আলোর ঠিকানা

আসানসোল, পশ্চিম বর্ধমান

[১]
“তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময় ...”

দুটি হাত বুকে কাছে জড়ো করা। সাদা শার্ট, বেগুনী স্কার্ট। চোখ বন্ধ। লাইনের সামনে অচিনাদির উদাত্ত সুরের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে মেয়ের দল। রোজ ইস্কুল শুরুর হবার আগে পরমপিতার কাছে আলোর প্রার্থনা। সেই আলোর রেশ বুকের মধ্যে জেগে থাকবে অনেকক্ষণ। ছাত্রীদের সকালের দুষ্টুমির শুরুটা খানিক পিছিয়ে যাবে।
যা কিছু অন্যায়, যা কিছু পাপ, তার কালো রঙের উপর সৎ চিন্তার আলো পড়লেই সেই কয়লার রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে হীরের দ্যুতি ছড়াবে, এমন একটা সাধারণ ধারণা। বিশ্বে যা কিছু মহান বস্তু, যা কল্যাণকর, সহজ সরল, তাই শুভ্র।  

ক্লাসের বিচ্ছু মেয়ে মেহুলি বলেছিল, “সূর্যের সাতরঙ যে নিজের মধ্যে শুষে নিয়ে কুক্ষিগত করে রাখে, কারো জন্য একছিটে রঙও বাকি রাখে না, সেই কিপটে মজুতদারের রঙ কালো। আর বৈরাগির মতো যে সব রঙ সবার মাঝে বিলিয়ে দেয় সেই হল গিয়ে সাদা। তাই সাদা পবিত্র!”
আমি নিরীহভাবে শুধালুম, “এই শুষে নেবার জন্যই সে যে আমাদের জন্য উষ্ণতা ছড়ায়, তার বেলা? শীতকালে কালো সোয়েটারের গরম...”
ও বাবা, অমনি মুচকি হেসে “তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু” গাইতে গাইতে চলে গেল! কী বদ বুঝুন!

তা সে যাই বলুক. আমার প্রধান আপত্তি ওই সহজ সরল কথাটিতে। কবি যাই বলুন, এমন বহুরূপী এবং জটিল বস্তু, থুড়ি তরঙ্গ, থুড়ি ... দেখলেন তো? এককথায় যে বলব তার কোনো উপায় নেই। এবার পরীক্ষার হলে সংজ্ঞা লিখতে হলে ওই মহাশূন্যের শূন্যটি টপাস করে আমার খাতায় এসে পড়বে।
ছোটোবেলায় পড়লাম আলোকরশ্মি। সোজা কথায় রে। তার একমুখি চলনের পথে অস্বচ্ছ বাধা পড়লে ছায়া, স্বচ্ছ বা ট্রান্সপারেন্ট হলে প্রতিফলন, প্রতিসরণ ইত্যাদি ঘটে। তার ফলে প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। বেশ সোজা ব্যাপার। সরল ব্যাপার ছিল, সবটুকুই। 
কিন্তু সরলরেখাটি বেশিদিন সরল রইল না। মেহুলি একদিন এসে বলল, “আলো সবসময় সোজাপথে চলে না জানিস? খুব ছোটো চৌকো ফুটো দিয়ে আলো গেলে একটু বেঁকে যায় তো। ছোট্ট চৌকো ফুটো দিয়ে আলো গলে দেয়ালে পড়লে গোল দেখায়। দেখিসনি?”
আমিও চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাবার ক্যামেরায় একটা পোলারাইজার আছে। সেটা ঘোরালে আলোর তীব্রতা কম বেশি হয়। আলো যদি রেখাই হবে তাহলে হয় সাদা নয় কালো হবে। মাঝের এই গ্রে এরিয়া এল কোথা থেকে?
