“দেখ দাদা, আমি কিন্তু এবাড়ির কোন কিছুই নিইনি! শুধু এই ছোট বাক্সটা আমি নেব!” মুনিয়ার কথা শুনে তাপস আড়চোখে বাক্সটা একবার দেখে নিয়ে বলল, “কীই বা বাবা রেখে গেছিল যে নিবি। দেড়কাঠা জমির ওপর দুটো মুরগির খোপ। তাতে মা সমেত এখন আমরা পাঁচটি প্রাণি!” মুনিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “তার মধ্যেও তো মেয়েরা এসে ভাগ বসায়, কিন্তু আমি কি কোনদিন কিছু বলেছি? তাছাড়া বাবার টাকাও তো কিছু চাইনি বল!” “না, তা অবশ্য চাসনি তবে তোর জেনে রাখা দরকার মুনি, বাবা মারা যাবার পর বাবার পাশবইতে পাঁচশো সাতাত্তর টাকা ছিল। সে টাকা সেখানে তেমনই আছে তুই নিলে নিতে পারিস।” তাপসের কথা শুনে মুনিয়া বলে, “এমা আমি কি নেব নাকি! এমনি বলছিলাম। দেখ দাদা এই বাক্সটাতে তো কোন হীরে জহরত নেই, আছে বাবার মেডেলগুলো। এটা আমি বাবার স্মৃতি হিসেবে নিই?” মুনিয়ার বাবা সুজিতবাবু একসময় নামি ফুটবলার ছিলেন। সেই সময়ে তিনি অনেক ক্লাবের হয়ে খেলেছেন, অর্থ তেমন পাননি কিন্তু মেডেল আর সম্মান পেয়েছেন সারাজীবনে অনেক। সেই মেডেলগুলো এই ছোট অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সটাতে রাখা আছে। তাদের মা মৃন্ময়ীদেবী মাঝে মাঝেই মেডেলগুলো বের করে ঘষে মুছে ঝকঝকে করে আবার তুলে রাখেন। এই বাক্সটা সারাবছর আলমারির এক কোণে পড়ে থাকলেও এটাই এবাড়ির একমাত্র অহংকার। দাদা বোনের এমন কথোপকথন এতক্ষণ দরজার আড়াল থেকে সবই শুনছিল তাপসের বৌ সীমা। এবার সে স্বামীকে চাপা স্বরে ঘরে ডাকল। তাপস ঘরে গেলে সে বলে, “ খবরদার দেবে না ওগুলো। পুরানো দিনের মেডেল সোনা রুপোরই হবে। কি বুদ্ধি ঠাকুরঝির! সবাইকে দেখাবে কিছুই নিল না অথচ ক্ষীরটা নিয়ে নেবার ধান্দা। স্মৃতি না কচু!” তাপস কাঁচুমাচু মুখে বাইরে এসে বলল, “না রে মুনি ওটা নিস না। আমাদেরও তো স্মৃতি। এখানেই থাক। ওটা নাড়াঘাঁটা করলেও বাবার কথা মনে পড়বে!” মৃন্ময়ী ঘরের ভিতর বসে চুপ করে দুই ছেলেমেয়ের কথা শুনছিলেন। তিনদিন হল স্বামীর শ্রাদ্ধকাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাল নিয়মভঙ্গ আর মৎস্যমুখের কাজ ছিল। আজ মুনি নিজের বাড়ি ফিরবে। তার আগেই ভাইবোনে জরুরি কথা সেরে নিচ্ছে। মৃন্ময়ী একবার নিজের শাঁখাপলাহীন হাতটা দেখলেন তারপর বাইরে এসে তাপসকে বললেন, “বাবু, মতি স্যাকরাকে একবার দুপুরে তার যন্ত্রপাতি নিয়ে আসতে বলিস তো আমাদের বাড়িতে!” “কেন মা?” মুনিয়ার প্রশ্নে মৃন্ময়ী ম্লান হাসলেন। দুপুরে মতি স্যাকরা এলে মৃন্ময়ী বড় করে ঘোমটাটা টেনে মেডেলের বাক্সটা হাতে করে বাইরে এলেন। বাক্সটা তার দিয়ে বললেন, “দেখো দেখি মতি তোমার কষ্টিপাথরে ঘষে এই মেডেলগুলোতে কতটা সোনা রূপো আছে!” মতি তার কষ্টিপাথর বের করে জল দিয়ে ভিজিয়ে একটা একটা করে মেডেল ঘষে দেখতে লাগল। তারপর বলল, “মা, এতে সোনা রূপো তো কিছু নেই!” “বেশ তাহলে ওগুলোকে এবার সমান দুভাগে ওজন করে দাও!” মতি দুভাগ সমান ওজন করে আলাদা রাখলে মৃন্ময়ী দুই ছেলে মেয়েকে বললেন, “বাবু মুনি তোমরা দুজনে দুভাগ রেখে দাও নিজেদের কাছে, তোমাদের বাবার স্মৃতি। আমি কবে আছি কবে নেই!” তাপস আর মুনিয়া এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে সব কিছু দেখছিল। এবার মায়ের কথা শুনে তারা একযোগে বলে উঠল, “না না মা ওগুলো এখন তোমার কাছেই থাক। বাবার জিনিস তো!” মৃন্ময়ী বিজয়ীর হাসি হেসে মেডেলগুলো বাক্সে গুছিয়ে উঠে পড়লেন। যাক তার অহংকার রক্ষা করতে পেরেছেন।