ইংরেজী ক্যালেন্ডারের ১৯১৩ সাল। প্রথম ভারতীয় তথা এশীয় হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একই বছরে ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ দাদাসাহেব ফালকের পরিচালনা এবং প্রযোজনায় মুক্তি পায় দেশের প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র (নির্বাক) 'রাজা হরিশ্চন্দ্র'। আর এই ঐতিহাসিক বর্ষেই প্রখ্যাত চিকিৎসক বঙ্কুবিহারী চৌধুরী এবং উর্মিলা দেবীর তৃতীয় সন্তানের জন্ম। এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান। নাম রাখা হয় বিভা। যার অর্থ 'কিরণ'। আচ্ছা, পিতা-মাতার সম্মুখে কি শিশুটির অনাগত ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল? কেন-না, পরবর্তী জীবনে তাঁর গৌরবময় কৃতিত্বের দীপ্তি উদ্ভাসিত করেছে বিজ্ঞানমহলকে। বিভাদেবীর পিতা বঙ্কুবিহারী ছিলেন হুগলি জেলার ভান্ডারহাটি গঞ্জের প্রসিদ্ধ জমিদারবংশের সন্তান। উজ্জ্বল ছাত্র। মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়াকালীন ব্রাহ্ম গিরিশচন্দ্র মজুমদারের কন্যা উর্মিলাকে বিবাহ করেন। বিয়ের পর তিনিও ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়েছিলেন। ফলে, গ্ৰামের বাড়িতে আর ঠাঁই হয়নি। পারিবারিক সম্পত্তি থেকেও চিরতরে বঞ্চিত হয়েছিলেন। এরপর সস্ত্রীক কলকাতায় চলে আসা। বসবাস শুরু করেন ব্রড স্ট্রিট এলাকায়। তাঁদের ছয়টি সন্তান। পাঁচ কন্যা ও এক পুত্র। তাঁদের মধ্যে একজন কন্যা খুব কম বয়সেই মারা যান। ছোট থেকেই বিভা পড়াশোনায় তুখোড়। নতুন নতুন বিষয় শিখতে ও জানতে সদা-আগ্ৰহী। ঠিক যেন সরস্বতীর বরকন্যা। বিজ্ঞানে সবিশেষ কৌতূহল। ভর্তি হলেন বেথুন স্কুলে। অল্পদিনেই মেধাবী ছাত্রী হিসেবে সুনাম অর্জন করে নেন। ম্যাট্রিক পাশ করে গেলেন স্কটিশ চার্চ কলেজ। নিলেন পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স। তৎকালীন সমাজে যা ছিল এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। একেই এদেশে তখনও নারীশিক্ষার সার্বিক প্রসার ঘটেনি। খুব সামান্য সংখ্যক মেয়েরা স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার স্তরে পৌঁছতেন। যারা এতদূর পর্যন্ত আসতেন, তাঁদের মধ্যেও যে কয়েকজন বিজ্ঞানে আগ্ৰহ দেখাতেন, তাঁদের অধিকাংশেরই ঝোঁক থাকত মূলত চিকিৎসাবিদ্যা অথবা রসায়নে। চিত্রটা শুধুমাত্র এদেশের নয়। ভারতকে শাসন করতেন যে ইংরেজরা, এক্ষেত্রে তাঁদের মাতৃভূমি ব্রিটেনের ছবিটাও খুব একটা পৃথক ছিল না। বিশেষত পদার্থবিজ্ঞানে। বিষয়টা যেন একচেটিয়াভাবে পুরুষদেরই। এর জন্য অবশ্য তখনকার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাও সমানভাবে দায়ী ছিল। মেয়েরা এই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে কোথায় চাকরি করবে? তা ছাড়া, গবেষণার সুযোগও অপ্রতুল। এমন বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতেও বিভা উচ্চশিক্ষার জন্য পদার্থবিদ্যাকেই বেছে নিয়েছিলেন। বি. এস. সি সম্পূর্ণ হতে ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজে যোগদান করেন। '৩৬ সালে এম. এস. সি পাশ। তাঁর শিক্ষাবর্ষে তিনি একমাত্র মহিলা হিসেবে পদার্থবিদ্যায় পোস্ট গ্ৰ্যাজুয়েট হন। তাঁর পূর্বে মাত্র দু'জন মহিলা এই সাফল্য অর্জন করেছেন। শুরু থেকেই গবেষণার দিকে তাঁর ঝোঁক। চলে গেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। দেখা করলেন দেবেন্দ্রমোহন বোসের সঙ্গে। