, ভয় পেয়ো না। এদিকে তাকাও। 
 
কে কথা বলে? চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখি মানুষের চিহ্ন মাত্র নেই। শুনেছি ভূতেরা ভূত হবার আগে মানুষ থাকে। তাই মানুষের মত কথা বলা তাদের জন্য খুব কঠিন নয়। তবে অপ্রয়োজনে বলে না অবশ্য। সর্বনাশ! তবে কি গেছো? না না মেছো? না না গেছো... ধুর। কার পাল্লায় পড়লাম? 'মা' বলে চিৎকার করতে যাব, এমন সময় শুনি,
 
নীচে তাকাও। আমি শিউলি ফুল বলছি।
 
শিউলি ফুল? সে আবার কথা বলে কী করে? তবে কি...? 
 
ভয় পেয়ো না। তুমি যা ভাবছো তা আমি নই।
 
এবার সাহস করে মাটির দিকে তাকালাম। সেই শিউলি ফুলটাই তো কথা বলছে। আশ্চর্য! ফুল কখনো কথা বলে? ভয়ে ভয়ে বললাম,
 
তুমি তো ফুল। কথা বলো কী করে?
 
ফুল সেই কথা শুনে হেসে ফেলল। তবে সে হাসি গড়াগড়ি যাওয়ার মত নয়। থেমে থেমে। অনেকটা আমার বাবার মত গম্ভীর হাসি।
 
পৃথিবীতে যা কিছু দেখো, বুঝতে পারো, সবাই তারা কথা বলে। তবে সব মানুষ শুনতে পায় না।
 
এ আবার কেমন ধারার কথা? আমাদের উঠোনে রুন্টুর মা যে ওর একগাদা ছেলে মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সেকি কথা বলতে পারে? ওহ রুন্টুর মা কে সেটাই তো বলা হয়নি। ও হল মা মুরগি। আমাদের বাড়ির দুটো বাড়ি ছেড়ে সানোয়ার চাচা থাকে। ও হল তাদের পুষ্যি। চাচার ছেলের নাম হল রুন্টু। তাই আমি ওকে রুন্টুর মা বলি। 
 
হ্যাঁ। রুন্টুর মা কথা বলে। না হলে ওর ছেলে মেয়েদের শাসন করে কী করে? বেয়াদপি করলে কী বকান বকে। বাবা রে !! ফুল বলল।
 
এখন আর সেরকম ভয় লাগছে না। বরং আরও বেশি করে অবাক হচ্ছি। মনের কথা তো মনেই থাকে। আমার মা ছাড়া সেই কথা কেউ জানতে পারে না। এমনকি আমার বাবাও নয়। তাহলে ফুল কী করে জেনে ফেলল? 
 
রানা, পৃথিবীতে যত শিউলি ফুল ফোটে তাদের সবার রাজা আমি। আমাদের সুগন্ধ দিয়ে মানুষের মন তৈরি হয়েছে। এমনকি চাঁদ, নদী, সাগর, বাতাস সবার মন। 
আর ভূতেরা?
 
এবার কিন্তু আওয়াজ করে হাসতে শুরু করল শিউলি ফুলেদের রাজা। বলল,
 
শুয়োপোকা থেকে যেমন বাহারি প্রজাপতি বেরোয়, ঠিক তেমন ভূতেরা মানুষ জন্মের খারাপ কাজের শাস্তি পেয়ে যখন ভালো হতে চায়, তখন তারা শিউলি ফুল হয়ে গাছে গাছে ফোটে। স্বর্গের ভগবান এরপর অনেক অনেক ভেবে কিছু ফুলকে আবার ভাল মানুষ করে পৃথিবীতে পাঠান। এত দেখছি বেশ বড়সড় কান্ড! ভগবানের কত কাজ!
আচ্ছা, ভগবান কি ভাবেন?
সে খবর আমার কাছে নেই। বিধাতার মন কেইবা পড়তে পারে? 
 
