দুর্গা

করিমগঞ্জ, আসাম

   সমীরবাবু যখন কালো ছিপছিপে মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে এলেন, তাকে দেখেই ননীবালা বললেন, “এ আবার কাকে নিয়ে এলি বড় খোকা?”
   “মা এ দুর্গা। আমাদের ঘরের সব কাজ এখন থেকে ওই করবে! তোমাকে আর দুপুরবেলা একা থাকতে হবে না।”
  “উদ্ধার করবেন ইনি! কী নামের বাহার! পেত্নির মতো রূপ তার নাম নাকি আবার দুর্গা। এই তোর দশ হাত কই মা দুর্গার মতো?”
 দুর্গা হেসে বলল, “লুকিয়ে রেখেছি ঠাকুমা। এমনিতে দশ হাত নিয়ে চলতে কষ্ট হয়। যখন যে হাতের দরকার পড়বে সেটা বের করব।”
 “বাবা! মেয়ের কথার ছিরি দেখ! খুব সেয়ানা। বাড়িতে তোর কে কে আছে?”
 “মা, বাবা, ভাইবোন সবাই আছে। আমি সবার বড়। ভালো করে খেতে পাই না তাই কাকু আমাকে নিয়ে এল।” 
“দেখিস কাজ করতে গিয়ে চুরি করিস না যেন! যদি ধরতে পারি খুব খারাপ হবে!”
  
     দিনমজুর বাবা মায়ের চোদ্দ বছরের মেয়ে দুর্গা। পড়াশোনায় ভালোই ছিল কিন্তু সংসারের অভাব। ক্লাস ফাইভেই লেখাপড়া বন্ধ। সমীরবাবু দুর্গার বাবাকে চিনতেন সেই সূত্রেই দুর্গাকে বাড়ি নিয়ে এলেন। আলিপুরে বিশাল বাড়ি সমীরবাবুর। দুপুরে বাড়িতে কেউ থাকে না। সমীরবাবু আর স্ত্রী সুচেতা দেবী দুজনে অফিস চলে যান। তাঁদের একমাত্র মেয়েও স্কুলে তখন। তাই ননীবালাকে একাই থাকতে হয়। ঠিকে কাজের ঝিরা আসে কিন্তু তারা কেউ ননীবালার  খেচখেচানিতে বেশিদিন টেকে না। আর ননীবালার মেজাজের জন্য আশেপাশের কেউ তেমন মেশে না। সত্তর বছরের ননীবালা হেড মিস্ট্রেস ছিলেন, এখনও তাঁর মেজাজ কমেনি। তবে কেউ যদি ওনার মনের মত হয়ে যায় তার জন্য তিনি অনেক কিছু করেন। 
দুর্গা নিজের মতো করে ঘরের সব কাজ করে, ননীবালা তার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে ওর কাজে খুঁত ধরেন নানা কটুবাক্য বলেন ওকে। কিন্তু দুর্গা হাসিমুখে সব মেনে নেয়, কারুর কাছে কোন নালিশ করে না। কিন্তু ওর লেখাপড়া করার ইচ্ছে রয়েছে একটু সুযোগ পেলেই খবরের কাগজ বা কোন বই পেলে পড়ে ।

কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। একদিন ননীবালা বাথরুমে পড়ে গেলেন। দুর্গা ফোনে কাউকে না পেয়ে ওর কাছে সামান্য কিছু টাকা ছিল তা দিয়ে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে উনাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। এরপর খবর পেয়ে সমীরবাবু, সুচেতাদেবী আসেন। সবাই ধন্যবাদ জানায় দুর্গাকে।
    ননীবালা হাসপাতালে যখন ছিলেন দুর্গাই ওর সঙ্গে থেকেছে, ওনার দেখাশোনা করেছে। সুস্থ হয়ে ননীবালা আদর করে দুর্গাকে ডেকে বললেন, “তুই সত্যিই দুর্গা রে মা! তাই আমাকে সেদিন বাঁচিয়ে দিলি! কী করে বুড়িটাকে নিয়ে গেলি রে?  লুকানো হাতগুলো বের করেছিলি বুঝি?” 
   দুর্গা হেসে বলল, “তাই করেছিলাম গো ঠাকুমা!”
   “বেশ এখন আমি সুস্থ হয়ে গেছি। তোর লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছে আমি জানি। এই সমীর, ওকে স্কুলে ভর্তি করে দে। আমি ওকে লেখাপড়া শেখাব। শিখবি তো আমার কাছে?”
   দুর্গার মুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠল, খুব শিখব ঠাকুমা! এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে!”

বৈশাখী ২০২৪