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান, সম্মানজনক 'তারকনাথ পালিত' অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত। স্বনামধন্য বিজ্ঞানী, দেশ-বিদেশ সর্বত্র তাঁর পরিচিতি। পাশাপাশি, তিনি ছিলেন বিভাদেবীর আত্মীয়। তাঁর মাসি নির্মলার কন্যা নলিনীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল দেবেন্দ্রমোহনের। দেবেন্দ্রমোহন প্রথমদিকে বিভাদেবীকে কাজে নিতে আপত্তি জানালেন। একজন মহিলাকে দেওয়ার মতো উপযুক্ত কাজের সন্ধান তাঁর কাছে নেই। তিনি যেন অন্য পথ খুঁজে নেন। এদিকে বিভাদেবীও ছাড়বার পাত্রী নন। তিনিও আদা-জল খেয়ে লেগে রইলেন। তাঁকেও গবেষণায় সামিল করতে হবে। শেষমেষ তাঁর দৃঢ় সংকল্পের কাছে নতিস্বীকার করলেন বর্ষীয়ান বিজ্ঞানী। ইতিমধ্যে দেবেন্দ্রমোহন ১৯৩৭ সালে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ডিরেক্টর হয়েছেন। বিভাদেবী সেখানেই দেবেন্দ্রমোহনের অধীনে কাজে যোগ দিলেন। তাঁর সামনে উন্মোচিত হল গবেষণার সুপ্রশস্ত দ্বার। দীর্ঘদিন ধরে মনের কোণে লালন করা স্বপ্নখানা সার্থকতার মুখ দেখল। প্রথম বাঙালি মহিলা হিসেবে আধুনিক বিজ্ঞানে গবেষণার কাজে ব্রতী হলেন। পরের বছর ১৯৩৮ সালে এক বিজ্ঞান সম্মেলনে বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ালথার বোথের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় দেবেন্দ্রমোহনের। বোথে সেসময়ে ফোটোগ্ৰাফিক প্লেটের উপর 'কসমিক রে' অর্থাৎ মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাব নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুই বৈজ্ঞানিকের মধ্যে মতের আদান-প্রদান হয়। দেবেন্দ্রমোহনেরও এবিষয়ে অনুসন্ধিৎসা জাগে। দেশে ফিরে বিভাদেবীর সঙ্গে এই নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বোথে ১৯৫৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছিলেন। জাপানের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হিদেকি ইউকাওয়া ১৯৩৫ সাল নাগাদ তত্ত্বগতভাবে প্রমাণ করেন যে নিউক্লিয় বলের আদান-প্রদানের সময়ে কিছু কণার বিনিময় ঘটে। যেগুলোকে তিনি 'Exchange Particle'' বা 'বিনিময়-কণা' নামে অভিহিত করেন। ইউকাওয়ার হিসেব অনুযায়ী এই ধরণের কণাগুলির ভর ইলেকট্রনের চেয়ে ২৭০ গুণ বেশি, তবে প্রোটনের চাইতে অনেক কম। অর্থাৎ, এগুলোর ভর ইলেকট্রন এবং প্রোটনের মাঝামাঝি হওয়ায় এই শ্রেণীর কণাগুলোর নাম দেওয়া হয় 'মেসোট্রন', গ্ৰিক ভাষায় শব্দটির অর্থ হল 'মধ্যবর্তী'। পরে আরও সংক্ষিপ্ত করে বলা হয় 'মেসন'। মৌলিক কণা নিয়ে গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৪৯ সালে এই বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ইউকাওয়ার গবেষণা ছিল তত্ত্বভিত্তিক। ইতিপূর্বে ১৯৩২ সালে মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী কার্ল ডেভিড অ্যান্ডারসন ইলেকট্রনের সমভর এবং ধনাত্মক আধানবিশিষ্ট কণা পজিট্রন আবিষ্কার করেছেন। ইউকাওয়ার গবেষণার কিছুদিনের মধ্যে সি.ডি.অ্যান্ডারসন আরও একটি নতুন কণার সন্ধান পান। তিনি প্রথমে সেটাকেই ইউকাওয়ার তত্ত্বে উদ্ভাবিত 'মেসন' কণা বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, এই কণার ভর ইলেকট্রনের ভরের ২০৭ গুণ। অথচ, ইউকাওয়ার গবেষণায় মেসনের ভর বেরিয়েছে ২৭০ গুণ। অ্যান্ডারসন এই নব আবিস্কৃত কণাগুলোর নাম দেন 'মিউয়ন' (muon)। এদিকে ভারতে দেবেন্দ্রমোহন এবং বিভা বিষয়টি নিয়ে হাতে-কলমে পরীক্ষা শুরু করলেন। তখনও পার্টিক্ল অ্যাক্সিলারেটর (Particle accelerator) দুর্লভ। তাই অব-পারমাণবিক কণা প্রাপ্তির একমাত্র উৎস সূর্যরশ্মি। সমতল এলাকায় এই পরীক্ষা চালানো অসুবিধাজনক। তাঁরা পাহাড়ি অঞ্চল বেছে নিলেন। দার্জিলিং, সান্দাকফু এবং ভূটান সংলগ্ন ফারিজঙ চত্বরে বসালেন ইলফোর্ড কোম্পানির হাফ-টোন প্লেট। যা মহাজাগতিক রশ্মির সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম। প্লেটগুলো