তা হবে হয়ত। আর কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। এবার আমার ফিরতে হবে। মা ঘুম ভেঙে উঠে পরলে আমি গেলাম।
 
ওই বটের থানের নীচে গিয়ে দাঁড়াও তো বাপু। তোমাকে উপহারটা দিয়েই দিই...
আমার জন্য উপহার? কে দেবে? তুমি?
হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ। এখন যাও। গিয়ে দাঁড়াও।
 
বটের ঝুড়ি বেঁধে যেখানে দোল খায় দাদা দিদিরা ঠিক তার পাশে এসে দাঁড়ালাম। কই, কিছুই তো রাখা নেই ...
মাটির নিচে আছে। মাটি খুঁড়ে বার করো।
ও মা! আমি মাটি খুঁড়ব কি করে?
চোখ চেয়ে দেখো না বাপু। পাশেই তো চ্যাপ্টামতো ছোট্ট পাথর পড়ে আছে। ও দিয়েই কাজ চালাও। 
 
তাই করলাম। শিউলি ফুল যে জায়গা দেখিয়ে দিয়েছে, ঠিক সেখানেই মাটি খুঁড়তে শুরু করলাম। খুপ খুপ আওয়াজ হয় আর ঝুপ ঝুপ করে ঝুরো মাটি অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে দুপুরের রোদে আড়মোড়া ভাঙে। যেন বেড়ে ঘুমোচ্ছিল। আমি দিলাম কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে। 
 
হাত ব্যথা করছে?
তা একটু করছে। 
তা ভালো। জগতের সব আশ্চর্য উপহারের জন্য ব্যথা পাওয়া ভালো। 
মহারাজ, তুমি যে কী বল, বুঝি না!
 
শিউলি মহারাজ বলে, 
 
 পাখির ছানার চোখ যখন প্রথম ফোটে, তখন তার কী কিচকিচানি। অন্ধকারে ছিল, এবার আলোর দেশ দেখে ছানার কী কষ্ট, কী ভয়! ওর মা ওকে বলে বাছা, ডিমের ভেতরে ছিল অন্ধকার। এখন চোখ ফুটেছে তোর। একবার চেয়ে দ্যাখ কত্ত বড় আকাশ। সেই আকাশে খুশিমত উড়লেই হল। সাত সাগর আর তেরো নদী জুড়ে যতটা আলো, যতটা আঁধার আছে এখন থেকে সব তোর। প্রকান্ড প্রকান্ড দেশের সব নদীর চর তোর। ডিমের ভিতরে যা পেয়েছিস, একবার চোখ খুলে দেখ, এখানে তার থেকেও বেশি কিছু আছে।
পাখির ছানা ওর মার কথা শুনে চোখ মেলে দেখে?
বাহ্‌ রে! দেখবে না। ডিমের ভিতরেও মা, ডিমের বাইরেও যে মা।  
হু। 
 
আমি গম্ভীর ভাবে বলি। মহারাজের সব কথা বুঝিনি, তবে খুব আনন্দ হচ্ছে। এইবার হাতে কিছু ঠেকল মনে হয়। হু। ঠিক। কি একটা যেন বেশ।
 
হয়েছে। এবার সাবধানে বার করে নিয়ে এস। পুকুরের জলে ধুয়ে ফেল। 
 
হাতে উঠে এলো একটা ফুটো ফুটো গোল লাঠি। খুব সাবধানে এঁদো পুকুরের ভাঙা ঘাটের ভাঙা সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলাম। জলে চুবিয়ে ধুলাম সেই লাঠি। ধুতে ধুতে দেখি আমার ছবি জলের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। আমি শান্ত হয়ে বসে দেখছি, কিন্তু তখনও আমার যে ছায়া ছায়া ছবি জলের ভিতরে ডুবে আছে, সে কাঁপছে। ভাবি এ কেমন হল? আমি চুপ, তাহলে আমার ছবি কেন কাঁপে?
 