দিদিমণি ভারি খুশি হয়ে বললেন, “ভালো খেয়াল করেছো। আসলে এই দুটো ব্যাপার দেখেই হাইগেন বুঝেছিলেন, আলো রেখা নয়।  সে আসলে তরঙ্গ বা ওয়েভ। তারা নিজেদের মধ্যে একে অপরের গায়ে লুটোপুটি খেয়ে নানা প্যাটার্ন তৈরি করে।
জলে ঢিল ফেলে দেখেছ? একটা গোল ঢেউ থেকে আরেকটা, তার থেকে আরেকটা – এমনি করে এগিয়ে যায়। আর জল মানে মিডিয়ামের কণাগুলো সেই পথের দিশার সমকোণে নাচতে থাকে। এইরকম ওয়েভকে বলে ট্রান্সভার্স ওয়েভ। আলোও তেমনি করে তার উৎস থেকে তরঙ্গের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এক ঢেউ থেকে আরেক ঢেউ, তার থেকে আবার ....। আর উৎস থেকে যে লাইনগুলো ঢেউদের মাথার সঙ্গে সমকোণে এগিয়ে চলে তারাই রে বা আলোকরশ্মি। এইভাবে দুই থিয়োরির একূল ওকূল দুকূলই রক্ষা হল। ওটা হতেই হত। কারণ রে অপটিকস পরীক্ষিত সত্য! 
এবার বলি মেহুলি যে আলো বেঁকে যাবার কথা বলছে, তার নাম ডিফ্রাকশন, আর তুমি যেটা বললে তার নাম ..”
মেহুলি এতক্ষণ চুপ থাকার পাত্রী নয়। ফস করে বলে বসল, “পোলারাইজেশন?”
দিদিমণি মেহুলির মাথাটা একটু ঘেঁটে দিয়ে বললেন, “গুড গার্ল।”
আমার ভারি রাগ হয়ে গেল। আরে, প্রশ্নটা তো আমার ছিল! দিদিমণি হেসে ফেললেন, “এখানেই শেষ নয় কিন্তু। এতটাই যখন বলা হয়ে গেল, তখন বলি আলো কিন্তু শুধু তরঙ্গ নয়। সে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ, তাই সে মহাশূন্য পাড়ি দিতে পারে। আবার কণাও বটে। বস্তু আর তরঙ্গ – দুয়ের ধর্মই আছে বলে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তার নাম দিলেন ম্যাটার ওয়েভ। বললেন এটা কন্টিনিউয়াস বা নিয়ত শক্তির আধার নয়। বরং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তির (কোয়ান্টাম) গুণিতক!
আলোর যেটুকু বিকিরণ এক কোয়ান্টাম শক্তি ধরে তাকেই বলি ফোটন। এই ফোটন আলোর গতিতে চলে, আবার যখন তার শক্তি যথেষ্ট বেশি থাকে তখন সে কিছু ধাতুর উপরিভাগ থেকে ইলেকট্রন মুক্ত করতে পারে। এই সময়টাতে তার ব্যবহার কণার মত। এটাকেই বলে ফোটো-ইলেকট্রিক এফেক্ট। 
তাকে কাজে লাগিয়েই তো আজকে এই সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ তৈরির রমরমা!”
মেহুলি বিড়বিড়িয়ে বললো, “আলো না হাঁসজারু? যখন যেমন, তখন তেমন?“
আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, দিদিমণি শুনতে পাননি। তিনি বলে যাচ্ছিলেন, “তাহলে বলা যায়, আলো হচ্ছে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ। সে সরলরেখায় চলে। একেকটা ঢেউ মানে তরঙ্গের দৈর্ঘ্য যত ছোটোই হোক না কেন, বিজ্ঞানীরা নানান যন্ত্রের সাহায্যে ঠিক মেপে ফেলেন। যেমন ধরো আমরা যে সাতরঙা আলো, মানে ভিবজিওর দেখতে পাই - সেগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪০০ থেকে ৮০০ ন্যানোমিটার। এক ন্যানোমিটার হল এক মিটারের ১০৯ ভাগের একভাগ!” 
আপনাদের কী মনে হচ্ছে জানি না। আমার মাথা ঘুরছে। 
মেহুলির তৃপ্তি নেই। ফস করে বলে বসল, “৪০০ থেকে ৮০০ কেন? তার চেয়ে ছোটো বড় - ওই কী বলে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ হতে পারে না?”
“পারেই তো! এর চেয়ে ছোটো দৈর্ঘ্যের তরঙ্গগুলোকে বলে আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি। ওই তোমার এক্স-রে, ইউ ভি রে, গামা রে ইত্যাদি। ত ছোটো বলে তাদের ভেদ করার শক্তি বেশি। যতো ছোটো, ততো বেশি ভেদশক্তি।
আবার ৮০০ ন্যনোমিটারের চেয়ে বড়ো তরঙ্গকে বলি ইনফ্রা-রেড রে। তারা আবার তাপ ছড়ায়। যেমন ধরো মাইক্রোওয়েভ।”
মেহুলি ভারি খুশি হয়ে বলল, “ওই জন্য আগুনের রং লাল! সে যাই হোক বেসিক রঙ তাহলে ওই ভিবজিওর?” 
