পৃথা সেনের মত সুন্দরী এ পাড়ায় কেন, পুরো এলাকাতেও আছে কিনা সন্দেহ। এত রূপ! রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে রাস্তা আলো হয়ে যায় না; ঝলসে ওঠে রূপের আগুনে। পাঁচ তিন হাইট। মাছি পিছলানো ত্বক। মসৃণ আঁখিপল্লবে ঢাকা বড় দুটো চোখ। সে চোখ তুলে পতঙ্গের দিকে তাকালে, সে পতঙ্গের মরণ নিশ্চিত। এর সঙ্গে আছে, কোমর অবধি সিল্কের মত একঢাল গাঢ় বাদামি চুল। কলেজে বন্ধুরা কতবার বলেছে, “পৃথা তুই সিনেমায় নাম, অনেক হিরোইনের ভাত বন্ধ হয়ে যাবে!” তিনি হেসেছেন। রূপ তাঁর আছে। আর তা কীভাবে রক্ষা করতে হয়, তা তিনি খুব ভালোভাবে জানেন। সকালে উঠে হাঁটা। মাপা খাওয়া। মাসে দুদিন পার্লার। সকালে লাফিং ক্লাব। বিকেলে যোগব্যায়াম। ফল, বাদাম। কিছুই বাদ যায় না। নিজে নিউট্রিশনের ছাত্রী তাই জানেনও অনেক কিছু। দোকান বাজার বা রাস্তা সুন্দরীদের কদর সর্বত্র। এর ওপর যদি সে হয় অবিবাহিত। পৃথা জানেন সেটা। তাই যে পুজো তিনি পেয়ে এসেছেন সবার দৃষ্টিতে, সেটাকেই স্বাভাবিক বলে মানেন। ভক্তদের উদ্দেশ্যে, কখনও সখনও এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে একটু আধটু কৃপাও করেন তিনি। সেই স্কুল জীবন থেকে কত মথ যে তাঁর রূপের আগুনে পাখনা পুড়িয়েছে, তার কি লেখাজোখা আছে! হাঁটতে থাকেন পৃথা। পাশের বাড়ির হিমানীশ বিয়েই করল না ওঁর জন্য। স্কুলের হেডমাস্টার অম্বরীশ সোম, বুড়ো হয়ে গেলেন ওকে দেখতে দেখতে। কলেজের সেই ছোকরা প্রফেসর। হাসতে হাসতে বিষম খান পৃথা। রাস্তার দুধারে কত গাছ ছায়া বিছিয়ে ডেকেছে তাঁকে। কিন্তু ঘর বাঁধতে গেলেই যে সব ছায়া শুকিয়ে নিদাঘ আসে। অনেক দেখেছেন তিনি। জানেন। পুরুষ জাতটাই অমন। জানেন পৃথা। এইসব ভাবতে ভাবতে হাঁটতে থাকেন পৃথা। হাঁটতে ভালো লাগে। এত পুজো পেয়েছেন, তবু আজকাল কী রকম একা লাগে পৃথার। কাল গেছিলেন পেনসন তুলতে। ব্যাঙ্কের একটা ছেলে তাঁকে ‘মাসিমা’ বলে সম্বোধন করল। যত সব আনকালচারড ব্রুট। গ্রাম থেকে চাকরি পেয়েই এই সব জায়গায় পোস্টিং পেয়ে যায়। “মাসিমা আবার কী! ম্যাডাম বলতে পারেন না!” বিরক্তি প্রকাশ করে এসেছেন। লক্ষ্য করছেন, ওনাকে দেখলে আজকাল কেউই আর আগের মত তেমন 'দিদি দিদি' করে না। ক্যারর, ক্যারর বেলটা বাজতে থাকে। “কে?” দরজা খুলতেই, একটা বাচ্চা ছেলে। “দিদ্মা, ফুল। মা পাঠোলে।” “দিদ্মা’! কে তোর দিদ্মা এখানে?” অশীতিপর মা বিছানায়, জানেন, তবুও পিছনে ঘুরে দেখে নেন একবার। “তোমার ফুল লাগবে না?” “আমি! তোর দিদ্মা!” “যাব্বাবা! মা ই তো বলল, তিনতলার ফেলাটের দিদ্মার ফুল লাগবে, দিয়ে আয়! ধরবে’তো ধরো। বাজে বকে, দেরি হয়ে গেলে, মা গাল দেবে। আমি যেচ্ছি।” বলতে বলতেই হুড়হুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় ছেলেটা। “যত্ত সব অশিক্ষিত ছোটলোকের গুষ্টি!” আলোর সুইচটা অন করে, ঘরে ঢোকেন নিউট্রিশনের দিদিমণি। বেডরুমের জোরালো আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে সে। সে পৃথার বড় আপন। আজ পর্যন্ত অনেক সাহস জুগিয়েছে সে। পৃথার অনেক প্রশ্ন আছে, আজ তার কাছে। নিজের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, খোঁজেন আগুন। এই সেদিনও যা পুড়িয়ে মেরেছে অনেক পতঙ্গকে। সে বলে ওঠে, “দেখ তোমার চোখের পাতায়, গলার ভাঁজে, ছাপ ফেলে গেছে, কাক আর বকেদেরর ঠ্যাঙ! এবার শান্ত হও। মেনে নাও তাকে। সে আসে সবার কাছে!” হাতের সামনের ভারী ফুলদানিটা তুলে ছুঁড়ে মারেন। টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে পৃথার এত সাধের আয়না। পশ্চিমের বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা হিমেল হাওয়া ঘরে ঢুকে আপাদমস্তক কাঁপিয়ে দিয়ে যায় তাঁকে। হাউ হাউ কান্নায় ভেঙে পড়েন পৃথা।