উঠে এস। 
হ্যাঁ আসি।
 
সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছি যখন ঠিক তখন শিউলি মহারাজ বলছে শুনি,
 
তুমি হলে ভগবান, আর তোমার প্রতিবিম্ব হল তুমি। যেদিন তুমি আর তোমার প্রতিবিম্ব একসাথে শান্ত হবে সেদিন বিধাতা পুরুষকে প্রশ্ন করো, তিনি কি ভাবেন।
 
এইসব কঠিন কথা আমি কিছুই বুঝিনা। ফুলের গন্ধের মত দুনিয়ার সব খবর আমার জানা নেই। তবে ফুল হতে পারলে ভারি ভালো হত। ভয় একটাই। একদিন পরেই তো ঝরে যেতাম। মা তখন খুঁজে পেত না আমায়। কেঁদে কেঁদে চোখ ফোলাতো। থাক বাবা। মানুষ থাকাই ঢের ভালো।
 
একবার এই লাঠির ওপর ফুঁ দিয়ে দেখো তো। 
 
ওমা! ফুঁ যেই দিয়েছি ওই ম্যাড়মেড়ে কালো লাঠি ময়ূররঙা হয়ে উঠল। কি তার গভীর নীল রঙ, কী তার চোখ জুড়ানো সবুজ। আহা। এমন লাঠি আমার কোন বন্ধুর নেই। এবার খেলার সময় আমিই রাজা হব।
 
রানা, এই হল জাদুর লাঠি।
সত্যি?
হ্যা, তিন সত্যি। ফুলের রাজা কখনো মিথ্যে বলে না।
কি জাদু আছে, এই লাঠিতে?
ওই যে গোল গোল ফুটো দেখছো, তাতে একবার ফুঃ দিলে পাখির ভাষা, ফুলের কথা, বাতাসের গল্প, সাগর-নদীর দুঃখের কথা সব শুনতে পারবে। চাঁদ তার জোছনার সাথে কী কথা বলে, সূর্যের তেজ বয়ে নিয়ে চলা সপ্তরথের সাতটি ঘোড়া নিজেদের মধ্যে কী বলা কওয়া করে সব শুনতে পারবে। তবে মনে রেখো, মানুষের মুখের কথা আর মনের কথা আলাদা আলাদা। খবরদার সেই মনের কথা শোনার চেষ্টা কখনও করবে না। কি মনে থাকবে?
 
আমি আবার ভয় ভয় পাচ্ছি। আমি ঘাড় কাৎ বললাম ঠিক আছে। তবে সন্দেহ হচ্ছে এই লাঠির কি সত্যি জাদু ক্ষমতা আছে? শিউলি মহারাজ অন্তর্যামী। হেসে বলল,
 
পরীক্ষা করে দেখ। 
 
আমি তাই চাইছিলাম। কিছু না ভেবেই দিলাম প্রথম ফুটোয় ফুঁ। অমনি শুনি, আমার পাশেপাশে বয়ে চলা বাতাসের দল বলছে,
 
রানা ঘরে ফিরে যাও। তোমার মা শাড়ির আঁচল উড়িয়ে, কোঁকড়ানো চুল বাতাসে উড়িয়ে তোমায় খুঁজছে। দেরি করো না। 
 
আমার এবার খুব কষ্ট হল। আমি শিউলি ফুলের রাজাকে বললাম,
 
চললাম মহারাজ মায়ের কাছে।
 
মহারাজ বলল, তাই ভালো। যাও যাও।
 
আমি বটের থানকে ফেলে রেখে, রমনা দীঘিকে কিচ্ছুটি না বলে দৌড়োচ্ছি। সামনে আমাদের বাড়ি, তার মাটির উঠোন দেখা যাচ্ছে। ওইতো মা দাঁড়িয়ে আছে। মা কে দেখে প্রথমে কষ্ট হল, তারপর হল ভয়। আজ বোধহয় দু তিন ঘা আমার কপালে বাঁধা আছে। তবু না থেমে মাকে গিয়ে জাপ্টে ধরলাম। অবাক কান্ড। মা আমাকেও কোলে তুলে কি আদরটাই না করল। এরপর কোল থেকে মাটিতে নামিয়ে ধরা গলায় বলল,
 
কোথায় গিয়েছিলি? আমাকে না বলে?
শিউলি মহারাজের সাথে বটের থানে...
 