“উঁহু। মূল রঙ তিনটে। লাল, নীল আর সবুজ নিয়ে প্রকৃতি বিশ্বময় নানারঙের আলপনা এঁকেছে! কি মারাত্মক প্রোপরশনের জ্ঞান ভাবো একবার! অস্বচ্ছ বস্তুরা যে যেভাবে যতটুক রঙ প্রতিফলিত করবে, আমরা তার সেই রঙই দেখব। বাকি যা সে শুষে নিয়েছে, তার হদিশ মিলবে না।”
মেহুলি এখন সাবধান হয়ে গেছে। ফেলুদার মতো ভুরু কুঁচকে বললো, “অস্বচ্ছ কথাটা বললেন কেন?”
“তার কারণ স্বচ্ছ জিনিস যে রঙকে তার মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে যেতে দেয়, তাকে আমরা সেই রঙে দেখি বলে।”


আমিও নিজের বিদ্যে জাহির করতে ছাড়ি না, “তার মানে, ওপেক হলে রিফ্লেকশন, আর ট্রানসপারেন্ট হলে রিফ্র্যাকশন। ওই জন্যই মহাকাশের রঙ কালো। আলো প্রতিফলিত করার জন্য বায়ুকণারা নেই তো!”
মেহুলি চটে উঠে বলল, “আচ্ছা গোলমেলে জিনিস যা হোক! আলো নিজে আলো নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ তাকে ধারণ করে আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে! মানে সেটাই তো আমাদের দেখতে সাহায্য করে, তাই না? ভাগ্যিস তার একটা বিশাল স্পিড আছে। নয়তো কোনোকিছু দেখতে দেখতেই দিন কাবার হয়ে যেত! হুঁ হুঁ বাবা, এক সেকেন্ডে ৩০ কোটি মিটার! ইয়ার্কি নয়। তাই সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাই।”
মেহুলিকে রাগাতে আমার ভারী ভালো লাগে। বললাম, “সঙ্গে সঙ্গে? ঠিক জানিস? মানে একটা জিনিস থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে তোর চোখে পৌঁছাবে, তারপর তোর ব্রেন তাকে বিশ্লেষণ করবে, তবে তুই তাকে দেখতে পাবি – মানে কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের ফাঁক তো বটেই। তাছাড়া, ওই তারাগুলোর কথা ভাব। যারা আমাদের থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে আছে!”
মেহুলি ভারি চিন্তায় পড়ে গেল, “দাঁড়া, দাঁড়া। এক আলোকবর্ষ মানে এক বছরে আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করে। তাহলে এক আলোকবর্ষ হলো গিয়ে ৯৪৬ ১০১০ কিলোমিটার! তাতে কী?”
“ধর আলফা সেন্টেনারি। তাকে তো আমাদের আকাশ থেকে দেখা যায়, তাই না? দূরত্ব চার আলোকবর্ষের চেয়ে একটু বেশি। মানে ওখান থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো পৌঁছাতে চার বছর লাগে।” 
“তো?”
“এবার ভাব, তারাটা হঠাৎ পুটুস করে নিভে গেল! আহা, ওভাবে তাকাস না, বলছি ধরে নে ওর জ্বালানি শেষ হয়ে গেছে। তাহলে কী হবে? শেষ যে আলো পাঠিয়েছিল সে তো তারাটা মরে যাবার আগেই রওনা দিয়ে দিয়েছে, তাই না? আর যেহেতু আলো ব্যাক গিয়ারে চলে না, সেহেতু তার যাত্রা অব্যাহত থাকবে, আর চার বছর পর পৃথিবীতে এসে পৌঁছাবে।” 
“ন্যাচারালি। কিন্তু বলতেটা কী চাইছিস?”
“বিশেষ কিছু না। মানে তারাটা নিভে যাবার পরেও চার বছর ধরে, আমরা তাকে দেখতে পাব, ঠিক সেই আলোই পাব। বুঝতেই পারব না যে আসলে, এই মুহূর্তে, ওটা নেই।”
মেহুলি একটু চুপ করে বসে ব্যাপারটা হজম করল। তারপর ভূগোল বইটা উল্টে কী একটা দেখে নিয়ে বেদম নাচ জুড়ল – ঢিংকা চিকা। ঢিংকা চিকা।
এবারে আমিই ভেবলে গিয়ে জানতে চাইলাম, “নাচের কী হলো?”
