শ্রোতা

কলকাতা ৮৪

“ঠিক বারোটায় তাহলে?”
গল্পকার অতীন্দ্র বিশ্বাস ফোন করে জানালেন আমায়।
কফি হাউসে আমার আর অতীন্দ্রদার এই আড্ডাটা সন্ধের বদলে আজকাল সকালে হয়।
অতীন্দ্রদা অনেক দূর থেকে আসেন। সেই তুলনায় আমার বাড়ি কাছে।
আমি উত্তরে জানিয়ে দিলাম, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!”
অতীন্দ্রদা শেষবারের মতন মনে করিয়ে দিলেন, “গল্প এনো কিন্তু!”

আড্ডার সঙ্গে গল্পপাঠ এবং তারপর সেটা নিয়ে আলোচনা হয়।

বারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম কফি হাউসে। অতীন্দ্রদা ঘড়ি ধরে চলা মানুষ।
দেখলাম, আমার আগেই তিনি এসে গেছেন। দুএকটা মামুলি কথাবার্তার পর
অতীন্দ্রদা বলে উঠলেন, “নাও, বার করো এবার।”

          আমি গল্পপাঠ শুরু করলাম। পড়ার ফাঁকে মাঝে মাঝে গল্পকার অতীন্দ্র বিশ্বাসের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। দেখলাম, চোখ বুজে নিবিষ্টমনে অতীন্দ্রদা গল্পটা শুনছেন। একসময় শেষ হল গল্পটা। অতীন্দ্রদা বলে
উঠলেন, “বাঃ দারুণ!”

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ আমাদের দুজনকেই অবাক করে দিয়ে একজন মধ্যবয়েসি ভদ্রমহিলা আমাদের টেবিলের সামনে এসে বলে উঠলেন,
“দারুণ, দারুণ হয়েছে!” 

একেবারে চমকে গেলাম আমরা দুজনেই। দেখলাম ভদ্রমহিলার চোখে জল। আচমকা অজানা এক ভদ্রমহিলা হঠাৎ ধূমকেতুর মতন উদয় হয়ে এরকম বলে উঠবেন, একেবারেই ভাবিনি।

অবাক হয়ে বললাম, “তাই!”
ভদ্রমহিলা বললেন,
“আমি ওই টেবিলটায় বসেছিলাম। কান খাড়া করে আপনার গল্পটা শুনছিলাম।”

কফি হাউসের টেবিলগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব বেশ ভালোই। অত দূরে বসে আগাগোড়া গল্পটা শোনা, ভাবতে পারছিলাম না।

বিস্মিত অতীন্দ্রদা বলে উঠলেন, “অত দূরে বসে আপনি ফলো করতে পারলেন সবটা?”
ভদ্রমহিলা বললেন, “বেশ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। খুব ভালো হয়েছে গল্পটা। আমি আর চোখের জল
সামলাতে পারলাম না।”
একটু হেসে হাত দিয়ে চোখের জল মুছলেন ভদ্রমহিলা।

উৎসুক হয়ে বললাম, “আপনিও কি লেখালেখি করেন?”
ভদ্রমহিলা বললেন, “না, না, আমি পড়তে ভালোবাসি। তবে আমার স্বামী সাহিত্যিক ছিলেন। তাঁর
সমস্ত গল্পের প্রথম শ্রোতা ছিলাম আমি। তবে এখন তো উনি আর নেই।”

কথাটা বলে ওপরের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন ভদ্রমহিলা। তারপর বেশ
অপ্রস্তুত হয়ে একটু ধরা গলায় বলে উঠলেন, “আচ্ছা চলি।”

আর দাঁড়ালেন না ভদ্রমহিলা। কফি হাউস থেকে বেরিয়ে গেলেন তীরবেগে। 

বৈশাখী ২০২৪