মা আশ্চর্য হয়ে বলে,
 
শিউলি মহারাজ? সে আবার কোন মহারাজ?
ফুলেদের রাজা। তিনিই তো এই উপহার আমায় দিলেন।
 
মায়ের চোখ পড়ল আমার হাতে ধরা গোল লাঠির ওপর।
 
ওমা ! এ যে মোহন বাঁশি। ঠিক করে বল, কোথা থেকে কুড়িয়ে এনেছিস?
 
মাটির উঠোনে লাল কাপড়ের পাড় সেলাই করা আসনে বসে মা কে সব বললাম। আমি যে মিছে কথা বলিনা, মা জানে।
 
চোখ বড়ো বড়ো করে মা বলল,
 
সত্যি? তবে তো দেখতে হচ্ছে ব্যাপারটা। 
 
আমার চোখের সামনেই রুন্টুর মা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল। তাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম, 
 
রুন্টুর মা ওর ছানাদের কি বলছে জানতে চাও?
হ্যাঁ! দেখি তোর ভেল্কি!
 
দ্বিতীয় ফুটোয় ফুঁ দিলাম। শুনি রুন্টুর মা বলছে,
 
বাছারা চল পেঁপে গাছের পাশে। ওখানে পিঁপড়ের ডিম দিয়ে মহাভোজ হবে !
 
মা কে বললাম। মা হাসি চেপে তাকিয়ে রইল। তবে খুব বেশিক্ষণ নয়। একটু পরেই মুরগির দল পেঁপে গাছের নিচে জড়ো হয়ে খুঁট-খুঁটিয়ে কি সব খেতে শুরু করল।
মায়ের মুখ তখন দেখবারর মত। আসন ছেড়ে, আমার হাত ধরে বলল,
 
চল তবে ডোবার ধারে। শোন তো, বুড়ো কাতল কি বলে !...
 
আমাদের বাড়ির এঁদো ডোবায় শুনেছি একটা ইয়া বড় কাতলা মাছ আছে বহুবছর ধরে। বাবা যখন বাবা হয়নি তখন ওকে এই ডোবা জলে ছাড়া হয়েছিল। এখন বাবার চুলে হল সাদা রং লেগেছে আর কাতলা মাছের গায়ে শ্যাওলা জমে সবুজ হয়েছে জম্পেশ। তবে সবই শোনা কথা। আমি নিজের চোখে কিছুই দেখিনি।
 
ডোবার ধারে এসে কাতলা মাছকে স্মরণ করে দিলাম তিন নম্বর ফুটোয় জোরসে ফুঃ। শুনলাম ওই বুড়ো কাতলা জল হিলিয়ে বিলিয়ে ভাঙা স্বরে বলছে,
 
বাছারা শুনে নাও এখন। কথা অগ্রাহ্য করলে আজ রাতে বিপদ খুব। রমনার দীঘি থেকে হলুদ খোপের কাছিম আজ রাতেই এই ডোবায় নামবে মাছের লোভে। শিউলি গাছের শুকনো পাতা এই মাত্র ডোবায় ঝরে পড়ে, খবর দিল। ডোবার পুবে যেখানে মাটির সুড়ঙ্গ আছে, তার ভিতরে তোমরা জড়ো হয়ে থাকবে সব। ওর সাধ্যি নেই, তার ভিতরে ঢোকে। কিছুক্ষন আছাড়ি পিছাড়ির পর খালি পেটেই শত্তুর ছেড়ে যাবে এই ডোবা। কি মনে থাকবে তো?
 
আমি মাকে বললাম। বলতে বলতে আমারও খুব ভাবনা হল। আহারে, ওই মাছেদের লিলিপুট বাচ্চাগুলোতো আমার মতই মা ছাড়া থাকতে পারে না। আজ রাতে এমন বিপদে ওদের কি হবে?
 