মেহুলি নাচতে নাচতেই জবার দিল, “বুঝতে পারছিস না? আজ যদি সূর্যটা পটাস করে নিভে যায়, সূর্যের শেষ আলোটা আমাদের কাছে পৌঁছানো অবধি, আমাদের হাতে আরও আট মিনিট থাকবে! কাজেই এবার থেকে জীবনের প্রতিটা মিনিট উপভোগ কর, বুঝলি? কে বলতে পারে ...”
বলেই বেড়ালের মতো ফ্যাঁচ করে হেসে আমাকেও একপাক ঘুরিয়ে দিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।

[২] 
মেহুলি বলছিল, “আজ আলোদির ক্লাস হবে আলোর স্পিড নিয়ে।”
“আলোদি?” 
“উঃ, আলো পড়াবেন না?”
“তাহলে যেদিন হিট পড়াবেন, সেদিন কি তাপদি বলবি নাকি?” 
“ধ্যেৎ, সেদিন তপতীদি বললেই হবে!”	
“উফফ্!”
দিদিমণি এসেই জানতে চাইলেন, “স্পিড কাকে বলে?”
সারা ক্লাস কলকলিয়ে উঠল, “এক সেকেন্ডে কোনো বস্তু যতটা দূরত্ব আতিক্রম করে, সেই অতিক্রমের হারকে স্পিড বলে।”
দিদিমণি বললেন, “ধরো তুমি বাসে করে যাচ্ছো, তাহলে তোমার পাশের সিটে বসা যাত্রীটির স্পিড কতো?”
কৃষ্ণা বলল, “এতো জানা কথা, আমার রেফারেন্সে সে স্থির, তাই তার স্পিড শূন্য, আবার বাইরে দাঁড়ানো কারো রেফারেন্সে সে চলমান, তখন তার স্পিড বাসের সমান।”
“অর্থাৎ স্পিড ব্যাপরটা আপেক্ষিক, তাই তো? দুটো ট্রেন একদিকে গেলে তাদের আপেক্ষিক গতি কম, এবং উল্টোদিকে চললে আপেক্ষিক গতি বেশি। ঠিক?”
মেহুলি বলল, “এককথায় স্পিড মাপতে গেলে কোথা থেকে মাপছি, সেটা জরুরি। সেই অবস্থানকে বলি ফ্রেম অফ রেফারেন্স, আর ফ্রেম অফ রেফারেন্সকে স্থির ধরে নিয়ে অঙ্কটা কষি।”
দিদিমণি বললেন, “একদম ঠিক। কিন্তু একজন আছে যে এই ফ্রেমটার পরোয়া করে না।”
আমি বললাম, “মানে?”
“মানে যে রেফারেন্স ফ্রেম থেকেই দেখো না কেন মহাশূন্যে আলোর গতি সবসময়েই সেকেন্ডে ৩০ কোটি কিলোমিটার। তবে হ্যাঁ, যখন আলো কোনো মাধ্যম দিয়ে যায়, তখন তার গতি একটু কমে যায়।
তবে মহাশূন্যে, একটা ফোটনের সঙ্গে যদি আরেকটা ফোটনের দেখা হয়, তাহলে তারা একদিকেই যাক বা উল্টোদিকে – তাদের আপেক্ষিক গতি ওটাই থাকবে। সেকেন্ডে তিরিশ কোটি কিলোমিটার! আরেকটা কথা। বাস্তবে আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে কেউ যেতে পারে না। এটা ধরে নিয়েই ফিজিক্সকে চলতে হবে।”
কথাটা মেহুলির মোটেও পছন্দ হলো না, “বললেই হলো? গেলে হবেটা কী?”
দিদিমণি আবারও ভারি খুশি হয়ে গেলেন, “ঠিক কথা। যুক্তি ছাড়া কোনোকিছুই মানবে না। এই মনোভাবটাই তো বিজ্ঞানের প্রাণভোমরা। এসো, তাহলে দেখা যাক, কেন সেটা সম্ভব নয়। অথবা তত্ত্বগতভাবে ধরে নিলে কী কী হতে পারে। তবে সেটার জন্য একটু অঙ্ক কষতে হবে কিন্তু!”
