সমাপ্তি

চুঁচুড়া, হুগলী

       মধ্যবিত্ত বাবার তৃতীয় ও সর্বকনিষ্ঠ কন্যা সমাপ্তি বন্ধুদের কাছে মজা করে বলে, "পর পর তিন কন্যারত্ন উপহার পেয়ে বাবা-মা পুত্রসন্তান পাবার আশা ত্যাগ করে এখানেই ইতি দিলেন আর তাই আমার নাম রাখলেন সমাপ্তি।" বন্ধুরা বলে, "তুই খুব অসভ্য, বাবা-মাকে নিয়ে এমন বলে?" সমাপ্তির বাবা সমীরবাবু দুইকন্যার বিয়ে দিয়ে ঋণগ্রস্ত, তাই সমাপ্তির বিয়ের দিন আসতে বয়স ৩০ ছুঁইছুঁই। বাবার ইচ্ছে ধুমধাম করে বিয়ে দেবেন তাঁর কনিষ্ঠ কন্যার। বস্তুতঃ তিনি এই ছোট মেয়েটির জন্য খুব মনোকষ্টে ভোগেন। তাঁর ঋণের বোঝা হালকা করতেই মেয়েটির বয়স গড়াল অতদূর। মধ্যবিত্ত পিতা, সাধ আর সাধ্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক। সামাল দিতে মা তাঁর গয়নার বাক্স তুলে দিলেন বাবার হাতে। পুরনো গয়না, তাই দূরের শহরের দোকানে গিয়ে ভেঙে আধুনিক ডিজাইনে করতে দিলেন অবসরপ্রাপ্ত পিতা, সঙ্গে মা ও মেয়ে। 
         বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে, গয়না ডেলিভারির ডেটও হয়ে গেছে। আগে থাকতে আনবেন না বলে বিয়ের চারদিন আগে বাবা গেলেন গয়না আনতে। একটি বড় কাঁধব্যাগে কিছু জামাকাপড় নিয়েছিলেন, তারই ভাঁজে ভাঁজে গয়নার বাক্সগুলো দোকানেই ঢুকিয়ে নিলেন সাবধানী বাবা যাতে বোঝা না যায়। স্টেশনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ট্রেনে উঠলেন। মাথায় একরাশ চিন্তা, কাকে কোন কাজের দায়িত্ব দেবেন। নিজে কন্যাদান করবেন, কাজেই তখন কোনোদিকে দেখতে পারবেন না। মা বলেছিলেন কাকাকে বলতে সম্প্রদান করার জন্য, কিন্তু সমীরবাবু রাজি নন। তিনি নিজেই কন্যাদান করবেন। কন্যাদানের মতো মহৎ কাজ হয় না, সে কাজ থেকে তিনি বিরত হতে চান না। আপন কলিজার টুকরোকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া, এ কী কম কথা! যদিও সম্প্রদান কথাটায় তাঁর ঘোর আপত্তি। কন্যা কি  বস্তু যে তাকে দান করা যায়, তাও আবার সম্প্রদান! অর্থাৎ কিনা সম্পূর্ণরূপে দান! তার পরিবর্তে অর্পণ কথাটাই তাঁর বেশি পছন্দ। কিন্তু যা চলে আসছে। কালে দিনে হয়তো অর্পণ কথাটাই মান্যতা পাবে।  
          বাড়ি ফিরলেন, মনটা আজ খুব আনমনা। মা দেখতে চাইলেন গয়নাগুলো। "সব্বোনাশ ব্যাগ তো সঙ্গে নেই! কোথায় ফেলে এলাম?" মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। মেয়ে এল এগিয়ে, "দোকানে একটা ফোন করো বাবা"। বাবার হাত-পা কাঁপছে, ফোনটা মেয়েই করল। 
তারা বলল, "উনি তো কাপড়ের ভাঁজেভাঁজে বাক্স ঢুকিয়ে নিয়ে গেলেন। দোকানে পড়ে থাকলে আমরাই ফোন করতাম আপনাদের। দেখুন ট্রেনে ফেলে এলেন কিনা।" 
"কী সর্বনাশ, সে ট্রেন তো বেরিয়ে গেছে", মা আঁতকে উঠলেন।
 মেয়ে মাথা ঠান্ডা করে বাবাকে বলে, "বাবা একটু মনে করার চেষ্টা করো, ট্রেনের বাঙ্কে রেখেছিলে কী ব্যাগটা?" সমীরবাবুর হঠাৎ মনে পড়ল তিনি খালি হাতে ট্রেনে উঠেছেন, কারণ ট্রেনের দরজায় ভিড় ছিল, তিনি দু'হাতে সরিয়ে ভেতরে ঢুকেছেন। 
"হায় রে, প্ল্যাটফর্মে বেঞ্চে বসেছিলাম, ব্যাগটা মনে হচ্ছে সেখানেই ফেলে ট্রেনে উঠে পড়েছি। গেল গেল, আমার সব গেল", হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন তিনি। 
"এখন কাঁদবার সময় নয় বাবা, চলো আমরা ওই স্টেশনে গিয়ে দেখি কেউ স্টেশনমাস্টারের ঘরে জমা দিয়েছে কিনা।" কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বাবা চললেন মেয়ের সঙ্গে।
 মা কপালে হাত ঠেকালেন ওদের বেরোনোর সময়, "দুগ্গা দুগ্গা!" 
        দুরুদুরু বুকে ওরা পৌঁছাল সেই স্টেশনে। বাবা সেই বেঞ্চের দিকে ছুটতে শুরু করলেন, পিছনে মেয়েও। দূর থেকে একটা জটলা দেখে, কাছে গিয়ে বাবা দেখেন তাঁরই ব্যাগটা ঘিরে চলছে জল্পনাকল্পনা। কেউ কাছে যাচ্ছে না। "ঐ তো, ঐ তো, ঐ তো আমার ব্যাগ।" সমীরবাবু পাগলের মতো দৌড়ে গেলেন ব্যাগটার কাছে। সবাই হইহই করে উঠল, "চলে আসুন, চলে আসুন, কেউ হয়তো বোমা রেখে গেছে ব্যাগে, আমরা  বম্ব-স্কোয়াডে ফোন করেছি, এখুনি তারা পৌঁছে যাবে"। সমীরবাবু ততক্ষণে ব্যাগটা বুকে আঁকড়ে ধরেছেন। সমাপ্তিও ছুট্টে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। 

বৈশাখী ২০২৪