কোথাও খোলা বাতাসে, কোথাও জলের তলায়, অন্যত্র আবার কাঠ-কাদা দিয়ে তৈরি কাঠামোর নীচে রাখা হল। প্লেটে সূর্যালোকের বিচ্ছুরণ ঘটে প্রোটন বা আলফা ট্রাকের থেকে পৃথক, বক্রাকার আয়নিত গতিপথ ধরা পড়ল। তাঁরা বুঝতে পারলেন এটা সম্ভবত মেসনের গতিপথ। হাফটোন-প্লেটগুলো গবেষণাগারে নিয়ে এসে পরীক্ষা করে দুই ধরণের ভর পাওয়া গেল। একটার মান দু'শোর কাছাকাছি, অন্যটির তিনশো ছুঁই-ছুঁই। কিন্তু, তাঁরা আলাদা আলাদা ভরের কণা দু'টি পৃথক করে শণাক্ত করতে পারলেন না। ভর নির্ণয়ের পরীক্ষাতেও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। তাঁরা পুনরায় পরীক্ষাটি করলেন। প্রায় ২০২ দিন ধরে প্লেটগুলোকে সূর্যালোকে রেখে দিলেন। ফের পরীক্ষাগারে নিয়ে গিয়ে ভর পরিমাপ... ফলাফলে পূর্বের তুলনায় বিশেষ তারতম্য চোখে পড়ল না। এরপর তাঁরা গবেষণাটি নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে 'হাফটোন' নয়, 'ফুলটোন' প্লেটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। নচেৎ গবেষণা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া অর্থহীন। এবার তখনকার বিশ্ব-রাজনীতির দিকে চোখ ফেরানো যাক। পশ্চিমা দেশগুলোতে উগ্ৰ জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্প, জার্মানি, ইতালি-সহ একাধিক রাষ্ট্রে নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ক্ষমতা সম্প্রসারণের বল্গাহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা - এসবের চরম পরিণতি হিসেবে মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যাপক ও ভয়াবহ লড়াই 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ' শুরু হয়ে গেছে। যার প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ অভিঘাতে সমগ্ৰ বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত। দেশে-দেশে অর্থনৈতিক মন্দা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, খাদ্যদ্রব্য-সহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বিপুল অভাব। আর পাঁচটা সামগ্ৰীর মতো উন্নত গবেষণা চালাতে একান্ত প্রয়োজনীয় ফুলটোন প্লেট সংগ্ৰহ করা সম্ভব হল না। শেষমেষ বাঙালি বিজ্ঞানীযুগল গবেষণাটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন। গবেষণাটি চলাকালীন বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত 'নেচার' পত্রিকায় একাধিক প্রবন্ধ ছাপিয়েছিলেন তাঁরা। বিশ্বের বিজ্ঞানীমহল কৌতূহলভরে তাকিয়ে ছিলেন বিভাদেবীদের কাজের দিকে। শেষপর্যন্ত উন্নত যন্ত্রপাতির অভাবে প্রত্যাশাপূরণে ব্যর্থ হতে হয় তাঁদের। তাঁরা যে সময়ে এই গবেষণার কাজে হাত দিয়েছিলেন, সেই একই সময়কালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ সেসিল ফ্রাঙ্ক পাওয়েলও একই বিষয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। কর্তৃপক্ষের তরফে অর্থানুকূল্য এবং উন্নত পরিকাঠামো পেয়ে একই পদ্ধতি অবলম্বন করে কোনরকম খুঁত ছাড়াই পরীক্ষার কাজ সম্পূর্ণ করেন তিনি। তাঁর ফলাফলের সঙ্গে ইউকাওয়ার তত্ত্বে উল্লিখিত মেসনের ভর মিলে যায়। ১৯৫০ সালে নোবেল দিয়ে সম্মানিত করা হয় এই বরেণ্য বৈজ্ঞানিককে। তবে এইটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সেদিন যদি দেবেন্দ্রমোহন এবং বিভাদেবী উন্নত ব্যবস্থাপনা পেতেন, নোবেল পুরস্কার তাঁরাই কুক্ষিগত করতেন। তারপর বিভা পাড়ি জমান ইংল্যান্ড। যোগ দেন ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়তে। খ্যাতিমান ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী স্যার প্যাট্রিক ব্ল্যাকেটের তত্ত্বাবধানে। সেখানে 'এক্সটেনসিভ এয়ার শাওয়ার' (extensive air showar) নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। ১৯৪৯ সালের প্রথমার্ধে তাঁর গবেষণাপত্র 'extensive air showars associated with penetrating particles' জমা দেন। '৫২ সালে পি.