বিড়বিড় করলাম, “আ বয়েল, মুঝে মার।”
“কিছু বললে?”
“না দিদি, পেন্সিলটা খুঁজছিলাম।”

“দেখো মেহুলি, তোমার প্রশ্নের জবাব এককথায় হয় না। তার আগে একটু অন্য আলোচনা করে নিতে হবে। যেহেতু তোমরা ছোটো, সেইজন্য আমি চেষ্টা করব যথাসম্ভব জটিলতা পরিহার করে বিষয়টার একটা আউটলাইন স্কেচ আঁকতে।
নিউটনের গতিসূত্র নিয়ে একটু সমস্যা দেখা যাচ্ছিল। যতক্ষণ গতিবেগ কম ততক্ষণ সব গণনা ঠিকঠাক মিলেও যখন গতিবেগ খুব বেশি হয়ে যাচ্ছিল, তখন নানাবিধ ভুল ধরা পড়ছিল। এই সমস্যা সমাধান করতে যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে আইনস্টাইনের নাম সর্বাগ্রগণ্য। 
আইনস্টাইনের নাম তোমরা সবাই শুনেছ। তিনি বলেছিলেন, সারা বিশ্বপ্রপঞ্চ এক নিয়মের অধীনে চলছে। ইউনিফায়েড ফিল্ড থিয়োরিতে তিনি বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেন। স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি সেই ইউনিফায়েড থিওরির একটি স্পেশাল কেস, যেখানে মহাকর্ষ বলকে নগণ্য ধরে হিসেব কষা হয়। আবার তোমরা যে নিউটনের গতিসূত্র পড়ো, সেটাকে আবার ওই স্পেশাল থিওরির স্পেশাল কেস বলা যায়। সেখানে বস্তুর বেগ আলোর তুলনায় নগণ্য। যাই হোক এই থিওরি আমাদের অভ্যস্ত ভাবনায় একটা বড়োসড়ো ধাক্কা দিল।
নিউটনের গতিসূত্রে দুটো জিনিস ধ্রুবক। বস্তুর ভর (mass) এবং দুটি ঘটনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান (time interval)। 
আইনস্টাইন বললেন বস্তুর ভর ও শক্তি আলাদা নয়, তারা একে অন্যতে রূপান্তরিত হতে পারে। একটা ফর্মূলাও দিয়ে দিলেন।
E = mc2 
সবাই জানো, তবু বলি – E = এনার্জি, m = বস্তুর ভর এবং c = আলোর গতিবেগ।
তার মানে হলো, কোনো ভরের বিনাশ হলে তা শক্তিতে রূপান্তরিত হবে। শক্তির পরিমাণ ওই সমীকরণটা থেকে পাওয়া যাবে। যেহেতু আলোর গতিবেগ একটা বিশাল সংখ্যা, তায় আবার তার স্কোয়্যার – ফলে সামান্য ভরের বদলে অপরিমিত শক্তি পাওয়া যাবে। কেমন জানো? ধরো, একটা কাগজের ক্লিপের ভরকে যদি বিনাশ করা যায় তাহলে প্রায় ১৮ কিলোটন টিএনটির সমান শক্তি পাওয়া যাবে। হিরোসিমাতে যে অ্য।টম বোমাটা পড়েছিল তার ক্ষমতা এর সমান।  বস্তুতঃ, অ্যাটম বোমার ভিতরে যে পরমাণু ভাঙার চেন রি-অ্যাকশন হয়, তাতে নিউট্রন ধ্বংস হয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
যাকগে, আমরা অ্যাটম বোমা নিয়ে কথা বলছি না। বলছি ভরের নিত্যতা নিয়ে। তাহলে এটা প্রমাণিত হলো যে বস্তুর  ভর পরিবর্তনীয়। তাই অতি দ্রুত গতিসম্পন্ন কণার ক্ষেত্রে নিউটনের সূত্র কাজ করে না।
আবার দেখো, এই যে কোনো বস্তু যদি আলোর কাছাকাছি গতিতে চলে, তাহলে তার ভর বেড়ে যাবে।”
মীরা চিন্তিত, “এ বাবা! ওজন কমাতে রোজ তো খুব দৌড়াচ্ছি। সো আই হ্যাভ টু বি ভেরি কেয়ারফুল অ্যাবাউট স্পিড। বেশি জোরে দৌড়ালে ...”