ঠিক আছে। তুই আমি দুজনে মিলে জানালা দিয়ে ডোবার দিকে নজর রাখব।  দেখি তো কী হয়।
 
এরপর সূর্য ডুবল। দিনের আকাশ লাল হতে হতে কালো হল। মস্ত বড় চাঁদ উঠল। সেই চাঁদের অনুপম আলোয় সব দেখা যাচ্ছে। শিউলি ফুল, পেঁপে গাছের হলদে পাতা, আকন্দর ঝোপ, সব কিছু। আমরা দুজন জানালার কপাট খুলে চোখ মেলে অপেক্ষায় আছি। বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ঝপ্‌ করে আওয়াজ হল। ডোবার জল গোল গোল হয়ে ছড়িয়ে পরল। মা আমাকে বুকে চেপে বলল,
 
ওই তো রে। কাছিম টা জলে নামল। 
 
কচ্ছপকে কাছিম বলে তা আমি জানতাম। বললাম,
 
কৈ কৈ?
জলে ডুব দিয়েছে এতক্ষনে। আর দেখে কাজ নেই। আয় জানালা বন্ধ করি...
 
আমার ইচ্ছে ছিল, কি হয় দেখবার কিন্তু মায়ের কথার ওপর তো আর কথা চলে না। তাই চুপ করে থাকি। সেই রাতে মা রাতের খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়ানোর জন্য শুইয়ে দিল। মা কে আমি জড়িয়ে শুই। সাত রাজার সাত রাজ্যের সাতশো গল্পের যে সিন্দুক, তার ঝাঁপি খুলে মা আমাকে রোজ একটা করে গল্প বলে। রোজ রাতে নতুন নতুন গল্প। মা বলেছে, যেদিন এই গল্পের সিন্দুক ফাঁকা হয়ে যাবে, সেদিন নাকি আমি বাবার মত বড় হয়ে যাব, আর মা হবে বুড়ি। তাই আমি রোজ রাতে গল্প শুরুর আগে, ভগবানকে বলি, এই সিন্দুক যাতে কোনদিন খালি না হয়। জানি না ব্যস্ত ভগবান আমার কথা শোনে কি না। 
 
আজ যেমন মা গল্প বললো না, আমিও শুনলাম না। মোহন বাঁশির কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
 
ওরে ওঠ এবার। সকাল শেষ হয়ে দুপুর আসছে যে...
 
চোখ খুলে দেখি, সত্যি তো। সকালের আলোয় রোজ যে জানালার চার কাঠির ছায়া বিছানার উপর দেখি, আজ তাতে দুটো কাঠি নেই। বড্ড দেরি করলাম।
 
হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নে আগে। তোর সাথে কথা আছে।
 
এভাবে তো মা কোনদিন বলে না আমায়। এমন ভাবে শুধু বাবার সাথে কথা বলে। তবে আজ কেন আমার সাথে.... ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল মোহন বাঁশির কথা।
 
মা, আমার বাঁশি?
ঠাকুরের সিংহাসনে তুলে রেখেছি। এখন এসব কথা নয়। পরে হবে খন।
 
দুধ আর চিঁড়ের সাথে কলা মেখে দিয়েছে মা। আমার খুব পছন্দের। কিন্তু আজ যেন মন বসছে না। কোনমতে জলখাবার শেষ করে মায়ের গা ঘেঁষে বসি। রান্নাঘরে মাটির উনুনের ভিতর গনগনে আঁচ উঠেছে খুব। শিবেন কাকা আস্ত রুই দিয়ে গিয়েছে। তার মানে আজ বাবা ফিরবে। আমার বাবা দূরের কোন এক শহরে কি যেন এক কাজ করে। হপ্তা শেষের প্রতি শনিবার বিকেল নাগাদ বাড়ি ফিরে আসে। আমার আনন্দ হয়। মা খুব হেসে হেসে জোরে জোরে কথা বলে। আস্ত রূইয়ের ঝাল রান্না করে মা। সাথে সোনা মুগের ডাল। আলু ভাজা। তবে ডালের নাম কেন সোনা হল বুঝিনা। মা কে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করিনি। যদি বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে হেসে কুটোপাটি হয়! ছোট হলে হবে কি, আমার আবার লজ্জা করে খুউব। 
 