এইচ.ডি শেষ করে প্রথম বাঙালি মহিলা হিসেবে পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করলেন। তাঁর এই কীর্তি চারিদিকে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। জনপ্রিয় সংবাদপত্র 'দ্য ম্যানচেস্টার হেরাল্ড' তাঁর কাজ এবং সাক্ষাৎকারকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরে। তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল - "Meet Indian's New Woman Scientist - she has an eye of cosmic rays." এসময়ে মেয়েদের শিক্ষা সম্বন্ধে অভিমানী সুরে বিভাদেবী বলেছিলেন, "Women are terrified of physics - that is the trouble. It is a tragedy that we have so few women physicists today. In this age when science, and physics particularly, is more important than ever, women should study atomic power ; if they don't understand how it works, how can they help decide how it should be used?" তাঁর এই বক্তব্য থেকেই তৎকালীন সমাজচিত্র সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। ১৯৪৯ সালে বিভাদেবী দেশে ফিরেছিলেন। বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা তখন সদ্য-প্রতিষ্ঠিত 'টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ' (TIFR) সংস্থার জন্য দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তরুণ বিজ্ঞানীদের খুঁজে চলেছেন। তাঁর আহ্বানে বিভাদেবী সেই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করলেন। তিনিই ছিলেন TIFR-এ যোগ দেওয়া প্রথম মহিলা গবেষক। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত, দীর্ঘ আট বছর তিনি এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। সেখানে 'ক্লাউড চেম্বার' নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেন। '৫৪ সালে কিছুদিনের জন্য আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। '৫৫ সালে অধ্যাপক সুকুমার বিশ্বাসের সঙ্গে ইতালির পিসায় আয়োজিত প্রাথমিক কণা বিষয়ক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৫৭ সালে TIFR থেকে বেরিয়ে 'ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি' (PRL)-তে গবেষণা শুরু করেন। বিশিষ্ট মহাকাশবিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাই তখন সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান। '৬০ সালে বিভাদেবী 'কোলার গোল্ড ফিল্ড' (KGF)-এ গবেষণার কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। '৭০ সাল নাগাদ নিয়ন ফ্ল্যাশ টিউব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ≥১৫০ GeV শক্তির মিউয়নের বৈশিষ্ট (সংখ্যাধিক্য, পূর্ণসংখ্যা এবং কৌণিক বিতরণ) সম্বন্ধে গবেষণা করেন। সহযোগী ছিলেন ওয়াই. সি. সাক্সেনা। পরীক্ষাটি কোলার স্বর্ণখনির ৫৮০ মিটার জলের সমতুল্য গভীরতায় পরিমাপ করা হয়েছিল। পরীক্ষায় দুইটি বিস্ফোরণ ধরা পড়ে। প্রথমটি কেন্দ্রের ট্র্যাকগুলির একটি সরু জেট সমন্বিত। অপরটি, ট্র্যাকের দুটি হালকা বান্ডিল সমন্বিত। এই বিষয়ে দীর্ঘদিনব্যাপী গবেষণা চালিয়ে যান। ১৯৭৭ সালে 'Pramana-Journal of Physics' পত্রিকায় তাঁদের গবেষণা সম্পর্কে লেখেন। স্বর্ণখনির গভীরে মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাব নিয়ে গবেষণার প্রবল আকাঙ্খা ছিল তাঁর। কিন্তু, বিক্রম সারাভাইয়ের প্রয়াণের পর কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেল না। অগত্যা কাজ অসমাপ্ত রেখে স্বেচ্ছাবসর গ্ৰহণ করলেন। ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে কর্মকালীন সময়ে ১৯৭৬ সাল নাগাদ তাঁর সঙ্গে অধ্যাপক ধীরেন্দ্রনাথ কুন্ডুর পরিচয় ঘটে। তিনি তখন 'সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স'-এর ডিরেক্টর। বিভাদেবী তাঁর কাছে অবসরের পরে উচ্চশক্তির কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। অধ্যাপক ডি.এন.কুন্ডু তাঁর ইচ্ছাকে মান্যতা দিয়ে সাহা ইনস্টিটিউটে অতিথি কর্মী হিসেবে কাজের সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন। এরপর কলকাতায় প্রত্যাবর্তন। এসময়ে সাহা ইনস্টিটিউটের ছাড়াও 'ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স' (IICS)-এর মতো ঐতিহ্যশালী বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানেও অতিথি গবেষক হিসেবে বেশ কিছুদিন গবেষণা করেছেন। আজীবন বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সাধিকা একদা সলিড স্টেট ডিটেক্টর, যেমন CR-39(DOP) উচ্চশক্তিসম্পন্ন ভারী কণা নিয়ে গভীর অভিনিবেশ সহকারে গবেষণা করেছেন। বিজ্ঞানচর্চায় যাতে ছেদ না পড়ে, তাই বিয়ে করেননি কোনদিন। সারাজীবনবপী নিরলস বিজ্ঞানসাধনায় ব্রতী এই মহতী প্রতিভা জীবদ্দশায় সরকারী অথবা বেসরকারী স্তরে পেলেন না কোন সম্মান কিংবা স্বীকৃতি। যা যুগপৎ বিস্ময় এবং লজ্জার সৃষ্টি করে। ১৯৯১ সালের ২রা জুন তাঁর জন্মস্থান কলকাতা শহরের বুকে অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পরবর্তীতে অপ্রত্যাশিতভাবে বিস্মৃতির অন্তরালে তলিয়ে যায় তাঁর নাম। বাঙালি সমাজ একরকম ভুলেই যায় ওনার কর্মকান্ড। যার চেতনার স্ফূরণে আলোকিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে জ্ঞানের জগৎ, তিনিই হারিয়ে যেতে বসেন অজ্ঞানতার অন্ধকারে। স্মৃতিপটে তাঁর ঔজ্জ্বল্য এতটাই ম্লান হয়ে যায় যে ২০০৮-এ ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স থেকে প্রকাশিত 'লীলাবতী'স ডটারস' (Lilavati's Daughters : The Women Scientists of India) গ্ৰন্থে অজস্র ভারতীয় মহিলা বিজ্ঞানীর কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা করা হলেও অনুল্লেখিত থেকে যায় তাঁর কথা। তবে বিগত কয়েক বছরে এই চিত্রের খানিক বদল ঘটেছে। ২০১৯ সালে 'ইন্টারন্যাশেনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন'(IAU)-এর তরফে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে তাঁর যুগান্তকারী অবদানকে স্বীকৃতি জানিয়ে একটি নক্ষত্রের নাম রাখা হয়েছে 'বিভা'। পৃথিবী থেকে নক্ষত্রটি প্রায় ৩৪০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এ ছাড়াও, সম্প্রতি প্রখ্যাত অধ্যাপক সুপ্রকাশ চন্দ্র রায় এবং পদার্থবিদ ও বিজ্ঞান-ইতিহাসের গবেষক রাজিন্দর সিং তাঁদের 'এ জুয়েল আনআর্থেড : বিভা চৌধুরী' (A Jewel Unearthed : Bibha Chowdhuri) গ্ৰন্থে তাঁর জীবন, বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। এমন মহীয়সী নারী তথা মানুষদের জীবনালেখ্য প্রচারের আলোয় আসুক। তাঁদের জীবন-সংগ্ৰাম, অটুট মানসিকতা, স্রোতের বিপরীতে চলার সাহস ক্ষয়িষ্ণু সমাজের যুবমনে আত্মবিশ্বাসের জাগরণ ঘটাবে। গর্বোজ্জ্বল ইতিহাসকে স্মরণ করার মাধ্যমে উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ে তোলার অকৃত্রিম প্রেরণা পাওয়া যাবে। তথ্যঋণ স্বীকার : উইকিপিডিয়া, অন্তর্জাল, নানান পত্রপত্রিকা, ইউটিউব, সুপ্রকাশ চন্দ্র রায় এবং রাজিন্দর সিং-এর লেখা প্রবন্ধ 'Bibha Chowdhuri - The First Woman Scientist at the TIFR' প্রভৃতি।