ক্লাসের কোনে ফিকফিক হাসির আওয়াজ। দিদিমণি তাকাতেই শ্শ্শ্ ...
ব্ল্যাকবোর্ডে ঘসঘস করে আরেকটা ইকুয়েশন লেখা হলো –
“m'=m1-v2c2
m' = চলমান বস্তুর ভর, v = বস্তুর বেগ, c = আলোর বেগ, m = স্থির অবস্থায় বস্তুর ভর।
যখন বস্তুর বেগ আলোর তুলনায় নেহাৎ নগণ্য, তখন v2c2 এর মান শূন্য বলা যায়। তখন m’= m.
এই অবস্থায় নিউটনের গতিসূত্র নিয়ে কাজ করলে ফলাফল ঠিকঠাক আসবে।
কিন্তু  v আর c এর মান যদি তুলনীয় হয়, তাহলে 1-v2c2  এর মান একের চেয়ে অনেক কম হবে। তার মানে m’ এর মান m এর চেয়ে অনেকটাই বেড়ে যাবে।  আর যদি v আর c সমান  বা প্রায় সমান হয় তাহলে m’ এর মান অসীম হয়ে যাবে। তখন তাকে নড়ানোর মতো শক্তিই থাকবে না! দুটো পরস্পরবিরোধী ঘটনা তো আর একসঙ্গে ঘটতে পারে না। তাই বস্তু বাস্তবে আলোর সমান গতিতে চলতে পারে না।” 
মেহুলি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল, “ভরকে নিয়েই যতো প্রবলেম!”
দিদিমণি মাথা নাড়লেন, “শুধু ভর বাড়ে এমন নয়,  বস্তুর দৈর্ঘ্যও কমে যায়। ধরো তুমি পৃথিবী থেকে একাট ২০০মিটার লম্বা ৪০ মিটার উঁচু স্পেসশিপ ছেড়েছ, যেটার গতিবেগ আলোর বেগের ৮৬.৫%। তাহলে তুমি যখন সেটাকে দেখবে, তোমার কাছে তার দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে প্রায় অর্ধেক, মানে ১০০ মিটার। উচ্চতা কিন্তু একই থাকবে।”
মেহুলি দিদিকে লুকিয়ে আমায় ভেংচি কাটল। তারপর নিরীহ গলায় প্রশ্ন করল, “আর সময়?”
“সময়ের ক্ষেত্রে ফলাফলটা আরো মারাত্মক। তার নাম টাইম ডায়ালেশন। তার মানে হলো, যে স্থির আছে তার তুলনায়, খুব দ্রুতগতিতে চলা বস্তুর সময় অনেক ধীরে চলবে।”
আমরা এ ওর দিকে বোকার মতোন তাকাই। মেহুলিও দেখি মাথা ধরে বসে আছে। দিদিমণির দয়া হল। বললেন, “একটা উদাহরণ দিলে তোমরাও বুঝতে পারবে। রাম আর শ্যাম দুই যমজ ভাই। বয়েস ধরো পনেরো বছর। রাম একটা স্পেসশিপে চড়ে রওনা দিল। ধরো সেই শিপটা আলোর ৯৯.৫% গতিতে ছুটছে। সে পাঁচ বছর মহানন্দে মহাকাশে ঘুরে বেড়াল। তারপর সে যখন পৃথিবীতে ফিরে এল, তখন তার বয়েস কতো?”
মেহুলি খুব সাবধানে জবাব দিল – ‘২০ বছর?”
“আর শ্যামের?”
আমি ভেজালের গন্ধ পাই। চুপ করে থাকলাম। মীরা বলল, “কেন কুড়িই তো হবে। যমজ ভাই যখন।”
“সেখানেই তো মুস্কিল। শ্যাম ছিল পৃথিবীতে। সেটা তো ওই শিপটার তুনায় খুবই আস্তে ঘোরে, তাই না? কাজেই রামের পাঁচ বছরের সময় তার কাছে অনেকটাই লম্বা। স্পিডের এই রেশিওতে, তা ধরো গিয়ে প্রায় দশগুণ! তার মানে –“
আমি রুদ্ধশ্বাসে বলি, “পঞ্চাশ বছর?”
“রাইট। রাম আর শ্যামের যখন আবার দেখা হলো, তখন রামের বয়েস কুড়ি আর শ্যামের পঁয়ষট্টি! তাই বলি আলোর গতির সঙ্গে একদম ইয়ার্কি নয়!”