বাবা আমাকে রেলগাড়ির গল্প শোনায়। ঘরের সাথে ঘর জুড়ে, সেই ঘরগুলোর নিচে রথের চাকা লাগিয়ে কি করে রেলগাড়ি উহু উহু করতে করতে মাঠ ঘাট পার করে তার গল্প। সবাই নাকি চুপ করে বসে থাকে সেই ঘরের ভিতর।  ইস্‌স্‌ আমাদের এই ঘরের সাথে যদি চাকা লাগানো থাকত তবে রাত হলেই চাঁদের বাড়ি যেতাম। ঘুরে ঘুরে দেখতাম। আর সূর্য ওঠার আগেই হাত ভর্তি সাদা বালি নিয়ে ফিরতাম।  এমনটা যদি সত্যি কোনোদিন হয় ‌!!
 
কি রে? এখানে এসে বসলি? আজকে মাটি ঘাটা বন্ধ?
না বন্ধ না। আমি বলছিলাম কি, ওই মোহন বাঁশিটা দাও না মা। 
এখানে চুপ করে  বসে থাক। আসছি আমি। 
 
মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়। শুনতে পাই কুয়োতলায় মা হাত ধুচ্ছে। এরকম সময়  শাঁখা আর লোহার চুড়িতে যে শব্দ হয় তা আমার সবচেয়ে প্রিয়। 
 
তোকে যে কথাটা বলব, মন দিয়ে শুনবি তো?
হ্যাঁ, শুনবো।
 
মা আঁচলে হাত মুছে, চোখের সামনে লুটিয়ে থাকা কোঁকড়া চুল সরিয়ে আমাকে কোলে নিয়ে বসল। এরপর বলল,
 
মোহন বাঁশি যদি ভেঙে যায়, সিঁদ কেটে চোর চুরি করে পালায়, আগুন যদি পুড়িয়ে ফেলে, জমিদার যদি কেড়ে নেয়, রঘু ডাকাত যদি ছিনিয়ে নেয়, তখন তুই এই আকাশ বাতাস, ফুল ফল, দীঘি নদী সাগরের কথা বুঝবি কি করে? পাখিরা কেন সূর্যের আলোর রেনু ধরে উত্তর থেকে পুবে উড়ে যায়, বৃষ্টিতে কেন কচি পাতা কাঁপতে থাকে, বাঁশের বনে ঝিঁঝিঁ পোকা কেন ঝিঁঝিঁ করে তা জানবি কি করে?
 
আমি বললাম, 
 
কি করে?
 
মা বলল, তখন তো আর উপায় থাকে না। তাই বলি কি শিউলি মহারাজকে ডেকে এই বাঁশি ফিরিয়ে দে। 
 
কিন্তু কারণ জানতে চাইলে কী বলব মা?
 
বলবি,
 
মহারাজ, এই জাদু বাঁশি আপনার কাছেই থাক। বরং আপনি আমার কানের ভিতর সুর ভরে দিন। চোখের ভিতর সাদা মেঘের আখর লিখে দিন। আমি নিজের মনেই সবার মনের কথা বুঝব। পাখিরা গাইলে আমিও সপ্তসুরে গান গাইতে পারব। আমাকে মনের মালিক করে দিন। 
মালিক মানে? মালিক কে?
 
মা উত্তর না দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। আমিও তাকালাম। দেখি বকুল গাছের পাতার ফাঁকে টুকরো টুকরো সূর্য দেখা যাচ্ছে। 
 
 
মা, মালিক কে?
 
 
মা হেসে উঠে আঙ্গুল দিয়ে আকাশ দেখায়। আজ বুঝলাম, মালিক মানে টুকরো টুকরো সূর্য।
 
ওহ্‌ বুঝেছি। ওই অনেকগুলো টুকরো টুকরো সূর্য হচ্ছে মালিক। তাই তো?
হ্যাঁ তাই। আমরা একটা সূর্য দেখি, তুই দেখিস অনেক। তাই বলছি, যা ফিরিয়ে দিয়ে আয় মোহন বাঁশি। 
 
মা ঠাকুরের সিংহাসন থেকে মোহন বাঁশি বের করে এনে আমার হাতে দেয়। মন খারাপ হচ্ছিল। তবু মা যখন বলেছে....
 