মুচকি হেসে দিদিমণি ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।

[৩]  
আজ ক্লাসে ঢুকে আড়চোখে বোর্ডের দিকে চেয়ে দেখলাম। নাঃ, বোর্ড পরিষ্কার। বরং দিদিমণি স্মার্ট বোর্ডে খুট খুট করছেন। মনটা খুশি হয়ে গেল। আলোদির ভিসুয়াল প্রেজেন্টেশন ভীষণ ভালো হয়। তাড়াতাড়ি নিজের সিটে গিয়ে বসি। 
“দুদিন ধরে আলো নিয়ে অনেক কথা বলা হল। আজ বরং সবার জানা বিষয়টাই বলি কেমন? এই যে কদিন ধরে আলো আলো করছি! সেই আলোর উৎসের খোঁজ করি আজ।”,
মনটা তেতো হয়ে গেল। কতো আশা করে এলাম যে নতুন কিছু শুনবো। ভাল্লাগে না! ক্লাস সিক্স, নাকি ফোর, নাকি সেই প্রত্নযুগ থেকে, প্রত্যেক ক্লাসে একই কথা শুনে আসছি – ‘আমাদের আলোর প্রধান উৎস সূর্য। তাতে হয়ে চলা নিউক্লিয়ার ফিউশনের দরুণ যে প্রচন্ড তাপ ও আলোর বিকিরণ হয়, সেটাই আমাদের জীবনধারণের মূল শক্তি,’ যত্তসব!
দিদিমণি বলে চলেছিলেন, “সূর্যের একদম ভিতরের অংশের (Core) তাপমাত্রা প্রায় ১৫ লক্ষ সেন্টিগ্রেড। সেখানের মূল উপাদান হল হাইড্রোজেন। উপরিভাগের তাপমাত্রার চেয়ে অন্ততঃ তিরিশ হাজার গুণ বেশি। এর ফলে কোরের মধ্যে একটা প্রচন্ড চাপ তৈরি হয়। সেই তাপ ও চাপের ফলে হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি করে। এরই নাম নিউক্লিয়ার ফিউশন। এতে বিশাল তাপ উৎপন্ন হয়। তাতে পরবর্তী ফিউশন রিয়্যাকশন আরো দ্রুতহারে হতে থাকে। সমানে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে, আর আমরাও সূর্য থেকে তাপ আর আলো পেতে থাকি।”
কৃষ্ণা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল, “হাইড্রোজেন ফুরিয়ে গেলে? “
“সে বিশাল ভান্ডার ফুরোতে ঢের দেরি। ছশো থেকে আটশো কোটি বছর তো বটেই। কিন্তু মুস্কিল কি জানো, ক্রমাগত বাড়তে থাকা ফিউশন রিয়্যাকশনের জন্য সূর্যের আলোর ঔজ্বল্য প্রতি ১০০ কোটি বছরে ছয়, মতান্তরে দশ পারসেন্ট বাড়ে। তাহলে ধরো গিয়ে ওই একশো কোটি বছর পরে পৃথিবী যে পরিমাণ গরম হয়ে যাবে, তাতে কোনো প্রাণের চিহ্নই বাকি থাকবে না।” 
“যাঃ, বলে কী? এই জন্য আলোদির কথা শুনতে হয়। কখন যে চমকে দেবেন, আগে থেকে বোঝাই যায় না!” – মেহুলি ফিসফিসিয়ে উঠল।
“আলোর অনেক উৎসের কথাই তোমরা জানো। সেগুলো বলে লাভ নেই। আজ শুধু তোমাদের বায়োলুমিনিসেন্সের কথা বলি।”
“জোনাকি? ছোটোবেলায় পড়েছিলাম বাবুই পাখি নাকি জোনাকি ধরে এনে ওর বাসায় পুঁতে রাখে, ভেতরে আলো হবে বলে।” - মীরাকে চুপ করিয়ে রাখা খুব মুস্কিল। 
“হ্যাঁ জোনাকি, গ্লোওয়ার্ম, অ্যাঞ্জেল ফিস – এরকম অনেকের শরীর কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য আলো ছড়ায়। নিউজিল্যান্ডের ওয়াইতোমোতে কয়েকটা গুহা আছে, নৌকা করে যেতে হয়। তার ভিতরে অসংখ্য গ্লোওয়ার্ম থাকে। ভিতরে দারুণ দেখতে লাইমস্টোনের ডিপোজিশন।”
দিদি ছবি দেখাতে থাকেন। আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে চিত্রার্পিত হয়ে বসে থাকি। জলের ভেতরে আধখানা মুখ লুকিয়ে যেন এক ক্যাথিড্রাল! অসংখ্য গ্লোওয়ার্মের আলোয় এক স্বপ্নিল পরিবেশ। অন্য কোনো আলো নেই। বড়ো হয়ে আমি একদিন নিউজিল্যান্ড যাব!‌ ততদিন থাকবে তো?
দিদি বললেন, “আশা করা যায় থাকবে। ভেতরে এখন ছবি তোলা, ফ্ল্যাশ ব্যবহার করা মানা। কৃত্রিম আলোতে ওদের অসুবিধে হয়। তাছাড়া, প্রতিদিন কতো ট্যুরিস্ট ঢুকতে পারবে সেটাও নির্দিষ্ট। পুরো যাত্রাটাই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।
জানো তো, আমাদের উত্তরবঙ্গে এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে এক সময় অনেক জোনাকি ছিল। সুকনার ওপর দিয়ে ট্রেন যাবার সময়ে দুধারের মাঠ হাজার হাজার জোনাকির আলোর নাচন এক অপরূপ দৃশ্য তৈরি করত।”
“জানিস, আমি কোনোদিন জোনাকি দেখিনি।”

“গতবছর আমরা উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম। কই, দেখতে পাইনি তো!”

“কী করে পাবে? আলোকদূষণে ওরা হারিয়ে যাচ্ছে” - দিদিমণি কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন।
	
“আলোকদূষণ? আলোও দূষণ ছড়ায়?” – কৃষ্ণা রীতিমতো অবাক।

“একটা সীমারেখার পর প্রকৃতিকে অতিক্রম করলেই বিপদ। যেসব অত্যুজ্বল আলো, যেমন ধর, স্ট্রিটলাইট, ফ্লাডলাইট বা বিজ্ঞাপনের আলো – মানে যে আলো উপর বা পাশের দিকে ছড়ায় – সেটাই আলোকদূষণের প্রধানতম উৎস। 
এই জোনাকিদের কথাই ধরো। বিদ্যুতের আলোয় যখন মাঠ, ঘাট, রাস্তা, সব আলোকিত হয়ে উঠল– তখন এই জোনাকিরা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যেতে থাকল। আলোর সংকেতেই তো ওরা সঙ্গীকে ডাক পাঠাত। এই কৃত্রিম আলোর জন্য ওদের জনন প্রক্রিয়াটাই ব্যাহত হয়ে গেল!
বীচের আলো সি-টার্টেলদের ভুল দিকে চালনা করে, তাদের মৃ্ত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে।
আকাশের দিকে তাক করা আলোয় প্রতি বছর কতো পরিযায়ী পাখি মারা যায় জানো? কৃত্রিম আলোয় পাখিদের রাতে ঘুম হয় না। তারা দিন ভেবে ওড়াউড়ি করে। দিক ভুল হয়। অতিরিক্ত শ্রান্তি তাদের মৃত্যুর সময় এগিয়ে নিয়ে আসে। এমন আরও কতো ...
International Dark-Sky Association বলছে, একা আমেরিকাই যে পরিমাণ আলো অকারণে জ্বালায়, তাতে বছরে তিরিশ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আর ৮.২ মিলিয়ন টন কয়লা পোড়ে। তাতে প্রতি বছর ১৪.১ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই অক্সাইড তৈরি হয়। 
এছাড়াও আলোকদূষণ মানুষের শরীরে অনিদ্রা, চোখের সমস্যা এবং লোয়ার ইমিউনিটি সিস্টেমের জন্ম দেয়। কারণ রাতের অন্ধকারেই ইমিউনিটি সিস্টেম নিজেকে পুনর্গঠত করে। রেটিনায় আলো পড়লে সে প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। আলোকদূষণ ক্যান্সারকেও ত্বরান্বিত করতে পারে। 
রাতের আঁধার আর আকাশভরা তারা মানসিক টেনশন কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু ...”
মেহুলি ফিসফিসিয়ে বলল, “এবার থেকে ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’ – গাইবার আগে চেক করে নিতে হবে আলোটা অর্গ্যানিক কিনা!“
সত্যিই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যায় না।

বৈশাখী ২০২৪