বেড়ার খুঁটি খুলে বেরিয়ে পড়ি। রমনা দীঘির দিক ধরে হাঁটছি। দেখি বটের থানে শিউলি মহারাজ আছেন কি না। দীঘির ঘাট পার করছি যখন, ঠিক তখন শুনি শিউলি মহারাজ ডাকছেন।
 
কোথায় যাও?
 
ওমা ঘাটের সবচেয়ে ওপরের লাল সিঁড়িতে শিউলি মহারাজ বসে আছেন। নমস্কার করে বলি,
 
মহারাজ, এই বাঁশি নিয়ে আমার কাজ নেই। আমার মা বলেছে........
 
কথা শেষ হওয়ার আগেই মহারাজ বলে, 
 
তুমি কি ভুলে গেলে আমি যে মনের খবর পড়তে পারি? তোমার মায়ের কথা তোমার কথা তোমাদের ফিসফিসানি গল্প সব জানি। তোমার মা হলেন গিয়ে সাক্ষাৎ দেবী। যে নিজেই স্বর্গ রচনা করেছেন দু'হাত দিয়ে তাঁর ছেলে কেন মোহনবাঁশির ওপর ভরসা রাখবে? হক্‌ কথা। ভুলটা আমারই। যাও বাপু, এই দীঘির জলে ওই বাঁশি বিসর্জন দাও। তোমার হাতে না আটলে, অন্য হাতেও উঠবে না। 
 
আমি দীঘির ঘাটে পা রেখে দু হাতে ভাসিয়ে দিলাম। মোহনবাঁশি জলের বুড়বুড়ি কেটে ডুবে গেল। মহারাজ বলল,
 
বিধাতার বাঁশি, বিধাতার কাছেই ফিরে গেল। আমি ফিরি গাছের ডালে, তুমি ফের তোমার মায়ের কোলে। 
কিন্তু মহারাজ, আমি মনের মালিক হব না?
বলি শোনো তাহলে। মা র কথা মনে পড়বে যখন তখন তুমি দিনের দুনিয়া রাতের পৃথিবীর সব শব্দ, সব কথা, সব দুঃখ, সব হাসির মানে বুঝতে পারবে। বক পাখির ডানার মত ধবধবে সাদা হবে তোমার মন। তোমার চোখ হবে চিত্রাল হরিণের থেকেও বেশি ভেজা ভেজা। তোমার ঠোঁটে থাকবে বসন্তের হাওয়ার রাগ রাগিনী। 
 
শিউলি মহারাজ কি বলেছিলেন সেদিন বুঝিনি। আজ নিউ টাউনের এই আঠারো তলার দু হাজার স্কোয়ার ফিটের বিশাল ফ্ল্যাটে বসে আছি। একা একা। ছেলেটা আমার নরওয়ে থাকে। তাও কত বছর হয়ে গেল। ও কিন্তু যেতে চায়নি। বাবা- মাকে ছেড়ে বিদেশের একাকীত্ব ওর কাছে ছিল তীব্র যন্ত্রণার। আমিই জবরদস্তি করেছিলাম। কেরিয়ার নিয়ে কোন রকম ছেলেখেলা আমি সহ্য করিনি। 
 
আজ ভয় হয় ও কি কোনদিন ফিরে আসবে আমার কাছে? জানি না। তবে আজ অন্ধকার ঘন হলে একবার মায়ের কথা ভাবব। দেখিতো শিউলি মহারাজের কথা সত্যি না মিথ্যে? যদিও মানুষের মনের কথা জেনে ফেলায় বিপদ রয়েছে। তবু আমাকে জানতে হবে। জানতেই হবে আমার এক মাত্র সন্তান আমার কাছে ফিরে আসতে চায় আদৌ? 
 
আমারও যে এতগুলো বছর মায়ের কথা মনেই পরেনি। তাই বড্ড দেরি হয়ে গেল। মা র কাছে ফিরে যেতে আর নিজের সন্তানকে ফিরে পেতে।
  

বৈশাখী ২০২৪